ঢাকা শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪ , ৫ বৈশাখ ১৪৩১ আর্কাইভস ই পেপার

nogod
nogod
bkash
bkash
uttoron
uttoron
Rocket
Rocket
nogod
nogod
bkash
bkash

মার্কসবাদের শিক্ষক : রেবতী বর্মণ 

মতামত

ফয়সাল আহমেদ

প্রকাশিত: ০০:২০, ৬ মে ২০২৩

সর্বশেষ

মার্কসবাদের শিক্ষক : রেবতী বর্মণ 

রেবতীমোহন বর্মণ। ইতিহাসের পাতায় ক্ষীণ হয়ে আসা একটি নাম। অথচ বৃটিশ তাড়িয়ে স্বাধীন ভারত বর্ষের ইতিহাস যারা রচনা করেছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম রেবতী বর্মণ। জন্ম ১৯০৩ খ্রিষ্টাব্দে কিশোরগঞ্জ জেলার ভৈরব উপজেলার শিমূলকান্দি গ্রামে। কিশোরগঞ্জ তখন ছিলো ময়মনসিংহ জেলার একটি মহকুমা। রেবতী বর্মণের পিতার নাম হরমোহন বর্মণ, মাতা রুক্মিণী দেবী। পাঁচ ভাই ও সাত বোনের মধ্যে তিনি সর্বকনিষ্ঠ। পেশায় আইনজীবী হরমোহনের পাঁচ পুত্র লালমোহন, যতীন্দ্রমোহন, মোহিনীমোহন, মনোমোহন এবং রেবতীমোহনের মধ্যে রেবতী বেছে নেন অনিশ্চিত এক বিপ্লবী জীবন। আমৃত্যু নিয়োজিত ছিলেন শোষণহীন সমাজ ও রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে। আপোষ করেননি কখনো আদর্শের বিপরীতে। বাংলায় মার্কসবাদ চর্চায় এমন নিবেদিতপ্রাণ মানুষ দ্বিতীয়জন পাওয়া দুষ্কর। মার্কসবাদ চর্চাকে সহজ করতে লিখেছেন গুরুত্বপূর্ণ বেশকিছু বই। তাঁর লেখা তরুণ রুশ, সমাজ ও সভ্যতার ক্রমবিকাশ এর মতো বইগুলো এখনো অনুসন্ধিৎসু পাঠক অন্বেষণ করেন। বলা হয়- বাংলা ভাষায় মার্কসবাদী সাহিত্য রচনায় তিনি অন্যতম পথিকৃৎ। মার্কসবাদকে সাধারণের উপযোগী করে প্রকাশের যে প্রয়াস গত শতকের তিরিশের দশকে শুরু হয়েছিল তার পেছনের অন্যতম কারিগর হলেন রেবতীমোহন বর্মণ। 
রেবতী বর্মণের মাধ্যমিকের পাঠ শুরু ঢাকায় পোগোজ হাইস্কুলে। সেখানে অধ্যয়নকালে তিনি বিপ্লবী জাতীয়তাবাদী সংগঠন বেঙ্গল ভলান্টিয়ারের সংস্পর্শে আসেন। সংগঠনটি পরিচালনা করতেন বিপ্লবী হেমচন্দ্র ঘোষ। পরে ঢাকা থেকে তিনি কুমিল্লা গভর্ণমেন্ট হাইস্কুলে পড়তে যান। ১৯২১ খ্রিষ্টাব্দে তিনি স্কুলের পড়াশুনা ছেড়ে অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দেন। ১৯২২-এ তিনি কিশোরগঞ্জের আজিমুদ্দিন উচ্চ বিদ্যালয় থেকে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধীনে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষা দেন এবং প্রথম স্থান অধিকার করেন।
