বেসরকারি যেকোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষক-কর্মচারী নিয়োগে বিশেষ নিয়ম চালু করেছিলেন কেন্দ্রীয় কৃষক লীগের সাধারণ সম্পাদক ও গাইবান্ধা-৩ (সাদুল্লাপুর-পলাশবাড়ী) আসনের সাবেক এমপি উম্মে কুলসুম স্মৃতি। যেকোনো নিয়োগের আগে তার কাছে অনুমতি নিতে হতো। অনুমতি নিতে গেলেই পদ হিসাব করে প্রার্থীদের কাছ থেকে টাকা নিতেন তিনি। এমপি ইউনুস আলী সরকারের মৃত্যুর পর ২০২০ খ্রিষ্টাব্দের ২১ মার্চ উপনির্বাচনে এমপি নির্বাচিত হয়েই স্মৃতি এ নিয়ম জারি করেছিলেন। এভাবে এমপি থাকা অবস্থায় সাদুল্লাপুর উপজেলার অন্তত ৪০টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নিয়োগ থেকে স্মৃতি হাতিয়ে নিয়েছেন প্রায় দুই কোটি টাকা।
উপজেলার ধাপেরহাট বিএমপি উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মাসুদ প্রামাণিক জানান, বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নীতিমালা অনুযায়ী বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটি কিছু পদে নিয়োগ দিতে পারবে। পদ শূন্য থাকা সাপেক্ষে প্রধান শিক্ষক, সহকারী প্রধান শিক্ষক, পিয়ন, আয়া ও নৈশপ্রহরী নিয়োগ দিতে পারবে তারা। তবে সহকারী শিক্ষক নিয়োগ দেবে এনটিআরসি। কিন্তু বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির হাতে থাকা নিয়োগের ক্ষেত্রে অলিখিত অনুমতি নিতে হতো সাবেক এমপি স্মৃতির। তিনি অনুমতি না দিলে নিয়োগ কার্যক্রম বন্ধ থাকত।
বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের একাধিক অধ্যক্ষ ও প্রধান শিক্ষক অভিযোগ করেন, পদ অনুযায়ী নিয়োগের আগে টাকা নিতেন এমপি স্মৃতি। পিয়ন, আয়া ও নৈশপ্রহরী পদের জন্য এক লাখ টাকা নিতেন। অফিস সহকারী পদের জন্য দিতে হতো দুই লাখ টাকা। সহকারী প্রধান শিক্ষক পদের জন্য দুই থেকে আড়াই লাখ টাকা। প্রধান শিক্ষক পদের জন্য দিতে হতো তিন লাখ টাকা। নিয়োগপ্রার্থীরা এমপিকে টাকা পরিশোধ করার পর প্রচার করতে হতো নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি। এর ব্যত্যয় হলে এমপি নিয়োগ বোর্ডে থাকা সরকারি প্রতিনিধিদের নিষেধ করতেন নিয়োগের অনুমতি দিতে।
কামারপাড়া ইউনিয়নের একটি বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক জানান, তার বিদ্যালয়ে নিয়োগের অনুমতির জন্য সাবেক এমপি স্মৃতির সঙ্গে তিন লাখ টাকার চুক্তি করেছিলেন। তিনি এমপিকে প্রথমে আড়াই লাখ টাকা দিয়ে বাকি অর্থ পরে দিতে চেয়েছিলেন। এটি শুনে এমপি রেগে হাতে নেয়া টাকা ছুড়ে মারেন। বাধ্য হয়ে পরদিন ধার করে পুরো টাকা তিনি দিয়ে এসেছেন পলাশবাড়ীতে এমপির ছোট ভাইয়ের বাসায়।
নিয়ামতনগর উচ্চ বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক ছিলেন শাহজাহান আলী। এই বিদ্যালয়েই প্রধান শিক্ষকের শূন্যপদে ২০২২ খ্রিষ্টাব্দে তাকে নিয়োগ দিতে চায় পরিচালনা কমিটি। কিন্তু এমপি স্মৃতি অনুমতি না দেয়ায় নিয়োগ কার্যক্রম বেশ কয়েক মাস ঝুলে থাকে। শাহজাহান আলী জানান, এ অবস্থায় এমপির কাছের একজন নেতার মাধ্যমে টাকা পাঠিয়ে নিয়োগের অনুমতি মেলে।
উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিস সূত্র জানায়, এই অফিস এককভাবে নিয়ন্ত্রণে রেখেছিলেন এমপি স্মৃতি। তার অন্যায় নির্দেশ না মানায় মাত্র আট মাসের মাথায় সাদুল্লাপুর থকে বিদায় নিতে হয়েছে সাবেক মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা এএইচএম মাহবুবুল ইসলামকে। স্মৃতি তার আস্থাভাজনদের দিয়ে এই কর্মকর্তাকে শারীরিক ও মানসিকভাবে হেনস্তা করেছিলেন। এমনকি মাহবুবুল ইসলামকে তিনি উপজেলা পরিষদের সভাকক্ষ থেকে বেরিয়ে যেতে বাধ্য করেন।
৫ আগস্ট রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর থেকে স্মৃতি পলাতক।
উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা আবুল হোসেন বলেন, দেশে রাজনৈতিক সরকার ক্ষমতায় থাকলে এমপির বিভিন্ন নির্দেশনা মেনে চলতে হয়। কিছু ক্ষেত্রে সরকারিভাবেই তাদের পরামর্শ নেয়া কিংবা যোগাযোগ রাখতে বলা হতো। তাই বিভিন্ন বিদ্যালয়ে শিক্ষক-কর্মচারী নিয়োগের ক্ষেত্রে সাবেক এমপি কী করেছেন, সেটি আমার জানা নেই। তবে নিয়োগ বোর্ডের একজন সদস্য হিসেবে আমি যোগ্য প্রার্থীকেই বাচাইয়ের চেষ্টা করেছি।
উপজেলা শিক্ষা কমিটির সভাপতি ও ইউএনও কাওছার হাবিব বলেন, দেশের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সব বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সভাপতিকে বাদ দেওয়া হয়েছে। সরকারি নির্দেশনা মোতাবেক বর্তমানে সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন ইউএনও। এই সুযোগে অনেক বিদ্যালয়ে শিক্ষক-কর্মচারী নিয়োগের কথা বলা হচ্ছে।