বই এখনো বেঁচে আছে
বইয়ের জন্য সবচেয়ে বড় সুখবরটি হলো, এখনো বেঁচেবর্তে আছে বই। প্রযুক্তির জয়জয়কারের মধ্য দিয়ে পুস্তক লেখা বা প্রকাশনা ধ্বংস হয়ে যায়নি। বয়সে বাংলাদেশের চেয়ে সামান্য বড় হওয়া সত্ত্বেও ই-বুক এখনো কাগজের বইয়ের বাজারের পুরোটা কব্জা করতে পারেনি। বিশেষ করে বাংলা বইয়ের জগতে ই-বই এখনো তেমন কোনো গুরুত্বের বিষয়ই নয়।
এবার খারাপ খবরটি শুনি। হ্যাঁ, দিনে দিনে বইয়ের পাঠক কমছে। বইপোকা বা বুক-ওয়ার্ম শব্দটি বিরল হয়ে গেছে। গ্রন্থাগার, ঘরের কোণ বা নিজের ঘরে দিন-দুনিয়া ভুলে গ্রোগ্রাসে বই পড়ছে– না, তেমন দৃশ্য আজকাল দেখাই যায় না। দূরযাত্রায় বই হাতে একাগ্র পাঠক শেষ কবে দেখেছেন? এক বসায় বই শেষ করার কাহিনি আজও কি শুনতে পাওয়া যায়? সদ্য প্রকাশিত বই বাসায় আনার পর কে আগে পড়বে, তা নিয়ে কি আজও হুড়োহুড়ি হয়? কিংবা গত এক বছরে পাঠ্যবই বাদে ‘নাটক-নভেল’ কয়টি কিনেছেন? বা পড়েছেন? প্রিয়জন সবারই আছে। তাকে বই উপহার কে কে দিয়েছেন? অথবা প্রিয়জনরাও কি বই উপহার পাওয়ার জন্য ব্যাকুল হয়ে থাকেন?
এমন সমস্যাকে সুন্দর করে তুলে ধরেছেন ফিনান্সিয়াল টাইমসের কলাম লেখক এবং হানড্রেড নেমস অব ডার্কনেস এবং দ্য গার্ল হু এইট বুকস’এর লেখিকা নীলাঞ্জনা রায় । সম্প্রতি প্রকাশিত দৈনিকটির কলামে তিনি ব্যক্ত করেন, বই লেখা এবং প্রকাশনা আবারও জোরদার হয়ে ওঠা নিয়ে আশাবাদী আমি। পাশাপাশি অনেক লোকের মতো আমিও ঝলমলে উজ্জ্বল, সর্বব্যাপী ডিজিটাল জগৎ নিয়ে ঘেরাও হয়ে পড়েছি, মাঝে মাঝে আনন্দের জন্য পড়ার দিকে মন দিতে রীতিমত সংগ্রাম করতে হয়। এটি আধুনিক জীবনের অন্যতম কূটাভাস বা প্যারাডক্স। আমাদের ল্যাপটপ এবং স্মার্টফোন আজকাল নানা পাঠ্য বিষয়ে ভরপুর থাকার পরও আমরা প্রায়ই দেখতে পাই, আমাদের ভাণ্ডারে পড়ার সময় বাড়ন্ত। কিংবা নেই।
এ সমস্যা বিশদভাবে তুলে ধরেন ইউরোপীয় দুই শিক্ষাবিদ মিহা কোভাচ এবং আদ্রিয়ান ভ্যান ডের উইল। পর্দা প্রযুক্তি বা স্ক্রিন টেকনোলজি মানুষের পাঠ অভ্যাস কীভাবে বদলে দিয়েছে, সে সম্পর্কে প্রতিবেদন প্রকাশ করেন এই দুই শিক্ষাবিদ। সাক্ষরতা ইন্টারনেটে ব্যবহৃত পাঠ্যের পরিমাণ দিয়ে আংশিকভাবে পরিমাপ করা হয়। চারপাশে ইন্টারনেটে পাঠ্য বিষয়ের বিস্ফোরণ ঘটেছে বলেই বলে মনে হচ্ছে। খুদে বার্তা পাঠের ক্রমবর্ধমান প্রবণতার দিকে ইঙ্গিত করে এ প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘আমরা ছোট পাঠ্য বিষয়ের বিস্তার এবং দীর্ঘ পাঠ্য বিষয়ের স্থবিরতার যুগে বাস করছি।’