তিনি আইএ পড়েন প্রেসিডেন্সি কলেজে। তারপর ভর্তি হন সেন্টপলস্ কলেজে। কলেজের অধ্যাপক কিরণচন্দ্র আঢ্যের আগ্রহেই সেন্টপলস্ কলেজে তার ভর্তি হওয়া। সেখানে তিনি হোস্টেলে থাকতেন। অধ্যাপক আঢ্য তার পড়াশুনার তত্ত্বাবধায়ন করতেন। সেন্টপলস্ এ অধ্যয়নকালে হঠাৎ একদিন তিনি গ্রেপ্তার হন। তারপর কারাগারে থেকেই বিএ পরীক্ষায় অংশ নেন রেবতী বর্মণ। ১৯২৯ খ্রিষ্টাব্দে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে এমএ পাস করেন। এমএ পরীক্ষায় তিনি দ্বিতীয় শ্রেণিতে প্রথম স্থান অধিকার করেছিলেন।
তিনি বিএ পরীক্ষাতেও প্রথম স্থানাধিকারী হিসাবে স্বর্ণপদক পেয়েছিলেন। পরে এই স্বর্ণপদক বিক্রি করে তিনি ‘বেণু’ নামক একটি মাসিক পত্রিকা প্রকাশ করেন। ঐ পত্রিকার মাধ্যমে বাংলার কিশোর-কিশোরীদের মনে দেশপ্রেম জাগানোই তার লক্ষ্য ছিলো। পত্রিকার শুরুটা হয়েছিল বেশ জোরেশোরেই। ‘বেণু’র প্রথম সংখ্যাতেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটি গান প্রকাশিত হলো। গানটি হলো, ‘মধ্যদিনে যবে গান/বন্ধ করে পাখি,/হে রাখাল, বেণু তব/বাজাও একাকী।/শান্ত প্রান্তরের কোণে/রুদ্র বসি তাই শোনে,/মধুরের ধ্যানাবেশে/স্বপ্নমগ্ন আঁখি;/হে রাখাল, বেণু যবে/বাজাও একাকী।/সহসা উচ্ছ্বসি উঠে/ভরিয়া আকাশ/তৃষাতপ্ত বিরহে/নিরুদ্ধ নিঃশ্বাস।/অম্বরপ্রান্তের দূরে/ডম্বরু গম্ভীর সুরে/জাগায় বিদ্যুৎ-ছন্দে/আসন্ন বৈশাখী।/হে রাখাল, বেণু যবে/বাজাও একাকী।’
রেবতী বর্মণের পরে ভূপেন্দ্রকিশোর রক্ষিত রায় ‘বেণু’ পত্রিকার পরিচালক নিযুক্ত হন। ১৯২৯ খ্রিষ্টাব্দের দিকে পত্রিকাটি তরুণদের মধ্যে ব্যাপক সাড়া ফেলতে সক্ষম হয়। 
কমরেড মুজাফ্ফর আহমদ তার ‘রেবতীমোহন বর্মণ’ নিবন্ধে লিখেন- ‘বন্দী-শিবিরে বসে বসেই তিনি ‘মার্কসবাদ’ সাহিত্য প্রচারের কথা চিন্তা করেছিলেন। তিনি একথা বিশেষভাবে উপলব্ধি করেছিলেন যে, আমাদের নিজেদের ভাষায় মার্কসবাদী সাহিত্য সৃষ্টি করতে না পারলে জনগণের ভিতরে কিছুতেই মার্কসবাদ প্রসার লাভ করতে পারবে না। তাই মুক্তি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই কমরেড নেপাল নাগ সহযোগে ঢাকায় ‘গণ-সাহিত্য চক্র’ নামে একটি ছোট্ট প্রকাশন-ভবন স্থাপন করেন। এখান থেকে তার ‘মার্কস্ প্রবেশিকা’ ও ‘সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি’ নামের দু'খানা পুস্তিকা প্রকাশিত হয়েছিলো।
