ঢাকা শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪ , ৬ বৈশাখ ১৪৩১ আর্কাইভস ই পেপার

nogod
nogod
bkash
bkash
uttoron
uttoron
Rocket
Rocket
nogod
nogod
bkash
bkash

বাংলা সাহিত্যে রেনেসাঁর কবি 

মতামত

মাজহার মান্নান

প্রকাশিত: ০০:০০, ১৯ এপ্রিল ২০২৩

সর্বশেষ

বাংলা সাহিত্যে রেনেসাঁর কবি 

কবি কাজী নজরুল ইসলাম। বাংলা সাহিত্যকে বিশ্বজুড়ে নতুনভাবে পরিচিতি এনে দিয়েছিলেন।। বাংলা সাহিত্যের এই বিদ্রোহী কবি ১৮৯৯ খ্রিষ্টাব্দের ২৫ মে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন  শতাব্দীর অন্যতম প্রধান বাঙালি কবি, ঔপন্যাসিক, নাট্যকার, সঙ্গীতজ্ঞ, দার্শনিক, সাংবাদিক, সম্পাদক ও একজন রাজনীতিক । উন্নত চিন্তা ও চেতনায় সমৃদ্ধ এবং অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়ে কথা বলার কারণেই তিনি বিদ্রোহী। বিষয়টি সম্ভবত জন্মগত। ডাক নাম দুঃখী হলেও দুঃখ তাকে কখনো কষ্টের চাদরে ঢাকতে পারেনি। তিনি এসেছেন, দেখেছেন এবং জয় করেছেন। অনন্য উচ্চতায় তার প্রতিটি কবিতা। 
সামাজিক শোষণ ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের হাতিয়ার হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন তিনি। নজরুলের কবিতার চরণগুলি যেন এক একটি জ্বলন্ত স্ফুলিঙ্গ। শোষকের স্বরুপ উম্মোচনে নজরুলের কাব্য যেন আরো মূর্ত হয়ে ওঠে যখন তিনি বলেন, ‘যারা কেড়ে খায় তেত্রিশ কোটি মুখের গ্রাস, যেন লেখা হয় আমার রক্তে তাদের সর্বনাশ।’ তিনি শোষণ, নিপীড়ন ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার এক কলম সৈনিক। পক্ষ বলতে তিনি সত্যকেই বুঝতেন। সেই তিনি লিখলেন,  ‘ক্ষুধার জ্বালায় মরেছি, সুধার কলস থাকিতে ঘরে, দারিদ্র ঋণ অভাবে জ্বলেছি, না চিনে পরস্পরে।’  
সর্বদা ঔপনিবেশিকতার বিরুদ্ধে সোচ্চার। ‘আনন্দময়ীর আগমনে’ কবিতাটি লেখার অপরাধে তাকে কারাবরণ করতে হয়েছিল। কারাগারে থাকাকালীন রচনা করেন ‘রাজবন্দীর জবানবন্দী’ যা বিশ্বের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি সাহিত্যকর্মের একটি হিসেবে বিবেচিত। ‘আনন্দময়ীর আগমন’ গ্রন্থের কয়েকটি চরণ বৃট্রিশ শাসনের ভিতকে নাড়িয়ে দিয়েছিলো। কাব্য রূপে এমন প্রতিবাদ করা যায় সেটা তো নজরুলই আমাদের দেখালেন। তিনি লিখলেন, ‘আর কত কাল থাকবি বেটি মাটির ঢিবির মূর্তি আড়াল, স্বর্গ যে আজ জয় করেছে অত্যাচারী শক্তি চাড়াল, দেব শিশুদের মারছে চাবুক বীর যুবাদের দিচ্ছে ফাঁসি, ভূ ভারত আজ কসাইখানা আসবি সর্বনাশী।’ 
