ঢাকা শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪ , ৬ বৈশাখ ১৪৩১ আর্কাইভস ই পেপার

nogod
nogod
bkash
bkash
uttoron
uttoron
Rocket
Rocket
nogod
nogod
bkash
bkash

বিকল্প সম্পাদকীয়

শিক্ষা

আমাদের বার্তা প্রতিবেদক

প্রকাশিত: ২১:০১, ১১ মার্চ ২০২৩

সর্বশেষ

বিকল্প সম্পাদকীয়

দিন পেরিয়ে মাস।

মাসের পর মাস।

তারপর একে একে বারো বছর।

যুগপূর্তির সন্ধিক্ষণ পেরিয়ে এখন তেরো তে পা।

নানা চড়াই-উতরাই, বাধা-বিপত্তি, প্রতিকূলতা আর প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে এখন অনেকটাই পরিণত দৈনিক শিক্ষাডটকম। বিষয়বস্তু আর কলেবরে সমৃদ্ধ। অগণিত পাঠকের ভালোবাসায় ঋদ্ধ।

এই ফেলে আসা একযুগের গল্প কোনো মহাকাব্যের চেয়ে নিশ্চয়ই কম হবে না। তাই এই স্বল্প পরিসরে সেই ফিরিশতি নাইবা গাইলাম। কিন্তু প্রসবকালীন বিড়ম্বনার বেদনা একটু না বিলালেই যে নয়। তাই প্রায় আড়াই যুগ আগের ধুলো ঝেড়ে কয়েকটা পাতা উল্টাতেই হচ্ছে।

কিন্তু, কেনো এই পুরনো কাসুন্দি? যুগপূর্তির গল্প বলতে এসে আরো বাড়তি দেড় যুগকে ধরে টান দিতে হচ্ছে কেনো?

কারণ, বয়স সবে এক যুগ পেরুলেও দৈনিক শিক্ষাডটকম এর প্রেক্ষাপট ওই আড়াই যুগ আগেই রচিত হতে শুরু করে। মন ও মগজের ভেতরে দেড় যুগ ধরে বড় হতে থাকে বিকল্প পত্রিকার ভ্রুণ। তাই প্রথম দেড়যুগকে আমরা গর্ভকালীন সময় বলতে পারি। আর পরের একযুগকে ভূমিষ্ঠ পরবর্তী বয়স।

বিষয়টা তাহলে আর একটু খোলাসা করা যাক।

আসল খবরটা পেতে হলে ‘বিকল্প পত্রিকা’র বিকল্প নেই। মনীষী লেখক ও দার্শনিক আহমদ ছফার মুখে প্রথম এমন কথা শুনতে পাই। বিভিন্ন শিল্প গ্রুপের অর্থায়নে ১৯৯২ থেকে ১৯৯৯ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে বেশ কয়েকটি বাংলা ও ইংরেজি জাতীয় পত্রিকা প্রকাশ হয়। কিন্তু ওই সময়ের মধ্যেই আহমদ ছফার মুখে বার বার একই কথা শুনি, বিকল্প পত্রিকা করতে হবে। একপেশে, শুধু উঁচুতলার, কায়েমি স্বার্থবাদী খবর পরিবেশন নয়, জনগণকে আসল খবরটা জানাতে হবে। আর সেটা কোনো শিল্প-বাণিজ্য গ্রুপের অর্থায়নের পত্রিকা দিয়ে সম্ভব নয়। তাদের নানা স্বার্থ থাকে। তাই হামেশাই বলি হয় আসল খবর। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের একমাত্র পথ তাই ‘বিকল্প পত্রিকা’।

তাহলে আহমদ ছফার কল্পিত বিকল্প পত্রিকা কেমন? সেই পত্রিকার রূপরেখা কী? কৌতুহলী কৈশোর থেকে আমাদের মন-মেধা-মননে-মগজে-মর্মে গেঁথে আছে ইংরেজি দৈনিক বাংলাদেশ অবজারভার, ইত্তেফাক, সংবাদ ও দৈনিক বাংলা পত্রিকার নাম। সুতরাং ছফা ভাইয়ের বিকল্প পত্রিকা কেমন তা নিয়ে কোনো কল্পনাও করতে পারি না। শুধু শুনে যাচ্ছি।

