বিখ্যাত কবি, কথাশিল্পী ও নাট্যকার, বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায় এর জন্মদিন আজ। তিনি ‘বনফুল’ ছদ্মনামে পরিচিত। বলাইচাঁদ ১৮৯৯ খ্রিষ্টাব্দের এই দিনে বিহারের পূর্ণিয়া জেলার মণিহারী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পূর্বপুরুষদের আদি নিবাস ছিলো হুগলি জেলার শিয়ালখালায়। পিতা সত্যচরণ মুখোপাধ্যায় ছিলেন পূর্ণিয়া জেলার মণিহারী ডিস্ট্রিক্ট বোর্ড হাসপাতালের ডাক্তার। মাতা মৃণালিনী দেবী।
বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায় পূর্ণিয়ার সাহেবগঞ্জ স্কুল থেকে ম্যাট্রিক এবং হাজারিবাগের সেন্ট কলম্বাস কলেজ থেকে আইএসসি পাস করেন। একই বছরে তিনি কলকাতা মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি হন। তবে তিনি যখন ষষ্ঠ বার্ষিক শ্রেণিতে পড়েন, তখন বিহারের পাটনায় মেডিক্যাল কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়। বিহার থেকে আসা ছাত্র হিসেবে তিনি এ নব প্রতিষ্ঠিত কলেজে স্থানান্তরিত হন এবং সেখান থেকে এমবিবিএস পাস করেন।
বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায় কর্মজীবন শুরু করেন কলকাতার একটি বেসরকারি ল্যাবরেটরিতে নিয়োগ লাভের মধ্য দিয়ে। পরে মুর্শিদাবাদের আজিমগঞ্জের মিউনিসিপ্যালিটি হাসপাতালে মেডিক্যাল অফিসার পদে কিছুকাল দায়িত্ব পালন করেন। তবে তিনি ভাগলপুরের খলিফাবাগে নিজ উদ্যোগে The Secro-Bactro Clinic নামে একটি ল্যাবরেটরি প্রতিষ্ঠা করে খ্যাতিমান ডাক্তার হিসেবে পরিচিত হন। তিনি ১৯৬৮ খ্রিষ্টাব্দে স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য কলকাতায় চলে আসেন ।
ছোটবেলা থেকেই বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায়ের সাহিত্যের প্রতি অনুরাগ লক্ষ করা যায়। স্কুলে পড়ার সময়ে তিনি ‘বনফুল’ ছদ্মনামে কবিতা রচনা করেন। সম্পাদনা করেন বিকাশ নামে হাতে-লেখা একটি সাহিত্যপত্রিকা। তাতে প্রকাশিত হতো প্রবন্ধ, কবিতা, গল্প, অনুবাদ প্রভৃতি। এ সময় থেকে তার সাহিত্যবিষয়ক রচনা প্রকাশিত হয় ভারতী, প্রবাসী, কল্লোল প্রভৃতি বিখ্যাত পত্রিকায়। এসব পত্রিকায় প্রকাশিত তার কবিতার নিখুঁত ছন্দ এবং গল্পের বিষয় নির্বাচন ও ভাষার ওপর দক্ষতা পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। তার কবিতার প্রধান বিষয় নিসর্গ চেতনা, প্রেম ও আত্ম-উপলব্ধি।
সাহিত্যসাধনায় বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায়ের কৃতিত্ব কথাশিল্পে। নতুন ধারা ও বিচিত্র ধরণের কাহিনী নির্মাণে তিনি অভিনবত্বের পরিচয় দিয়েছেন। তিনি উপন্যাস লিখেছেন একষট্টিটি, গল্প ছয়শত। তার উপন্যাসের বিষয়- ইতিহাস, নৃতত্ত্ব, চিকিৎসাবিদ্যা, মনস্তত্ত্ব, প্রেম প্রভৃতি। তাঁর উল্লেখযোগ্য উপন্যাস- তৃণখন্ড, জঙ্গম, অগ্নি, ডানা, স্থাবর প্রভৃতি। তার প্রত্যেকটি উপন্যাসের গঠনভঙ্গি স্বতন্ত্র এবং অভিনব। তিনি কাহিনী বর্ণনা করেন কখনও নাটকীয় সংলাপে, কখনও স্বগতোক্তিতে, কখনও কবিতায়। তিনি উপন্যাসের গঠনরীতি এবং কথন-কৌশলে যেসব পরীক্ষা করেন, তা বাংলা সাহিত্যে বিরল। তিনি কিছু ইংরেজি উপন্যাস অনুবাদ করেন যা দেশজ পটভূমি ও চরিত্রের বিন্যাসে অলঙ্কৃত।
সমাজের অবহেলিত মানুষের সেবা করা ছিলো বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায়ের জীবনের ব্রত। এক্ষেত্রে ডাক্তারি ছিল তার অন্যতম মাধ্যম। কিন্তু এ সেবাতেই তিনি সন্তুষ্ট ছিলেন না। তিনি সাধারণ, নিরন্ন, অবহেলিত, শ্রমজীবী মানুষের জীবন আঁকতে চেয়েছেন শিল্পে। তার কাছে এর এক অসাধারণ মাধ্যম ছিলো ছোটগল্প। ছোটগল্প রচনায় তিনি তুলনাহীন মুন্সিয়ানার পরিচয় দিয়েছেন। তার ছোটগল্পে মানবজীবনের বিচিত্ররূপের সমাবেশ ঘটেছে- যেমন গল্পের বিষয়বস্ত্ততে, তেমনি ব্যাপক সৃজনশীলতায়। তার ছোটগল্পে মানবজীবনের নানা স্ববিরোধিতা, দুর্জ্ঞেয় রহস্য, আত্মানুসন্ধানের প্রয়াস লক্ষ করা যায়। তার উল্লেখযোগ্য গল্পগ্রন্থ-বনফুলের গল্প, বিন্দুবিসর্গ, অদৃশ্যলোকে, তন্বী (১৯৪৯), অনুগামিনী প্রভৃতি।
সাহিত্য-সাধনার স্বীকৃতিস্বরূপ বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায় লাভ করেন শরৎস্মৃতি পুরস্কার, রবীন্দ্র পুরস্কার, বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের জগত্তারিণী পদক। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় তাকে ডি.লিট উপাধি প্রদান করে ১৯৭৩ খ্রিষ্টাব্দে; ভারত সরকারের কাছ থেকে তিনি পান পদ্মভূষণ উপাধি। ১৯৭৯ খ্রিষ্টাব্দের ৯ ফেব্রুয়ারি বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায় পরলোকগমন করেন।