এই চরণগুলি ছিল উপনেবেশিক শোষনের মূলে কুঠারাঘাত। নজরুলের সাহিত্যকর্ম সাম্রাজ্যবাদ ও ঔপনিবেশিকতাকে ঘৃণাভরে প্রত্যাক্ষান করে। প্রেম, মানবতাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা, বিশ্বজনীনতা, মুক্তি ও বিদ্রোহকে করে আলিঙ্গন। তিনি ধর্মীয় গোঁড়ামি, কুসংস্কার এবং শ্রেণী বৈষম্যের বিরুদ্ধে কলম ধরেছেন। সাহিত্যে একটি নতুন ধারার জন্ম দেন। প্রায় তিন হাজার গান রচনা করেছেন এবং অধিকাংশ গানের সুরকার ছিলেন তিনি নিজেই। নজরুল এমন একজন কবি, যিনি মানব চরিত্রকে গভীরভাবে বুঝে তারসাহিত্যে প্রকাশ ঘটিয়েছেন। প্রকাশ ঘটাতে গিয়ে তিনি বলেছেন, ‘আমরা সবাই পাপী, আপন পাপের বাটখারা দিয়ে অন্যের পাপ মাপি।’
ভারত জুড়ে শুরু হওয়া অসহযোগ আন্দোলনের তিনি এক অগ্নিপুরুষ। এ সময় লেখা তার ‘বিদ্রোহী’ কবিতা সারা ভারতে অনুরণিত হয়েছিল। নজরুল ইসলাম ১৯২২ খ্রিষ্টাব্দে ধূমকেতু পত্রিকা প্রকাশ করেন। অসহযোগ ও খিলাফত আন্দোলন  এবং  স্বরাজ গঠনে ও সশস্ত্র বিপ্লবে ধূমকেতুর বিশেষ অবদান ছিল। ১৯১৭ খ্রিষ্টাব্দের রাশিয়ান সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব তাকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করে। কামাল পাশার দ্বারা নজরুলের চিন্তা ও অনুভূতি ব্যাপকভাবে প্রভাবিত হয়েছিল। গোঁড়ামি, রক্ষণশীলতা, ও কুসংস্কারের প্রতিবাদে নজরুলের কবিতা ছিল সর্বদা দিকদর্শী। বাংলা সাহিত্যে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের আগমন নায়কের মতো এবং তার কবিতা, গান, উপন্যাস, ছোটগল্প, নাটক বাংলা সাহিত্যকে নিয়ে গেছে অনন্য উচ্চতায়। নজরুলের সকল কর্ম আজও বাঙালি মুসলমানদের অনুপ্রাণিত করে চলেছে, এবং নজরুল তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ অগ্নিবীণার মাধ্যমে বাংলা সাহিত্যের প্রবাদ পুরুষ হয়ে উঠেছেন। 
কাজী নজরুল ইসলাম ছিলেন একজন মানবতাবাদী ও অসাম্প্রদায়িক কবি যার কবিতায় সব সময়ই অগ্নি কণ্ঠে উচ্চারিত হত দরিদ্রের কথা, শোষিতের কথা ও নিপীড়িতদের কথা। তিনি সব সময় শোষিত-বঞ্চিত মানুষের পক্ষে লিখেছেন, প্রতিবাদ করেছেন বলিষ্ঠ কণ্ঠে। বলেছেন,  ‘তোমরা থাকবে তেতলার পরে, আমরা থাকিবো নিচে, অথচ তোমায় দেবতা বলিব, সে কথা আজ মিছে।’ ইসলামী ঐতিহ্য ও মুসলিম সুফিবাদ তাঁর সাহিত্যে অনন্য স্থান দখল করে আছে। তাঁর কবিতায় আধ্যাত্মবাদ এবং ইসলামী সাম্যকে ধারণ করে, এবং তিনি সর্বদা মুসলমানদের জন্য অনুপ্রেরণার অন্যতম উৎস। তিনি লিখেছেন, ‘চরণ ফেলি গো মরণ ছন্দে, মথিয়া চলি গো প্রাণ, মর্তের মাটি মহীয়ান করি, স্বর্গেরে করি ম্লান।’ তাঁর গান ও কবিতা যুগ যুগ ধরে বাঙালির জীবন সংগ্রাম ও স্বাধীনতা সংগ্রামের অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে আছে। তিনি শোষিত জাতিকে শোষণ ও নিপীড়ন থেকে মুক্ত করতে লিখেছেন ‘বলো বীর, বল চির উন্নত মম শির’। 
