বেক্সিমকো গ্রুপের তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর উদ্যোক্তা পরিচালকদের শেয়ার বিক্রি করে গ্রুপটির ব্যাংক ঋণের অর্থ পরিশোধের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। আবার বেক্সিমকোর বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের শ্রমিকদের বকেয়া বেতনভাতাও এ অর্থ থেকে পরিশোধের কথা ভাবা হচ্ছে। তবে পুঁজিবাজারের সর্বশেষ দর বিশ্লেষণে দেখা যায়, গ্রুপটির তালিকাভুক্ত তিন কোম্পানির উদ্যোক্তা পরিচালকদের কাছে থাকা শেয়ারের মূল্য সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকা। আর সরকার গঠিত এক উপদেষ্টা পরিষদ কমিটি জানিয়েছে, বেক্সিমকোর বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নামে-বেনামে নেয়া ব্যাংক ঋণের এখন পর্যন্ত নিশ্চিতকৃত পরিমাণ প্রায় ৭০ হাজার কোটি টাকা। আবার এ উদ্যোক্তা পরিচালকদের শেয়ার বিক্রি নিয়েও রয়েছে নানা ধরনের আইনি জটিলতা।
দেশের সরকারি-বেসরকারি ব্যাংক থেকে বিপুল অংকের ঋণ নিয়ে শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছে সালমান এফ রহমানের বেক্সিমকো গ্রুপ। অনেক ক্ষেত্রে ঋণ নেয়া হয়েছে প্রভাব খাটিয়ে প্রয়োজনীয় জামানত ছাড়াই। এমনকি বেক্সিমকো গ্রুপের তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর উদ্যোক্তা পরিচালক ও সহযোগী কোম্পানির কাছে থাকা শেয়ার বন্ধক রেখেও ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়া হয়েছে। বর্তমানে দেশের পুঁজিবাজারে বেক্সিমকো গ্রুপের তালিকাভুক্ত কোম্পানি তিনটি। এগুলো হলো বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড, বাংলাদেশ এক্সপোর্ট ইমপোর্ট কোম্পানি (বেক্সিমকো) লিমিটেড ও শাইনপুকুর সিরামিকস লিমিটেড।
ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) তথ্যানুসারে, বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালসের উদ্যোক্তা পরিচালকদের কাছে গত বছরের ডিসেম্বর শেষে কোম্পানিটির ৩০ দশমিক ১৩ শতাংশ বা ১৩ কোটি ৪৪ লাখ ১৩ হাজার ৫৭২টি শেয়ার ছিল। উদ্যোক্তা পরিচালকদের মধ্যে সালমান এফ রহমান, তার বড় ভাই এএসএফ (আহমেদ সোহেল ফসিউর) রহমান এবং অন্যান্য পরিচালক ও স্বার্থসংশ্লিষ্ট সহযোগী প্রতিষ্ঠান রয়েছে। স্বার্থসংশ্লিষ্ট সহযোগী প্রতিষ্ঠানগুলো হলো বেক্সিমকো হোল্ডিংস লিমিটেড, বেক্সিমকো লিমিটেড, নিউ ঢাকা ইন্ডাস্ট্রিজ, বেক্সিমকো ইঞ্জিনিয়ারিং এবং ন্যাশনাল ইনভেস্টমেন্ট ও ফাইন্যান্স কোম্পানি লিমিটেড। ডিএসইতে গতকাল বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালসের শেয়ারের দর ছিল ৭৫ টাকা ৬০ পয়সা। সে হিসেবে কোম্পানিটির উদ্যোক্তা পরিচালকদের কাছে থাকা শেয়ারের মূল্য দাঁড়ায় ১ হাজার ১৬ কোটি ১৬ লাখ ৬৬ হাজার ৭৪ টাকায়।
বেক্সিমকো লিমিটেডের উদ্যোক্তা পরিচালকদের কাছে গত বছরের ডিসেম্বর শেষে কোম্পানিটির ৩৩ দশমিক ১১ শতাংশ বা ৩১ কোটি ২৩ লাখ ৫ হাজার ৩৮৭টি শেয়ার ছিল। এর মধ্যে সালমান এফ রহমান ও এএসএফ রহমান ছাড়াও বেক্সিমকো হোল্ডিংস লিমিটেড, নিউ ঢাকা ইন্ডাস্ট্রিজ, বেক্সিমকো ইঞ্জিনিয়ারিং, ন্যাশনাল ইনভেস্টমেন্ট ও ফাইন্যান্স কোম্পানি লিমিটেড, এসেস এক্সপোর্টার্স লিমিটেড, বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালস, শাইনপুকুর সিরামিকস, এসকর্পস অ্যাপারেলস লিমিটেড, ফার্মাটেক কেমিক্যালস লিমিটেড, অ্যাবসলুট কনস্ট্রাকশন অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেড, এনটিসি এ/সি জিএইচএল এবং এনটিসি এ/সি এসএইএল রয়েছে। ডিএসইতে গতকাল কোম্পানিটির শেয়ারদর ছিল ১১০ টাকা ১০ পয়সা। সে হিসেবে বেক্সিমকো লিমিটেডের উদ্যোক্তা পরিচালকদের কাছে থাকা শেয়ারের মূল্য দাঁড়ায় ৩ হাজার ৪৩৮ কোটি ৪৮ লাখ ২৩ হাজার ১৪০ টাকা।