পড়ার আনন্দ বা আনন্দের জন্য পড়ার ধারণা ক্রমেই ডোডোপাখি হতে চলেছে। বিশেষ করে আজকের কিশোর বা তরুণদের তুলনায় শিশুদের ক্ষেত্রে এ অভ্যাস বিরল হয়ে উঠছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল অ্যাসেসমেন্ট অফ এডুকেশনাল প্রোগ্রেস বা নায়েপ ২০১৯ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ২০২০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত ৯ থেকে ১৩ বছর বয়সী শিশুদের ওপর একটি সমীক্ষা চালায়। এতে উঠে আসে, নয় বছর বয়সী শিশুদের মধ্যে মাত্র ৪২ শতাংশ এবং ১৩ বছরের মধ্যে মাত্র ১৭ শতাংশ প্রায় প্রতিদিনই আনন্দের জন্য পড়েন। এদিকে মার্চ মাসে যুক্তরাজ্যে প্রকাশিত ফারশোর সমীক্ষা থেকে জানতে পারি ‘মাত্র ২৫ শতাংশ শিশু বলেছে তারা স্কুলের কাজের বাইরে প্রতিদিন বা প্রায় প্রতিদিনই আনন্দের জন্য পড়ে।’
কম্পিউটার বা স্মার্টফোনের পর্দায় বই পাঠ এবং কাগজের বই পাঠ নিয়েও সমীক্ষা হয়েছে। ২০১৮ খ্রিষ্টাব্দে একটি যুগান্তকারী সমীক্ষা চালান পাবলো ডেলগাডো এবং ল্যাডিসলাও সালমেরন। তাদের এই সমীক্ষা ‘স্ক্রিন ইনফিরিওরিটি ইফেক্ট’ নামে পরিচিত। সমীক্ষায় দেখা গেছে, কম্পিউটারে পাঠ্য বিষয়ের পাঠকদের তুলনায় মুদ্রিত পাঠ্য বিষয়ের পড়ুয়ারা বেশি মনোযোগ দিতে পারেন। পড়তে বসলে উচাটন মনোভাবের শিকার তারা তুলনামূলক ভাবে কম হয়ে থাকেন। এ জাতীয় আরও অনেক সমীক্ষা এবং আমাদের নিজস্ব অভিজ্ঞতা থেকে জানি, পর্দায় পাঠ করার সময় আমরা চট করে কিছু অংশ বাদ দিয়ে যাই, কিন্তু বই পাঠের বেলায় আমাদের মন পাঠে অনেক বেশি নিবদ্ধ থাকে। অর্থাৎ মুদ্রিত পৃষ্ঠায় আমাদের মনোযোগ সহজে অনেক বেশি আটকে থাকে।
কিন্তু তারপরও এ কথা অতিশয় সত্য, ইচ্ছা করলেও আমাদের মধ্যে অনেকের পক্ষেই স্মার্টফোন বাদ দেয়া বা কম্পিউটারের পর্দা থেকে চোখ ফিরিয়ে নেয়া আদৌ সম্ভব হবে না। এ সমস্যা থেকে উৎরানোর পথ বাতলে দিয়েছেন ২০১৮ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত ‘রিডার, কাম হোম: দ্য রিডিং ব্রেইন ইন এ ডিজিটাল ওয়ার্ল্ড’ এর লেখক ড. মেরিয়্যান উলফ। তিনি তার এ পদ্ধতিকে বলেন ‘দ্বিসাক্ষরতা’ বা ‘বাইলিটারেসি।’ তিনি আমাদের বহু মাধ্যম থেকে তথ্য নেয়া এবং প্রয়োজনে কী করে মনোযোগ দেয়া যায়, তা রপ্ত করতে বলেন।
তবে পর্দা-পাঠকদের প্রতি মারমূর্তি হয়ে উঠেছেন মার্কিন লেখক জসুয়া কোহেন। ২০১৫ খ্রিষ্টাব্দে লেখা উপন্যাস ‘বুক অব নাম্বারস’-এ তিনি লেখেন, ‘আপনি যদি এটি পর্দায় বা স্ক্রিনে পড়ে থাকেন, তা হলে বিদায় হোন। আমি কেবল তখনই আপনার সাথে কথা বলব, যখন আপনি দুই হাতে আঁকড়ে ধরবেন।’
পর্দার এই জয়জয়কারের যুগে চট করে বইয়ে মন ফিরিয়ে আনা সহজ নয়। সুফলদায়ী জিনিসের মতোই এটা নিছক অভ্যাসের মাধ্যমে রপ্ত করার ব্যাপার। একটু সময় নিয়ে অভ্যাসটা রপ্ত করুন। দেখবেন, বইয়ের আনন্দ জগতে ফিরে এসেছেন। আর ছোটরা বড়দের দেখেই শেখে। আপনাকে দিনের পর দিন পড়তে দেখে বাড়ির ছোটমণিটাও বই হাতে বসতে শিখবে। সেও হারিয়ে যেতে শিখবে পাঠের আনন্দময় জগতে। তা হলে আসুন, আজ থেকেই শুরু হোক বইয়ের জগতে আনন্দের অন্বেষণে আমাদের বিচরণ।
লেখক : সৈয়দ মূসা রেজা সাংবাদিক ও আলোকচিত্রী।