হঠাৎ একদিন শাহবাগ আজিজ মার্কেটে ছফা ভাইয়ের আড্ডাখানায় পীযুষ বন্দোপাধ্যায়, নাট্যকার মামুনুর রশীদ, বাংলাদেশের প্রথম জাতীয় পতাকার মূল নকশাকার শিব নারায়ণ দাশ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক (বই প্রকাশ করে জঙ্গিদের হাতে খুন হওয়া দীপনের বাবা), তারেক মাসুদ ও ক্যাথরিন মাসুদসহ কয়েকজন গুণী মানুষ। তাদের সামনে ছফা ভাই তার বিকল্প পত্রিকার রূপরেখা বয়ান করে যাচ্ছেন। বলছেন- রাজ্জাক স্যার, ড. আনিসুজ্জামান, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, আহমদ শরীফসহ আরো কয়েকজনের কাছ থেকে প্রতিটি পত্রিকার দাম আদায় করা হবে ১০০ টাকা করে! আর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস, শাহবাগ, প্রেসক্লাবসহ কয়েকটি জায়গায় পত্রিকাটি ফ্রি বিতরণ করতে হবে। অবৈতনিক সম্পাদক থাকবেন ছফা ভাই নিজে, আর উপরিল্লিখিত গুণীজনসহ আরো কয়েকজন বিনা পয়সায় লিখে যাবেন। আমরা যারা ছফা ভাইয়ের তস্য জুনিয়র ভক্ত, তারা ওই পত্রিকার রিপোর্টার-কাম-হকার!  মোটা দাগে এটাই তার বিকল্প পত্রিকার পরিকল্পনা ও রূপরেখা!

ছফা ভাইয়ের পরিকল্পনা আপাত কঠিন হলেও পুরো আলোচনা আমাকে একটা জিনিস বুঝতে দারুণভাবে সহায়তা করে। অনেক সহপাঠী-সহকর্মীর চেয়ে ঢের আগে বুঝে ফেলি, শিল্প গ্রুপ প্রতিষ্ঠিত পত্রিকায় সাংবাদিকতার পরিবর্তে সাংবাদিক পদে চাকরি করে ‘কম্প্রোমাইজ ইজ দ্য আর্ট অব নিউজরুম’ তত্ত্ব ধারণ ও বাস্তবায়নে নিরত থেকেই বসুমতি থেকে বিদায় নেয়ার সম্ভাবনা সমধিক। বিষয়টি ক্রমেই আশঙ্কায় পরিণত হতে থাকে।

রাষ্ট্র-সমাজে একেকটি বড় ঘটনা ঘটে আর তার প্রকৃত প্রতিফলন মূলধারার পত্রিকাগুলোতে থাকে উপেক্ষিত, কিছু ক্ষেত্রে বিকৃত। ছফা ভাইও বছরের পর বছর তার বিকল্প পত্রিকার আলোচনা চালিয়ে যেতে থাকেন।

এর মধ্যে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও শিক্ষা ভবনে আমার টুকটাক যাতায়াত শুরু। অবসরপ্রাপ্ত সিএসপি এ এসএইচকে সাদেক সাহেব তখন শিক্ষামন্ত্রী। প্রশাসক হিসেবে তার ঢের সুনাম। কিন্তু নিজ চোখে দেখলাম, শিক্ষা প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ পদে পদায়নের জন্য বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারের কয়েকজন অধ্যাপক খুঁজছেন। শিক্ষা অধিদপ্তরের একজন কর্মচারী নেতার কাছ থেকে তিনি কয়েকটা নাম নিয়ে তাদের সম্পর্কে মন্ত্রণালয়ের স্থায়ী কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কাছ থেকে তথ্য যাচাই করছেন। 

২০০১ খ্রিষ্টাব্দের শুরুর দিকে শিক্ষা অধিদপ্তর থেকে একটা গুরুত্বপূর্ণ নথির তথ্য পাই। বিস্তারিত ব্যাখ্যাও জেনে নিই সংশ্লিষ্টদের কাছ থেকে। দেশ কাঁপানো রিপোর্ট হবে। এরই মধ্যে একজন সিনিয়র সাংবাদিক আমাকে বললেন, এ বিষয়টা নিয়ে রিপোর্ট করার দরকার নেই। অভিযুক্তরা খুব পাওয়ারফুল।