শাইনপুকুর সিরামিকসের উদ্যোক্তা পরিচালক হিসেবে বেক্সিমকো লিমিটেডের কাছে গত বছরের ডিসেম্বর শেষে কোম্পানিটির ৫০ শতাংশ বা ৭ কোটি ৩৪ লাখ ৮৩ হাজার ২৭টি শেয়ার ছিল। গতকাল ডিএসইতে কোম্পানিটির শেয়ারদর ছিল ১১ টাকা ৩০ পয়সা। সে হিসেবে কোম্পানিটির উদ্যোক্তা পরিচালকদের কাছে থাকা শেয়ারের মূল্য দাঁড়ায় ৮৩ কোটি ৩ লাখ ৫৮ হাজার ২১০ টাকা। সব মিলিয়ে বেক্সিমকো গ্রুপের তালিকাভুক্ত তিন কোম্পানির উদ্যোক্তা পরিচালকদের কাছে থাকা শেয়ারের মোট মূল্য ৪ হাজার ৫৩৭ কোটি ৬৮ লাখ ৪৭ হাজার ৪২৪ টাকা। বেক্সিমকো গ্রুপের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, তালিকাভুক্ত তিন কোম্পানির উদ্যোক্তা পরিচালকদের সব শেয়ারই বন্ধক রেখে ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়া হয়েছে।
গত বছরের ১৫ ডিসেম্বর উচ্চ আদালতে এক রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে রুলের শুনানিতে অংশ নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের আইনজীবী মুনীরুজ্জামান আদালতকে জানিয়েছিলেন, ২০২৪ সালের ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত বেক্সিমকো গ্রুপের মোট ঋণের মধ্যে ৩১ হাজার ৭৫ কোটি টাকা এরই মধ্যে শ্রেণীকৃত (খেলাপি) হয়ে গেছে। বেক্সিমকো গ্রুপের কোম্পানি সংখ্যা ১৮৮। এর মধ্যে ৭৮টি কোম্পানির নামে বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ নেয়ার তথ্য পাওয়া গেছে। এসব কোম্পানির কয়েকটি আবার আদতে ‘শেল কোম্পানি’, যা গঠন করা হয়েছে জনগণের অর্থ লুণ্ঠনের জন্য। ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, বেক্সিমকো গ্রুপের ঋণের স্থিতি ৫০ হাজার ৯৮ কোটি টাকা। এছাড়া গ্রুপটি রাষ্ট্রায়ত্ত জনতা ব্যাংকের মাধ্যমে রফতানি করা ৫ হাজার ৮২৮ কোটি টাকা মূল্যের পণ্যের অর্থ দেশে আনেনি।
তবে সম্প্রতি সরকার গঠিত এক উপদেষ্টা পরিষদ কমিটির সভায় বেক্সিমকোর ঋণের পরিমাণ প্রায় ৭০ হাজার কোটি টাকা বলে জানানো হয়েছে। আবার এ পরিমাণও চূড়ান্ত নয় বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। বিভিন্ন ব্যাংক থেকে বেক্সিমকো গ্রুপের নামে-বেনামে নেয়া প্রকৃত ঋণের পরিমাণ নির্ধারণের বিষয়টি এখনো প্রক্রিয়াধীন। এটি চূড়ান্ত হলে সামনের দিনগুলোয় গ্রুপটির মোট ঋণের পরিমাণ আরো বাড়তে পারে বলে মনে করছেন তারা।
নথির তথ্য অনুযায়ী, বেক্সিমকো গ্রুপের কাছে সবচেয়ে বেশি ঋণ রয়েছে জনতা ব্যাংকের। ব্যাংকটি থেকে ২৯টি কোম্পানির নামে ২৩ হাজার ৯১২ কোটি টাকা বের করে নেয়া হয়েছে। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ১৩ হাজার ৪৬৩ কোটি টাকা ঋণ গেছে আইএফআইসি ব্যাংক থেকে। সালমান এফ রহমান নিজেই ওই ব্যাংকটির চেয়ারম্যান ছিলেন। ব্যাংক কোম্পানি আইনের ব্যত্যয় ঘটিয়ে ও বেনামি কোম্পানি তৈরি করে এ ঋণ নিয়েছেন তিনি। এছাড়া আর যেসব ব্যাংকে বেক্সিমকো গ্রুপের বড় অংকের ঋণ রয়েছে, সেগুলোর মধ্যে ন্যাশনাল ব্যাংক থেকে ৩ হাজার ১৮২ কোটি টাকা, এবি ব্যাংক থেকে ১ হাজার ৮৩৯ কোটি, সোনালী ব্যাংক থেকে ১ হাজার ৬৭৭ কোটি, এক্সিম ব্যাংক থেকে ১ হাজার ৪৬৮ কোটি, অগ্রণী ব্যাংক থেকে ১ হাজার ৯ কোটি, রূপালী ব্যাংক থেকে ৯৬৫ কোটি, ডাচ্-বাংলা ব্যাংক থেকে ১৭০ কোটি, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক থেকে ১৪৬ কোটি, ঢাকা ব্যাংক থেকে ১৩৭ কোটি, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক থেকে ৮৫ কোটি ও পদ্মা ব্যাংক থেকে ২৪ কোটি টাকা ঋণ নেয়া হয়েছে। গ্রুপটির কাছে আরো কয়েকটি ব্যাংক ও সাতটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ঋণ রয়েছে।
বেতনভাতা না পেয়ে গত বছরের সেপ্টেম্বর থেকে বেক্সিমকো ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্কের শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোর শ্রমিকরা রাস্তায় নেমে আসে। এ অবস্থায় বেতনভাতা পরিশোধের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে গত বছরের সেপ্টেম্বর থেকে এ পর্যন্ত ২২৩ কোটি ৪৩ লাখ টাকা দেয়া হয়। পাশাপাশি বেক্সিমকো ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্কের শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোর শ্রম ও ব্যবসায় পরিস্থিতি পর্যালোচনাসংক্রান্ত একটি উপদেষ্টা পরিষদ কমিটি গঠন করে সরকার। এ কমিটির সর্বশেষ সভা অনুষ্ঠিত হয় ২৮ জানুয়ারি। এ সভায় বেক্সিমকোর লে-অফ করা ১২ কোম্পানি কর্তৃপক্ষ বন্ধ করে দেবে বলে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। শ্রম আইনের অধীনে শ্রমিকদের আইনানুগ পাওনাদি আগামী ফেব্রুয়ারির মধ্যে পরিশোধেরও কথা জানানো হয়। এক্ষেত্রে বিভিন্ন ব্যাংকে বেক্সিমকোর ঋণের বিপরীতে গ্রুপটির তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর বন্ধক রাখা শেয়ার বিক্রির পাশাপাশি সরকারি তহবিলের মাধ্যমে পাওনা পরিশোধের সিদ্ধান্ত হয়। এছাড়া সভায় উপদেষ্টা পরিষদ কমিটির সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন না করায় বেক্সিমকোর নিয়োগকৃত রিসিভারকে বরখাস্ত করা, গ্রুপটিকে ঋণ দেয়া ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো কিসের ভিত্তিতে বা কী দলিলপত্রের ভিত্তিতে এ অর্থায়ন করেছে এবং এক্ষেত্রে কোনো অনিয়ম হয়েছে কিনা, সে বিষয়ে ফরেনসিক অডিট করে ফেব্রুয়ারির মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে তদন্তের ভিত্তিতে বিভাগীয় ও আইনানুগ পদক্ষেপ গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালস ও শাইনপুকুর সিরামিকসের বন্ধকীকৃত শেয়ার বিক্রির বিষয়ে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ ও বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) পক্ষ থেকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে বলেও সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়।
শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সচিব এএইচএম সফিকুজ্জামান বলেন, ‘বেক্সিমকোর শ্রমিকদের সব দেনা-পাওনা পরিশোধের জন্য সাড়ে ৫০০ কোটি টাকা প্রয়োজন। উপদেষ্টা পরিষদ কমিটির সভায় যেসব সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে, সেগুলো বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে কিছু আইনি দিকও রয়েছে। এখন এগুলো কীভাবে বাস্তবায়ন করা যায় সেটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ, অর্থ বিভাগ, বাংলাদেশ ব্যাংক ও বিএসইসি দেখবে।’