‘ন্যাশনাল বুক এজেন্সী’ স্থাপনের পেছনেও কমরেড বর্মণের অনেকখানি প্রেরণা ছিলো। শুধু কমরেড সুরেন দত্ত ও আমার প্রেরণাতে যে ‘ন্যাশনাল বুক এজেন্সী’ স্থাপিত হয়নি একথা আজ সকলের জেনে রাখা ভালো। ‘ন্যাশনাল বুক এজেন্সী’ এই নামটিও কমরেড রেবতী বর্মণের পরিকল্পিত। কমিউনিস্ট পার্টির শুভেচ্ছায় স্থাপিত ও পরিচালিত ‘ন্যাশনাল বুক এজেন্সী’ই ছিলো সেই সময়ে (১৯৩৯ খ্রিষ্টাব্দে) সমস্ত ভারতবর্ষের একমাত্র দোকান। এটা বড় হয়ে সমস্ত ভারতবর্ষকে মার্কসীয় সাহিত্য পরিবেশন করবে এই কল্পনা থেকেই ব্যাপকতার অর্থে ন্যাশনাল কথাটা ব্যবহার করা হয়েছিলো।’
রেবতীমোহনের মার্কসবাদ চর্চা কতটা পরিকল্পিত ছিলো, তা সহজেই ধারণা পাওয়া যায় তার রচিত বইয়ের শিরোনামে আলো ফেললে। যদিও এসব বইয়ের অনেকগুলোই এখন আর সহজলভ্য নয়। তার বইগুলো হলো- ১. সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি (১৯৩৮), মার্কস প্রবেশিকা (১৯৩৮), কৃষক ও জমিদার (১৯৩৮), সাম্রাজ্যবাদের সঙ্কট (১৯৩৮), হেগেল ও মার্কস (১৯৩৮), ক্যাপিটাল ( মার্কসের ক্যাপিটালের বাংলায় সংক্ষিপ্তসার, ১৯৩৮), ভারতে কৃষক সংগ্রাম ও আন্দোলন (১৯৩৮), লেনিন ও বলশেভিক পার্টি (১৯৩৯), Society and its Development (1939), Marxist View of Capital (1939), সমাজের বিকাশ (১৯৩৯), সোভিয়েত ইউনিয়ন (১৯৪৪), শান্তিকামী সোভিয়েত (১৯৪৫), অর্থনীতির গোড়ার কথা (১৯৪৫), পরিবার, ব্যক্তিগত সম্পত্তি ও রাষ্ট্রের উৎপত্তি (অনুবাদ), সমাজতন্ত্রবাদ- বৈজ্ঞানিক ও কাল্পনিক (অনুবাদ), সমাজ ও সভ্যতার ক্রমবিকাশ। 
ব্রজবিহারী বর্মণ তার ‘মার্কসীয় সাহিত্য ও রেবতী বর্মণ’ নিবন্ধে লিখেন- ‘১৯৩০ খ্রিষ্টাব্দের গোড়াতেই বাংলার মার্কসীয় সাহিত্য প্রচারের সূচনা হয়। এই সময় থেকে ১৯৩৩ এর মাঝামাঝি পর্যন্ত কিছু মার্কসীয় ভাবধারার মূল বইয়ের অনুবাদ প্রকাশিত হয়। প্রথম আলোক বলেই হোক আর অনুবাদের ত্রুটির দরুণই হোক সাহিত্য প্রচার শম্বুক গতিতেই চলে। মার্কসীয় সাহিত্য আরও সহজ সরল ভাষায় লেখার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করলেও সে সময়ে উপযুক্ত লেখকের অভাব ছিলো খুবই। তার ওপর ছিল প্রকাশকের অভাব। আর কোন প্রকাশক এই সব বই ছাপাতে চাইতেন না, লাভের অভাবে এবং অনেকটা ভাল চোখে দেখতেন না বলেও। তারপর মিরাট ষড়যন্ত্র মামলার এবং আমার গ্রেপ্তারের পর যে দু’চার খানা বই বার হত তাও বন্ধ হয়ে যায়। এইভাবে ১৯৩৩ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ৩৭ খ্রিষ্টাব্দের শেষ পর্যন্ত কাটে। ১৯৩০ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ৩৭ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত নানা জেলে ও বন্দীশিবিরে আটক থাকার সময় অনেকেই মার্কসবাদীয় সাহিত্য ভালভাবে পড়ার সুযোগ সুবিধা পান — অনেকে এ দিকে আকৃষ্টও হন। রেবতীবাবু তাদের অগ্রণী। কারও ব্যক্তিগত প্রভাবে পূর্ব-মত পাল্টাবার লোক ছিলেন না রেবতীবাবু। বেশ ভালভাবে পড়াশুনা করেই তিনি মার্কসবাদ মনে প্রাণে গ্রহণ করেন। ১৯২৯ খ্রিষ্টাব্দে রেবতীবাবু তাঁর প্রথম গ্রন্থ ‘তরুণ রুশ’ লেখেন। রুশ সাহিত্য ও সমাজ সম্বন্ধে এমন গ্রন্থ তখন একখানাও বার হয়নি, বাংলায় কেন সমগ্র ভারতেও না। কিন্তু এই গ্রন্থে মার্কসবাদ গ্রহণের কোন সূচনা না থাকলেও রুশ সাহিত্যে তার অগাধ জ্ঞানের পরিচয় পাওয়া যায়।’
১৯৩০ খ্রিষ্টাব্দে রেবতীবর্মণ আবারও গ্রেপ্তার হন। এবার টানা ১৯৩৭ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত জেলে ছিলেন। জেলে যাওয়ার আগে থেকেই মার্কসবাদের প্রতি আসক্তি তৈরি হয়েছিল রেবতীবর্মণের। গোপন বিপ্লবী দলের কার্যকলাপের পাশাপাশি গভীরভাবে এই মতবাদ নিয়ে তিনি চর্চা করেছেন। কিন্তু জেলে ঢোকার পরে এই মতাদর্শের বিভিন্ন দিক, বিশেষ করে দর্শন, অর্থনীতি ও রাজনীতিকে আরও গভীরভাবে উপলব্ধি করার যথেষ্ট সুযোগ ঘটেছিলো এবং তা তিনি অত্যন্ত সুচারুভাবে কাজে লাগিয়েছেন। জেলের ভেতরে থাকা দীর্ঘ এই সময়ে কঠোর পরিশ্রমে করায়ত্ত করেছিলেন মার্কসবাদ। মার্কসবাদী মতাদর্শকে গভীরভাবে উপলব্ধির জন্য তিনি সমাজতত্ত্ব এবং সামাজিক নৃতত্ত্ব (মানুষের উৎপত্তি ও বিকাশ-সম্বন্ধীয় বিজ্ঞান) নিয়ে চর্চা করেন। এবং এসব বিষয় সংশ্লিষ্ট অসংখ্য বইপত্র তিনি বিভিন্ন মাধ্যমে লন্ডন থেকে সংগ্রহ করতেন। শুধু তাই নয় তিনি লন্ডনের বড়ো বড়ো প্রকাশনা সংস্থার বইয়ের তালিকা আনিয়ে সেখান থেকে সংশ্লিষ্ট বিষয়ের বই দেউলিক্যাম্পে পার্সেলে আনাবার ব্যবস্থা করেছেন। এরমধ্য দিয়ে লেখক ও মার্কসবাদী তাত্ত্বিক রেবতী বর্মণের পাঠের প্রতি তীব্র আগ্রহের বিষয়টি সামনে আসে। 
বাংলায় মার্কসবাদ চর্চার অন্যতম পথিকৃৎ, অত্যন্ত মেধাবী, মানবপ্রেমী রেবতীমোহন বর্মণ খুবই স্বল্প সময় বেঁচে ছিলেন। মাত্র ৪৭ বছর বয়সে  ১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দের ৬ মে আগরতলায় মারা যান তিনি। এর মধ্যে প্রায় একযুগ ভুগেছেন কুষ্ঠ রোগে। তিনি ব্যাধির কাছে পরাজয় মেনে নেননি। জীবনের পুরো সময় তিনি নিজেকে নিয়োজিত রেখেছেন মানব মুক্তির লড়াইয়ে। আজ প্রয়াণের দিনে তাঁর স্মৃতির প্রতি অতল শ্রদ্ধা।

লেখক : সম্পাদক- ‘এবং বই ও রিভার বাংলা’

জনপ্রিয়