এর মধ্যে একজন বেসরকারি শিক্ষক নেতা জানতে চাইলেন, আমার পাসপোর্ট আছে কি-না। কয়েকজন সাংবাদিককে তিনি তার খরচে বিদেশে নিয়ে যাবেন। কয়েকজন গেছেনও ইতোমধ্যে। দেখলাম, সেই শিক্ষক নেতা মন্ত্রণালয় ও সাংবাদিকদের কাছ থেকে তথ্য নিয়ে সাধারণ শিক্ষকদের কাছে হয় ভুলভাবে উপস্থাপন করেন, নয়তো নিজের স্বার্থে তথ্যটাই চেপে যান।

এভাবে অনেক সম্ভাবনা পরিণত হয় আষাঢ়ের তর্জন গর্জন সারে। এক্সক্লুসিভ রিপোর্ট বিনষ্ট হয় অঙ্কুরেই। 

এই সময়ে শিক্ষার গুরুত্বপূর্ণ অফিসগুলো ঘুরে ঘুরে আরো কয়েকটি বিষয় নিজ চোখে দেখলাম। শিক্ষক ও শিক্ষার্থী সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়/ অধিদপ্তরের/ বোর্ডের একটা  আদেশ/প্রজ্ঞাপনের কপি নিয়ে কতিপয় কর্মকর্তা-কর্মচারী ও দালালের বাণিজ্য। একজন শিক্ষকের একটা বদলি/পদোন্নতির আদেশ পেতে ভুরুঙ্গামারী থেকে শিক্ষা অধিদপ্তরে আসতে হতো। শুধু আসাই নয়, ওই সময়ের সেরা একটা নোটও দিতে হতো। শুধু দেয়াই নয়, মনে হতো, অধিদপ্তরের কর্মকর্তার/কর্মচারীর পিতামহের সিন্দুকে বহু বছরের জমা করা কোনো সোনাদানার এক টুকরা দান করে দিলেন। দেখলাম, কোনো কোনো আদেশ সংশ্লিষ্ট শিক্ষক বা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সময়মতো না পৌঁছানোর ফলে কারো কারো চিরজীবনের মতো ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু, কর্তাদের তাতে কোনো ভ্রুক্ষেপই নেই।

এছাড়া জাতীয় দৈনিক পত্রিকাগুলোতে রিপোর্ট লিখতে শব্দ সংখ্যার দিকেও খেয়াল রাখতে হয়। আবার দেখলাম, ঢাকার স্কুল-কলেজের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের কাছে সরকারের যেসব নতুন সিদ্ধান্তের তথ্য খুব ভালো করে জানা, সেগুলোই মফস্বলের শিক্ষক-শিক্ষার্থী হয় জানেন না, না হয় অস্পষ্টতা রয়েছে। ফলে তারা পাবলিক পরীক্ষায় কাঙ্খিত নম্বর থেকে বঞ্চিত হওয়ার মতো ঘটনা ঘটছে। 

২০০২ খ্রিষ্টাব্দের কথা। আরো কয়েকটি প্রতিষ্ঠিত ইংরেজি দৈনিকে চাকরির সুযোগ থাকা সত্ত্বেও যোগদান করলাম বড় শিল্পগ্রুপ এসিআই প্রতিষ্ঠিত ইংরেজি পত্রিকা দি বাংলাদেশ টুডে-তে। সিনিয়র সাংবাদিকরা বললেন, বাংলাদেশ অবজারভার ও ডেইলি স্টারের চেয়ে এই পত্রিকা অনেক ভালো করবে। স্বাধীনভাবে লেখা যাবে। সাবেক সিএসপি আসাফ-উদ্দৌলাহ পত্রিকাটির দায়িত্বে।

দরকারের চেয়ে অনেক বেশি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তির অভিযোগ ছিলো কিছুদিন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থাকা ব্যারিস্টার জমির উদ্দীনের বিরুদ্ধে। ২০০২-এ তিনি জাতীয় সংসদের স্পিকার। সংসদ ভবনে কয়েকশ লোক নিয়োগ দিয়েছেন তার নির্বাচনী এলাকা থেকে। বিস্তারিত তথ্য পেয়ে আমি একটা রিপোর্ট জমা দিলাম। বার্তা সম্পাদক আবদুলাøহ ভাই কড়া শিরোনাম দিলেন। লিড হবে বলে আমাকে ইঙ্গিত দিলেন। বিকেলে সম্পাদকের কক্ষ থেকে ফিরে এসে দেখলাম, তার সেই উচ্ছ্বাস নেই। পরদিন ছাপা হলো : All from his constituency! এই শিরোনামে। প্রথম পাতায় সিঙ্গেল কলাম। এমন ‘ম্যান্তা’ শিরোনাম ও ট্রিটমেন্ট দেখে মনটা খারাপ হয়ে গেলো। আহমদ ছফার বিকল্প পত্রিকার ধারণাটা মনের আরো গভীরে গেঁথে গেলো। কিছুদিন পরে নতুন প্রকাশিত ইংরেজি দৈনিক নিউ এইজে চলে গেলাম। পত্রিকাটির তৎকালীন উপসম্পাদক নূরুল কবীর ভাই বললেন, তারা শিক্ষা বিষয়ে খুব গুরুত্ব দেবেন। হলোও তাই।        