কাজী নজরুল ইসলাম ছিলেন মানবতাবাদের কবি তাই তিনি সকল ধর্মের ভেদাভেদ ভুলে মানবতাবাদ ও সত্যের জয়গান গেয়েছেন।  ধর্মের বিভেদ শুধু হানাহানি ডেকে আনে। তাইতো কবি এর বিপক্ষে দাঁড়িয়ে বলেছেন, ‘গাহি সাম্যের গান, যেখানে আসিয়া এক হয়ে গেছে, সব বাধা ব্যবধান, যেখানে মিশেছে হিন্দু-বৌদ্ধ-মুসলিম-ক্রিশ্চান।’ তিনি তাঁর কবিতায় স্পষ্ট দেখিয়েছেন, মানুষের চেয়ে মহৎ আর কিছু নেই।  তার কবিতা দেশপ্রেম এবং জাতীয়তাবাদের চেতনার  ধারক-বাহক। কবিতায় ফুটে উঠেছে, ‘মুক্ত কণ্ঠে স্বাধীন বিশ্বে উঠিতেছে একতান, জয় নিপীড়িত প্রাণ, জয় নব অভিযান, জয় নব উত্থান।’  
তিনি ১৯১৭ খ্রিষ্টাব্দে করাচিতে যান। লড়াই করার ইচ্ছা থেকে যুদ্ধে যোগ দেন। প্রধান স্বপ্ন ছিল ভারতকে স্বাধীন করা। তিনি বিশ্বাস করতেন, সশস্ত্র আন্দোলনের মাধ্যমে ভারতকে স্বাধীন করার বিকল্প নেই। তিনি ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে সরাসরি সংগ্রাম শুরু করেন এবং প্রতিবাদী কবিতার একটি সিরিজ প্রকাশ করেন। জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে তার নেতৃস্থানীয় ভূমিকার জন্য বেশ কয়েকবার তাকে কারাবরণ করতে হয়। তার পর্যবেক্ষণে উপমহাদেশের কৃষকেরা সবচেয়ে বেশি শোষণের শিকার। জমিদারি প্রথার জাঁতাকলে পিষ্ট কৃষক না খেয়ে দিনতিপাত করছে। কৃষকের পক্ষে তিনি কলম ধরলেন। বললেন, ‘গাহি তাহাদের গান, ধরণীর হাতে দিলো যারা আনি ফসলের ফরমান।’  
সাম্প্রদায়িকতা, সাম্রাজ্যবাদ এবং ঔপনিবেশিকতা ও শোষণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছেন এবং কলম ধরেছেন।  তার কলমে উঠে এসেছে, ‘মহা মানবের মহা বেদনার আজি মহা উত্থান, উর্ধ্বে হাসিছে ভগবান, নিচে  কাঁপিতেছে শয়তান।’ তিনি কোনো ধরনের ধর্মীয় গোঁড়ামি ও অপব্যাখ্যায় বিশ্বাস করতেন না। ছিলেন অসাম্প্রদায়িকতার কবি। লেখায় ছিল বাংলার নবজাগরণের কথা। নজরুল গবেষক অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘ধূমকেতু’ পত্রিকা কংগ্রেসের সামনে ভারতের পূর্ণ স্বাধীনতা দাবি করে। মানুষের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক-সাংস্কৃতিক ও স্বাধীনতার কথা তার সাহিত্যচর্চার পুরোটাই জুড়ে। নজরুল অনুভব করেছিলেন যে সাহিত্য শুধুমাত্র অভিজাত বা শিক্ষিতদের জন্য হতে পারে না। এ সময় তিনি কমিউনিস্ট মতাদর্শে প্রভাবিত হয়ে স্বাধীনতার সাথে সামাজিক বিপ্লবের ধারণার মিশ্রণ ঘটিয়েছিলেন। ভারতে অসহযোগ আন্দোলনের সময় কবি নিয়মিত সাংবাদিকতা শুরু করেন এবং অন্যায়ের বিরুদ্ধে লিখতে থাকেন। নজরুল এমন একজন কবি ছিলেন যিনি কখনই অর্থ-সম্পদ,  বিত্ত-বৈভবের কাছে নিজেকে সঁপে দেন নি। কারো মোসাহেবী করেন নি। পয়েকটিক জাস্টিসে তিনি বিশ্বাস করতেন। চলনে-বলনে-শয়নে চাটুকারদের অবজ্ঞা করেছেন কবি। বলেছেন, ‘সাহেব কহেন, সেদিন বৃষ্টি ছিল অল্প, মোসাহেব কহেন, বাহ! কে বা শুনেছে এমন অপরূপ গল্প।’