উপদেষ্টা পরিষদ কমিটির সভায় যেসব সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল এরই মধ্যে সেগুলো বাস্তবায়নে বেশকিছু পদক্ষেপ নিয়েছে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ। বেক্সিমকোয় এর আগে নিয়োগ করা রিসিভারকে সাময়িক বরখাস্ত করার পাশাপাশি তার বিরুদ্ধে তদন্ত করে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকে চিঠি দেয়া হয়েছে। পাশাপাশি নতুন রিসিভার নিয়োগের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এছাড়া ফরেনসিক অডিট ও তদন্তের মাধ্যমে দোষীদের চিহ্নিত করে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগকে অবহিত করার পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে ব্যবস্থা নিতে চিঠি দেয়া হয়েছে।
কমিটির সভায় প্রথমে শেয়ার বিক্রির মাধ্যমে শ্রমিকদের পাওনা পরিশোধ করার বিষয়টি বলা হলে পরবর্তীতে আইনি দিক বিবেচনায় এ বিষয়ে করণীয় নির্ধারণে সংশ্লিষ্ট বিভাগ ও সংস্থাগুলোকে কর্মপন্থা নির্ধারণের জন্য বলা হয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় উপদেষ্টা কমিটির সিদ্ধান্ত কীভাবে বাস্তবায়ন করা হবে সে বিষয়ে কর্মপন্থা নিধারণে গতকাল আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব নাজমা মোবারেকের নেতৃত্বে বেক্সিমকোকে ঋণদানকারী ব্যাংক, বিএসইসি ও বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তাদের নিয়ে একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। বন্ধক রাখা শেয়ার বিক্রি করে ব্যাংক নিজের পাওনা অর্থ আদায়ের পাশাপাশি আমানতকারীদের স্বার্থ দেখবে নাকি শ্রমিকদের পাওনা পরিশোধে সহায়তা করবে সে বিষয়ে সভায় আলোচনা হয়েছে। এক্ষেত্রে ঋণের বিপরীতে জামানত হিসেবে রাখা শেয়ার বিক্রির ক্ষেত্রে ব্যাংকের পাওনা অর্থ পরিশোধের বিষয়টিই প্রাধান্য পাবে বলে সভায় জানানো হয়েছে। আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ থেকেও ব্যাংকের পাওনা আদায়ের বিষয়টিকে গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, শ্রমিকদের দেনা পাওনা নিষ্পত্তি করার জন্য কত টাকা প্রয়োজন হবে সেটি নির্ধারণ করে শ্রম মন্ত্রণালয় থেকে অর্থ বিভাগকে অবহিত করা হবে এবং অর্থ বিভাগ সেটি পরিশোধের ব্যবস্থা করবে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব নাজমা মোবারেক বলেন, ‘বেক্সিমকোর কাছে ব্যাংকের পাওনা অর্থ কীভাবে আদায় করা যায়, সে বিষয়ে একটি কর্মপন্থা নির্ধারণে আমরা কাজ করছি। আমরা ব্যাংকগুলোর কাছে আরো বেশকিছু তথ্য চেয়েছি। কয়েকদিনের মধ্যেই আমরা ঋণ পরিশোধের বিষয়ে একটি কর্মপন্থা চূড়ান্ত করতে পারব। আর শ্রমিকদের পাওনা পরিশোধের বিষয়টি সরকার দেখবে।’
পুঁজিবাজারসংশ্লিষ্টরা বলছেন, সরকারের পক্ষ থেকে বেক্সিমকোর তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলো বন্ধক রাখা শেয়ার বিক্রি করে দায়-দেনা পরিশোধের কথা বলা হলেও এটি বাস্তবায়নে আইনি চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হবে। সিকিউরিটিজ আইন অনুসারে, তালিকাভুক্ত কোম্পানির উদ্যোক্তা পরিচালকদের কাছে সম্মিলিতভাবে ন্যূনতম ৩০ শতাংশ শেয়ার ধারণের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। এ ৩০ শতাংশ শেয়ার ব্লক অবস্থায় থাকে এবং নিয়ন্ত্রক সংস্থার অনুমোদন ছাড়া এটি বিক্রি কিংবা স্থানান্তর করা