ছফা ভাইয়ের বিকল্প পত্রিকার আলোচনার বছরগুলোতে জানলাম, ইন্টারনেটে পত্রিকা পড়া যায়। ঢাকা থেকে প্রকাশিত একটা পত্রিকার লোগোর ওপরে লেখা থাকতো, দেশের একমাত্র পত্রিকা যেটা ইন্টারনেটে পড়া যায়। আহমদ ছফার বন্ধু ও বিখ্যাত সাংবাদিক ইত্তেফাকের চিফ রিপোর্টার নাজিমউদ্দীন মোস্তান ভাইয়ের লেখা ও ব্যক্তিগতভাবে তার কাছ থেকে জানতে পারলাম, সামনে দিন আসছে। যখন কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা খরচ করে সংবাদপত্র ছাপতে হবে না। ইউরোপ-আমেরিকার মতো আমাদের দেশেও সবকিছু ইন্টারনেটে পাওয়া যাবে। তখন আমরাও না ছেপেও পত্রিকা করতে পারবো।

এদিকে ২০০৩ থেকে ২০০৮ সময়ের মধ্যে টাকার বিনিময়ে জিপিএ ফাইভ কেনাবেচার হিড়িক শুরু হলো। আন্তর্জাতিক শিক্ষা মাফিয়া চক্র বাংলাদেশে জেঁকে বসলো। রয়েল রোডস, ক্যামরিয়ানসহ কয়েকটি মাফিয়া প্রতিষ্ঠান ঢাকায় অবৈধভাবে বিদেশী বিশ্ববিদ্যালয়ের শাখা খুললো। স্কুল-কলেজও খুললো। অল্প কয়েকদিনের মধ্যেই তারা নানা কৌশল অপকৌশলে তারা শিক্ষা ব্যবসা জমিয়ে তুললো।  ভুঁইফোঁড় স্কুল-কলেজগুলো চার/পাঁচ লাখ টাকায় প্রতিটি জিপিএ ফাইভ কিনে ফলাফলে তাক লাগিয়ে দিলো। বড় বড় মিডিয়াতে পাঠালো চটকদার বিজ্ঞাপন। সেসব বিজ্ঞাপনে ভর্তি হলেই জিপিএ ফাইভ পাওয়ার গ্যারান্টি। আর ওই বিজ্ঞাপনের লোভে শিক্ষা বিষয়ক রিপোর্টিংয়ের নীতি-নৈতিকতা বিসর্জন দিলো কোনো কোনো মিডিয়া। হঠাৎ অনেক জিপিএ ফাইভ পেলে পরের বছর বেশিরভাগ অভিভাবকরা হুমড়ি খেয়ে পড়েন ওইসব স্কুল-কলেজে সন্তানদের ভর্তি করাতে। ৫০ লাখ টাকায় কয়েকটা জিপিএ ফাইভ কিনে নতুন শিক্ষাবর্ষে ভর্তির এক সিজনেই তিন/চার কোটি টাকা লাভ। দারুন শিক্ষা ব্যবসা! 