নজরুল ইসলাম বাংলা সাহিত্য ও ভাষায় একটি নতুন ধারার সূচনা করেন। আরবি, ফারসি এবং অন্যান্য বিদেশি শব্দকে বাংলা ভাষায় সমন্বয় ঘটান। তিনি সাম্যের জয়গানের কথা শুনিয়েছেন। মানুষের সাথে মানুষের সমতার কথা বলেছেন। নারী পুরুষের সমতার কথা বলেছেন। তিনি লিখেছেন, ‘পুরুষ এনেছে দিবসের জ্বালা তপ্ত রৌদ্রদাহ, কামিনী এনেছে যামিনী শান্তি, সমীরন বারিবাহ।’ ভারতীয় ধ্রুপদী ও লোকসংগীতের মাঝে এক দুর্দান্ত সমন্বয় ঘটিয়েছিলেন এই কবি। তার মতো অসাম্প্রদায়িক চরিত্রের একজন হাজার বছরেও বাংলা সাহিত্যে আর দেখা যায়নি। তার লেখা কখনোই ধর্মীয়ভাবে পক্ষপাতদুষ্ট নয়, বরং হিন্দু ও মুসলিম ধর্মের ঐতিহ্যকে সমান্তরাল করেছে। তিনি লিখলেন, ‘তোমাতে রয়েছে সকল কেতাব, সকল কালের জ্ঞান, সকল শাস্ত্র খুঁজে পাবে সখা, খুলে দেখো নিজ প্রাণ।’ 
নজরুল ইসলাম বাঙালি মুসলমানের সঙ্গে বাংলা সাহিত্যের সম্পর্ককে আরও দৃঢ় করেছেন এবং তাঁর সাহিত্যকর্মের মাধ্যমে বাঙালি মুসলমানরা বাংলা সাহিত্যের মূলধারায় প্রবেশ করাতে সক্ষম হয়েছেন। তরুণ মনে সোজা হয়ে দাঁড়াবার শক্তি যুগিয়েছেন । যুব শক্তিকে অনুপ্রাণিত করতে তার কাব্য এক মহীরুহের ভূমিকা পালন করেছে। তার কলমেই রচিত হয়,‘ধ্বংস দেখে ভয় কেন তোর? প্রলয় নতুন সৃজন বেদন, আসছে নবীন জীবনহারা অসুন্দরের করতে ছেদন।’ নজরুল কাব্যের মূল বিষয় হলো মানুষ। তিনি মনে করতেন, মানুষের চেয়ে মহীয়ান জগতে কিছু নেই। মানুষের হৃদয়ের চেয়ে বড় কোন মন্দির বা কাবা নেই। নজরুল সাম্যবাদে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন। কবি লিখলেন, ‘সকল কালের সকল দেশের সকল মানুষ আসি/ এক মোহনায় দাঁড়াইয়া শোন এক মিলনের বাঁশি।’
মুসলিম নবজাগরণে নজরুলের অবদান ছিল সত্যিই অতুলনীয়। 'বিদ্রোহী' কবিতাটি ২২ বছর বয়সী কাজী নজরুল ইসলাম ১৯২১ খ্রিষ্টাব্দের ডিসেম্বরে লিখেছিলেন এবং আজ সেই কবিতার ১০০  বছর পূর্তি উদযাপিত হয়েছে।  তাঁর কাব্যশক্তির সর্বোত্তম প্রকাশ ঘটেছে এই কবিতায়। অসীম দক্ষতায় এই কবিতায় বিভিন্ন পুরাণের নির্যাস সৃজনশীলভাবে প্রয়োগের বিষয়টি প্রশংসনীয়। এই শতবর্ষী 'বিদ্রোহী' কবিতা যুগের পর যুগ শোষিত-বঞ্চিত মানুষের জন্য উৎস হিসেবে কাজ করবে। একজন যোদ্ধার, একজন বিদ্রোহীর মনের কথা ফুটে উঠলো নজরুলের বিদ্রোহী কবিতায়। ‘আমি মহাবিদ্রোহী রণক্লান্ত, আমি সেই দিন হব শান্ত, যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দল রোল আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না।’ নজরুলের সৃষ্টি একদিকে যেমন বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছে, তেমনি একই সঙ্গে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে মুক্তিসংগ্রামের অন্যতম হাতিয়ার হিসেবে কাজ করেছে। 
সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের বিরুদ্ধে নজরুলের অবস্থান ছিল অকুতোভয় বীরের মত। ১৯১৭ খ্রিষ্টাব্দে রুশ বিপ্লবকে তিনি স্বাগত জানিয়েছিলেন। তার রচনায় তার প্রতিফলনও দেখা যায়। ‘তোরা সব জয়ধ্বনি কর, তোরা সব জয়ধ্বনি কর/ ঐ নতুনের কেতন ওড়ে কাল বৈশাখীর ঝড়।’ নজরুল ইসলাম তাঁর লেখালেখি জীবনে অনেক নির্যাতন ও কারাবরণ সহ্য করেছেন, তবুও তিনি আশা ছাড়েননি। কেবলই এগিয়েছেন সামনের দিকে। শ্রমিক, দিনমজুর, কুলি, জেলেদের নিয়ে তিনি অনবদ্য কাব্য রচনা করেছেন। ‘দেখিনু সেদিন রেলে, কুলি বলে এক বাবুসাব তারে ঠেলে দিল নিচে ফেলে, চোখ ফেটে এলো জল, এমন করে কি জগত জুড়িয়া মার খাবে দুর্বল?’ 
কোন হুমকি বা নির্যাতন তাকে তার অবস্থান থেকে সরাতে পারেনি। কোন হুমকি বা অত্যাচার তাকে তার অবস্থান থেকে সরাতে পারেনি। লোভ লালসাকে তিনি ঘৃণা করতেন। লোভের কারণে মানুষের চরিত্র বদলে দানব হয়ে ওঠে। লোভের হাতছানিতে মানুষ হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে পড়ে। তিনি লেখেন, ‘বন্ধু, তোমার বুক ভরা লোভ, দু চোখে স্বার্থ ঠুলি, নতুবা দেখিতে তোমারে সেবিতে দেবতা হয়েছে কুলি।’ নজরুল বিশ্বাস করতেন শ্রমজীবিদের শ্রমের বিনিময়ে সভ্যতা গড়ে উঠেছে। নব নব সভ্যতার তারাই চালিকা শক্তি। শ্রেণি সংগ্রামে বিশ্বাস করতেন নজরুল। এক্ষেত্রে তিনি কার্ল মাকর্সের দর্শনে প্রভাবিত বলা যায়। সর্বহারাদের প্রতি কবির মমত্ববোধ প্রকট। শ্রমিকদের নিয়ে লিখতে গিয়ে তিনি বললেন, ‘সিক্ত যাদের সারা দেহ মন, মাটির মমতা রসে/ এই ধরণীর তরণীর হাল রবে তাহাদেরি বশে।’
কাজী নজরুল ইসলাম শুধু গতানুগতিক ধারায় কাব্য লিখে যান নি। তিনি কাব্যের ব্যাকরণ, ছন্দ, মাত্রা, লয়, অনুপ্রাস, অলঙ্করণ সব কিছু নিখুঁতভাবে অনুসরন করেছেন। মাত্রাবৃত্ত ছন্দে চরম মুন্সিয়ানা দেখিয়েছেন। যদিও মাত্রাবৃত্ত ছন্দের আবিস্কার করেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। কিন্তু এই ছন্দের বহুমাত্রিক ব্যবহারে পান্ডিত্য দেখান নজরুল। ৪+৪ মাত্রার মাক্রাবৃত্ত তার ‘আনোয়ার’ ও ‘মহররম’ কবিতা এই ছন্দের অনন্য দৃষ্টান্ত। এছাড়াও স্বরবৃত্ত ও অক্ষরবৃত্ত ছন্দে দারুন মুন্সিয়ানা দেখিয়েছেন তিনি। মুক্তক মাত্রাবৃত্ত ছন্দের প্রথম উদ্ভাবক তিনি। তার বিদ্রোহী কবিতাটি মুক্তক মাত্রাবৃত্ত ছন্দে রচিত। তার আগমনী কবিতা ৬ মাত্রার মুক্তক মাত্রাবৃত্ত। ধুমকেতু কবিতায় তিনি অক্ষরবৃত্ত ছন্দে পান্ডিত্য দেখিয়েছেন। ছান্দসিক কবি নজরুল ছন্দের তালে তালে শোষণের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলেছেন। পাঠক হৃদয় একদিকে যেমন  ছন্দে পুলকিত হয়েছে, অন্যদিকে তার ঝাঁঝালো শব্দচয়ন তাদেরকে অন্যায়ের বিরুদ্ধে অনুপ্রাণিত করেছে। এখানেই কবির অর্জন। বুকভরা সাহস নিয়ে  কবি লিখতে পারলেন, ‘হে দারিদ্র্য তুমি মোরে করেছো মহান, তুমি মোরে দানিয়াছো খ্রিষ্টের সম্মান।’ 

লেখক : কবি ও কলামিস্ট

জনপ্রিয়