সম্ভব নয়। ফলে বেক্সিমকোর যেই তালিকাভুক্ত কোম্পানিতে উদ্যোক্তা পরিচালকদের কাছে সম্মিলিতভাবে ৩০ শতাংশের বেশি শেয়ার আছে সেগুলো বিক্রি করা যাবে। সে হিসাবে সিকিউরিটিজ আইন মেনে বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালসের দশমিক ১৩ শতাংশ, বেক্সিমকো লিমিটেডের ৩ দশমিক ১১ শতাংশ এবং শাইনপুকুর সিরামিকসের ২০ শতাংশ শেয়ার বিক্রির সুযোগ রয়েছে। তাছাড়া বর্তমানে বেক্সিমকো লিমিটেডের শেয়ারে ফ্লোর প্রাইস আরোপ করা আছে। ফলে এ অবস্থায় অতিমূল্যায়িত এ শেয়ার বিক্রির উদ্যোগ নেয়া হলেও সেটি কেনার মতো ক্রেতা পাওয়া যাবে কিনা তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। সব মিলিয়ে সরকারের পক্ষ থেকে বন্ধকি শেয়ার বিক্রির সিদ্ধান্ত নেয়া হলেও সেটি বাস্তবায়নের বড় ধরনের চ্যালেঞ্জে পড়তে হবে বলে মনে করছেন তারা।
জানতে চাইলে বিএসইসির নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মোহাম্মদ রেজাউল করিম বলেন, ‘আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সভায় বিএসইসির প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন। সেখানে বেক্সিমকোর ব্যাংক ঋণের বিপরীতে জামানত হিসেবে বন্ধকীকৃত শেয়ারের বিষয়ে কী করা যায় সেই কর্মপদ্ধতি নিয়ে আলোচনা হয়েছে। বিএসইসির পক্ষ থেকে তালিকাভুক্ত কোম্পানির শেয়ার বন্ধক রাখাসংক্রান্ত সিকিউরিটিজ আইনের বিভিন্ন দিক তুলে ধরা হয়েছে।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুসারে, দেশের বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কাছে গত বছরের নভেম্বর শেষে বেক্সিমকো গ্রুপের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ঋণের পরিমাণ ছিল ৫০ হাজার কোটি টাকার বেশি। তবে সম্প্রতি উপদেষ্টা পরিষদ কমিটির সভায় বেক্সিমকোর ঋণের পরিমাণ প্রায় ৭০ হাজার কোটি টাকা বলে জানানো হয়েছে। বেক্সিমকো ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্কের ৩২টি শিল্পপ্রতিষ্ঠানের মধ্যে অস্তিত্ববিহীন প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ১৬টি। এ ১৬ প্রতিষ্ঠানের বিপরীতে ব্যাংক ঋণ রয়েছে ১২ হাজার কোটি টাকা। সব মিলিয়ে এ ৩২টি প্রতিষ্ঠানের মোট ঋণ ২৯ হাজার ৯২৫ কোটি টাকা। তাছাড়া বেক্সিমকো লিমিটেডের ৪০ হাজার কোটি টাকারও বেশি ঋণ রয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র হোসেন আরা শিখা বলেন, ‘রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের মালিকানা সরকার তথা আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের কাছে। সে হিসাবে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোয় খেলাপি ঋণের বিপরীতে যদি বেক্সিমকোর কোনো শেয়ার বন্ধক রাখা থাকে তাহলে সেটি বিক্রি করে ঋণ আদায়ের সিদ্ধান্ত আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ নিতে পারে। তবে বেসরকারি খাতের ব্যাংকগুলোর ঋণের বিপরীতে বন্ধক রাখা শেয়ার বিক্রির সিদ্ধান্ত সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলো নেবে। বেক্সিমকোর যে পরিমাণ শেয়ার বন্ধক রাখা আছে ঋণের পরিমাণ তার চেয়ে অনেক বেশি। বিদ্যমান আইনি কাঠামো অনুসারে বন্ধক রাখা শেয়ার বিক্রিসহ অন্যান্য উপায়ে বেক্সিমকোর ঋণ আদায়ের চেষ্টা করা হচ্ছে। এক্ষেত্রে আইনি কাঠামোর কোনো ধরনের সংস্কার প্রয়োজন হলে সে বিষয়েও উদ্যোগ নেবে বাংলাদেশ ব্যাংক।’