চোখের সামনে অনেক ঘটনা ঘটতে থাকলো। গুরুত্বপূর্ণ নথিতে সব পকেট উপচে পড়ে। কিন্তু, অনেক কিছুই লিখতে পারিনি। লিখলেও ছাপা হয়নি।  

২০০৬ এর শেষ দিকে খোঁজ-খবর নিতে থাকি অনলাইন পত্রিকার ডোমেইন নিবন্ধনের। এজন্য ডলার দরকার। কিন্তু, আমার পাসপোর্ট নেই, ডলারযুক্ত ক্রেডিট/ডেবিট কার্ডও নেই। সময় গড়িয়ে যায়। ২০০৮-২০০৯ সময়ে শিক্ষাবিটের সিনিয়র, জুনিয়র ও সমবয়সী কয়েকজনের সাথে আলোচনা করি, এমন কিছু করতে চাই। যুক্ত করার মানসিকতা নিয়ে তাদেরকেও আহ্বান জানাই।

সবাই আইডিয়াটা পছন্দ করলেন। সঙ্গে থাকবেনও জানালেন। কিন্তু কেউ সময়ও দেন না, টাকাও দেন না, মিটিংয়েও আসেন না। বছর মাস পেরিয়ে যায়, কোনো খবর নেই। বুঝলাম, মেধা খাটিয়ে, ঝুঁকি নিয়ে নতুন লোগো বানানোর চাইতে অন্যের বানানো লোগো বহনই তাদের পছন্দ।    

তবে এই অভিজ্ঞতা হতোদ্যম করতে পারলো না।                   

লড়াইটা একা শুরু করতে হয়। এমন কথা নাজিম উদ্দীন মোস্তান ভাইয়ের লেখায় পড়েছি। তার মুখেও শুনতাম। একাই ‘সাপ্তাহিক রাষ্ট্র’ শুরু করেছিলেন মোস্তান।

‘মানুষের ব্যক্তিগত উদ্যোগ মরে মরে সভ্যতা তৈরি হয়’। ছফা ভাইয়ের কাছে একাধিকবার শুনেছি এমন কথা।

আমি দূঢ় সংকল্পবদ্ধ। ডোমেইন রেজিস্ট্রেশন করে সাইট বানিয়ে শুরু করবো একাই। তখন দেশে মোট শিক্ষার্থীই প্রায় দুই কোটি। দশ লাখের মতো শিক্ষক-কর্মচারী। তাদের জন্য একটা পত্রিকা হওয়া উচিত। আমার নিজের টাকা নেই। শিল্পপতির কাছেও যাবো না। একাই শুরু করি শিক্ষা বিষয়ক অনলাইন পত্রিকা। এটা দেশের বিষয়ভিত্তিক অনলাইন পত্রিকা হিসেবেও প্রথম।

নিউ এইজের মুনীর হুসেইন ভাই ডোমেইন নিবন্ধনসহ সব বিষয়ে সহযোগিতা করলেন। একাধিক ডোমেইন নিয়েছি। প্রথমে ডেইলি এডুকেশন নামটি নিয়ে শুরু করলাম। কিন্তু উচ্চারণ কমিউনিকেটিভ লাগলো না পাঠকের কাছে। তাই সহজ নাম ‘দৈনিক শিক্ষাডটকম’-এ বদলি করালাম। পাঠক এটাকে দৈনিক শিক্ষা নামে ডাকা শুরু করলেন।

সময় গড়াতে লাগলো।  নিউ এইজ ও ইন্ডিপেন্ডেন্টে চাকরির পাশাপাশি গেরিলা পদ্ধতিতে ‘দৈনিক শিক্ষাডটকম’ চালাচ্ছি। ছদ্ম নামে, ছদ্ম ধামে। শুরুতে একদিন শিক্ষাবিদ ড. জাফর ইকবাল স্যারের কাছে যাই। স্যারকে জানাই। শিক্ষাখাত সংস্কারের বহু বিষয়ে স্যারের সঙ্গে বহু বছর ধরে একমত আমি। জাতীয় পত্রিকাগুলো শিক্ষা পাতায় নোট-গাইড ছাপে। আমরা এর বিপক্ষে। স্যার জানালেন, আমার উদ্যোগের সঙ্গে তিনি আছেন। তবে, একটা শর্ত সব সময়েই মানতে হবে। সেটা হলো- অন্যান্য জাতীয় পত্রিকার মতো নোট-গাইড প্রকাশ করা যাবে না। এই শর্তে স্যার শুভেচ্ছা জানিয়ে দুকলম লিখে দিলেন। বহুদিন সেটাকে স্ক্যান করে পত্রিকার লোগোর পাশে ঝুলিয়ে রেখেছিলাম। স্যারের প্রতি অশেষ ঋণ ও কৃতজ্ঞতা। 

আরও অনেকে এগিয়ে এলেন সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিলেন। দুর্বার গতিতে এগিয়ে চললো দৈনিক শিক্ষাডটকম। দিনে দিনে পেশাগত ঈর্ষা তুঙ্গে উঠলো। পরশ্রীকাতর জাতি হিসেবে আমাদের নাম বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছিলো বহুযুগ আগেই। উদ্যোক্তা হয়ে প্রচুর হুমকি, অবজ্ঞা, হামলা-মামলার মাধ্যমে সেই নামের কিছুটা উপলব্ধি করলাম হাড়ে হাড়ে। প্রতিবেদন প্রকাশের দায়ে মামলা এবং গ্রেফতারও হলাম। এবার দেশের সীমা ছাড়িয়ে বিদেশেও পরিচিতি পেলো দৈনিক শিক্ষাডটকম।

তবে বিকল্প পত্রিকার শক্তিও দেখলাম। এক মানবতাবিরোধী অপরাধীর ফাঁসির সময়ে যখন হুট করে ফেসবুক বন্ধ থাকলো, মাথায় বাজ পড়লো প্রচলিত ধারার অনলাইনওয়ালাদের। পাঠক যেহেতু ফেসবুকে দেয়া লিংকে ক্লিক করে নিউজ পড়তে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে, তাই নিউজ সাইটগুলোতে মানুষ ঢুকলো হাতে গোণা। কিন্তু দৈনিক শিক্ষাডটকমের পাঠক একটুও কমলো না। তার মানে পাঠকরা এ সাইটে সরাসরিই ঢোকেন। পাঠকের এই প্রয়োজন ভালোবাসার ফল্গুধারা হয়ে আমাদের অনুপ্রাণিত করলো। 

চলার পথে কোথাও শিক্ষা সংশ্লিষ্ট পাঠকরা যখন আমার ও আমার সহকর্মীদের পরিচয় জানতে পারেন, তখন তাদের আবেগ ও প্রশংসার কাছে পরশ্রীকাতরতা প্রসুত বিষের কার্যকরিতা কর্পুরের মতো উবে যায়। কেউ কেউ আবেগে জড়িয়ে ধরেন। কেউ পায়ে হাত দিয়ে সম্মান করেন। কেউ বলেন, আপনি ও আপনাদের পত্রিকা টেকনাফ থেকে তেতুলিয়া- সব শিক্ষক-শিক্ষার্থী চেনেন। ইংরেজি পত্রিকায় রিপোর্ট লিখে সারা সপ্তাহেও একটা ধন্যবাদ বা প্রতিক্রিয়া পাওয়া যেতো না। কিন্তু দৈনিক শিক্ষার সঙ্গে আমাদের সংশ্লিষ্টতার তথ্য জানামাত্রই যেনো অতি আপন করে নেন উপকারভোগীরা। বিশেষ করে বঞ্চিত অবহেলিত শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা। কেউ কেউ বলেন, দৈনিক শিক্ষাডটকম বঞ্চিত শিক্ষকদের একমাত্র কন্ঠস্বর। 

আমাদের দেশের প্রচলিত পত্রিকাগুলোতে সরকারি প্রজ্ঞাপন/ আদেশের জিস্ট বা মেসেজ নিয়ে রিপোর্ট লেখার ঐতিহ্য। রিপোর্টের মধ্যে পুরো আদেশ বা স্মারক নং তুলে দেয়া নিম্নমানের বা কেরানি মার্কা সাংবাদিকতা হিসেবে দেখা হতো তখন। দৈনিক শিক্ষায় আমরা প্রতিবেদনের মূল মেসেজ লেখা ছাড়াও প্রজ্ঞাপন/আদেশ বা স্মারক হুবহু তুলে দেয়া শুরু করি। ফলে একটা আদেশের কপির জন্য মন্ত্রণালয় বা অধিদপ্তর বা বোর্ডের কাউকে কোনো টাকা দিতে হয় না। সময় ও টাকা নষ্ট করে অফিসে যেতে হয় না। দৈনিক শিক্ষা থেকে যে কেউ ডাউনলোড করে নিতে পারেন।   এতে শিক্ষক ও শিক্ষা সংশ্লিষ্টদের কি যে উপকার হয় তা তাদের সঙ্গে দেখা বা কথা হলে  বোঝা যায়। অবৈধ উপার্জন কমে যাওয়ায় যদিও এতে ক্ষুব্ধ হন কেউ কেউ। দৈনিক শিক্ষায় এমপিওর চেক ছাড়ের স্মারক নম্বর পেয়ে সাড়ে পাঁচ লাখ বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারী বিল তৈরি করে ব্যাংকে জমা দিতে পারেন।     

এভাবেই সব চলছিলো। বাড়ছিলো দৈনিক শিক্ষাডটকমের পাঠক। সেই সঙ্গে ভালোবাসাও। এরই মাঝে শুরু হলো করোনার মরণ কামড়। হঠাৎই বন্ধ-সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। কিন্তু শিক্ষা কার্যক্রম তো চালিয়ে যেতে হবে। জাতির পিতার কন্যা শেখ হাসিনার ডিজিটাল সরকারের দেয়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ডিজিটাল পাঠদান সরঞ্জাম রয়ে গেছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই। লকডাউনে ঘরে বসেই অনলাইনে পাঠদান করানোর সিদ্ধান্ত এলো সরকারের তরফে। কিন্তু শিক্ষকদের কারো হাতে একটা মাত্র ফোন। কারো একটা ট্যাব। কারো ল্যাপটপ। কিন্তু এগুলো দিয়ে কীভাবে ভার্চুয়াল পাঠদান করাবেন তা তাদের অধিকাংশেরই জানা নেই। সংশ্লিষ্টরা কুলকিনারা পেতে হিমশিম খাচ্ছেন। শিক্ষা উন্নতির নামে বছরের পর বছর বিদেশ থেকে কাঁড়ি কাঁড়ি ডলার এনে নিজেদের ভোগে খরচ করা শিক্ষার এনজিওগুলোও নীরব, নিষ্ক্রিয়। এমন পরিস্থিতিতে কেবল খবর শিকার করলেই চলতো। কোনো সংবাদ মাধ্যমকে সামাজিক দায়িত্ব পালনের দিব্যিও কেউ দেয়নি। কিন্তু নিজেদের দায়বদ্ধতা থেকে সক্রিয় হলো দৈনিক শিক্ষাডটকম। ঘরে বসেই শিক্ষকরা যাতে ভার্চুয়ালি পাঠদান করাতে পারেন সেই প্রশিক্ষণ দেয়ার উদ্যোগ নিলো। বঙ্গবন্ধু জাদুঘরের কিউরেটর ও সাবেক শিক্ষাসচিব এবং দৈনিক শিক্ষাডটকমের প্রধান উপদেষ্টা সম্পাদক মো. নজরুল ইসলাম খান রাজি করালেন তার দীর্ঘদিনের বন্ধু কোডার্স ট্রাস্ট এর আজিজ ভাইকে। তাকে ধন্যবাদ। শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনির প্রতিও অশেষ কৃতজ্ঞতা। ভার্চুয়াল ক্লাস নেয়ার ভার্চুয়াল প্রশিক্ষণ কার্যক্রম তিনি উদ্বোধন করলেন ভার্চুয়ালি। শিক্ষকরা আশার আলো দেখতে পেলেন। শিক্ষার্থীরা পেলেন পাঠপথের দিশা।

এমন অনেক আশার দিশা হওয়াই আমাদের লক্ষ্য। এ লক্ষ্য অর্জনে সহায়তাকারীর মিছিলটাও দিনে দিনে বেশ বড় হয়ে উঠেছে।

সাবেক শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ ভাইয়ের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাতেই হয়। সাবেক শিক্ষামন্ত্রী শেখ শহীদুল ইসলাম ভাইকে যখনই দৈনিক শিক্ষার টকশোতে তার মূল্যবান মতামত দেয়ার আমন্ত্রণ জানিয়েছি, তখনই তিনি রাজী হয়েছেন। দৈনিক শিক্ষার টকশোতে যুক্ত হয়েছেন ও হচ্ছেন সাবেক শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী আ ন ম এহছানুল হক মিলন ভাই। তার প্রতি কৃতজ্ঞতা।

সাবেক ও প্রয়াত শিক্ষাসচিব সৈয়দ আতাউর রহমানের প্রতি অনিশেষ ঋণ। প্রচুর নথির ফটোকপি করতে দিয়েছেন। ফলে প্রচুর নির্ভুল রিপোর্ট প্রকাশ করতে পেরেছি। যেটা নতুন একটা অনলাইন পত্রিকাকে জনপ্রিয় করতে অনেক ভূমিকা রেখেছে।

বর্তমানে পিএসসির চেয়ারম্যান মো: সোহরাব হোসাইনের প্রতি কৃতজ্ঞতা। একাধিক শিক্ষক নেতা ও শিক্ষা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি আমাকে জানিয়েছেন, শিক্ষাসচিব থাকাকালে তারা স্যারের সঙ্গে অফিসিয়াল কাজে সাক্ষাত করতে গিয়ে দেখেছেন, স্যার মনোযোগ দিয়ে তার ডেস্কটপ  ও ট্যাবে একটাই পত্রিকা পড়ছেন, সেটা দৈনিক শিক্ষাডটকম। সাবেক শিক্ষাসচিব মো. নজরুল ইসলাম খান, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক অধ্যাপক মো. নোমান-উর-রশীদসহ এমন অনেক বিশিষ্টজন আমাদের সাহস ও শক্তি যোগাচ্ছেন।

শিক্ষা মন্ত্রণালয়, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন, পাবলিক বিশ^বিদ্যালয়, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর, কারিগরি ও মাদরাসা শিক্ষা অধিদপ্তর, পাঠ্যপুস্তক বোডর্, মাদরাসা শিক্ষা বোর্ড, ঢাকা শিক্ষাবোর্ডে এবং মন্ত্রণালয় ও দপ্তরে কর্মরত অসংখ্য শুভাকাংখীকে ধন্যবাদ। অসংখ্য শিক্ষক সংগঠন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রধান ও  কর্মচারী ইউনিয়ন নেতাদের প্রতি নাম ধরে কৃতজ্ঞতা জানাতে পারছিনা।

কারো কাছে বিজ্ঞাপন চাওয়ার কথা চিন্তা করলেই প্রথমেই মাথায় আসে ছফা ভাইয়ের বিকল্প পত্রিকার কথা। তাই বিতর্কিত প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন চাই না, নিইও না। বিজ্ঞাপন খুজঁতে থাকি ব্যাংক-বিমাসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠানে যাদের সঙ্গে শিক্ষার স্বার্থসংশ্লিষ্টতা কম।

অশেষ কৃতজ্ঞতা বিকাশ, নগদ, সোনালী, অগ্রণী, ডাচবাংলা ব্যাংক ও প্রাইম ব্যাংকের প্রতি। উদ্ভাস-উন্মেষ, রেটিনা এবং সারাদেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রধান যারা নিয়োগ ও ভর্তি বিজ্ঞাপন দিয়ে আমাদেরকে অর্থনৈতিকভাবে সাহস ও উৎসাহ দিয়ে যাচ্ছেন সবাইকে সবসময়ই পাশে চাইবো।  

কৃতজ্ঞতার তালিকায় আরও কয়েকটি নাম না বললেই নয়। প্রথমজন আমার অকাল প্রয়াত অগ্রজ মিজানুর রহমান খান। দ্বিতীয়জন বাংলাদেশের অনলাইন সাংবাদিকতার জনক আলমগীর হোসেন। এই দুই প্রতিথযশা সাংবাদিক সবসময়ই সাহস ও শক্তি যুগিয়েছেন। আরো আছেন সাবেক জনপ্রশাসন সচিব ও বর্তমানে দুর্নীতি দমন কমিশনের কমিশনার  ড. মো. মোজাম্মেল হক খান, আইনজীবী খুরশীদ আলম খান এবং  রাজনীতিক ও লেখক মনোয়ারুল হকসহ আরো অনেকে।  

খুব কম বেতনে যারা দৈনিক শিক্ষায় সাংবাদিকতা করেছেন ও করছেন তাদেরকে ধন্যবাদ দিয়ে খাটো করবো না। সবার স্বত:স্ফূর্ত সহযোগিতায় দৈনিক শিক্ষাডটকম এখন যে কোনো চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সক্ষম। এরই মধ্যে সদস্য বেড়েছে পরিবারে। শিক্ষার খবর নিয়ে আমরা নিয়মিত প্রকাশ করে চলেছি দৈনিক আমাদের বার্তা। এটিই এখনও পর্যন্ত বাংলাদেশে শিক্ষা বিষয়ক একমাত্র জাতীয় দৈনিক। শিক্ষার উন্নয়ন নিয়ে আরো অগণিত আইডিয়া মাথায় ঘুরছে। আপনাদের সহযোগিতা অব্যাহত থাকলে সেগুলোও বাস্তবায়ন হবে আশা করি।

আমরা আছি।

আমরা থাকবো।

শিক্ষার সব কিছু নিয়ে।

জনপ্রিয়