ঢাকা রোববার, ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪ , ২৩ ভাদ্র ১৪৩১ আর্কাইভস ই পেপার

nogod
nogod
bkash
bkash
uttoron
uttoron
Rocket
Rocket
nogod
nogod
bkash
bkash

হবু শিক্ষকদের জ্ঞানে নিয়োগকর্তারা কিংকর্তব্যবিমূঢ়!

শিক্ষা

সিদ্দিকুর রহমান খান

প্রকাশিত: ১২:০৪, ২৬ জুলাই ২০২৪

সর্বশেষ

হবু শিক্ষকদের জ্ঞানে নিয়োগকর্তারা কিংকর্তব্যবিমূঢ়!

শিক্ষাদানে সক্ষম শিক্ষকের মহাসঙ্কটে ভুগছে বাংলাদেশ। বিশেষ করে প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় মানসম্মত প্রার্থীর জন্য হাপিত্যেশ করছেন পরীক্ষক ও নিয়োগকর্তারা। টেনেটুনে লিখিত পরীক্ষা উতরে আসা প্রার্থীদের ভাইভা বা সাক্ষাৎকার নিতে বসে তারা হয়ে পড়ছেন চরম হতাশ। শিক্ষক পদে নিয়োগ পেতে মরিয়া প্রার্থীদের শিক্ষাজ্ঞান তাদেরকে কিংকর্তব্যবিমূঢ় করে দিচ্ছে। সম্ভাব্য শিক্ষকদের শিক্ষার চরম দুরবস্থা ও বেহাল দশার মুখোমুখি হয়ে তারা রীতিমতো আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন। শিক্ষার এমন ভয়ংকর চিত্র থেকে বেরিয়ে আসার উপায় খুঁজে গলদঘর্ম সবাই।  

তাদেরই একজন বরিশালের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (শিক্ষা ও আইসিটি) মো. সোহেল মারুফ। ২০২২ খ্রিষ্টাব্দের ঘটনা। টানা প্রায় দেড় মাস প্রতিদিন প্রায় ১২ ঘণ্টা করে প্রাইমারি শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় প্রায় ৪১০০ জন পরীক্ষার্থীর ভাইভা নিয়েছেন তিনি। তারপর নিজের ফেসবুক পেজে শেয়ার করেছেন নিজের অভিজ্ঞতা। তার নিজের ফেসবুক দেয়া তার ওই পোস্টটি হুবহু তুলে ধরা হলো।  

সোহেল মারুফ লিখেছেন, ‘অভিজ্ঞতা হলো সার্বিক বিষয়ে। যুব সমাজের পড়াশোনার প্রবণতা, শিক্ষার মান, তাদের ভাবনা, দেশের সামগ্রিক শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর দক্ষতা সব বিষয়ে সম্যক জ্ঞান লাভ করলাম। বুয়েট, সরকারি মেডিক্যাল কলেজের কোন ছাত্রছাত্রী পাইনি। তবে সরকারি ডেন্টাল কলেজের একজন পেয়েছিলাম। এ ছাড়া সব ভার্সিটির পরীক্ষার্থী পেয়েছি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, নর্থ সাউথসহ সব বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলে-মেয়ে পেয়েছি। কিছু ভালো ছেলে-মেয়ে পেয়েছি স্বাভাবিকভাবেই। তবে সামগ্রিক প্রবণতা হতাশাজনক। ভাইভাতে আমাদের সামগ্রিক ফোকাস ছিল মূলত কয়েকটি বিষয়ে। ১. নিজ জেলা ২. বঙ্গবন্ধু, মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশ ৩. পরীক্ষার্থীদের পঠিত বিষয় (ডিগ্রি, অনার্স-মাস্টার্স) ৪. বাংলা ব্যাকরণ ও ইংরেজি ব্যাকরণ (যা প্রাইমারিতে প্রয়োজন) ৫. প্রাথমিক গণিত ৬. সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড।’

তার আক্ষেপ, ‘বেশিরভাগ পরীক্ষার্থী তাদের নিজ জেলা সম্পর্কে তেমন কিছুই বলতে পারেনি (প্রায় ৯৮ শতাংশ)। নমুনা প্রশ্ন যেমন-এ জেলায় কয়টি উপজেলা, কয়টি ইউনিয়ন, এ বিভাগে কয়টি জেলা এসব প্রশ্নের উত্তর তারা দিতে পারেনি। কয়েকজন বিশিষ্ট ব্যক্তির নাম, বীর মুক্তিযোদ্ধা বা বিশিষ্ট ব্যক্তিদের নাম তারা জানে না। ৩/৪টি নদীর নাম তাদের মনে নেই। ইংরেজি সামগ্রিক জ্ঞান ভয়াবহ। Syllable কয় প্রকার বলতে পারেননি প্রায় ৯৭ ভাগ পরীক্ষার্থী। বরিশাল কীর্তনখোলা নদীর তীরে অবস্থিত-এটার ইংরেজি করতে পারেনি ৯৯ ভাগ পরীক্ষার্থী। তাদের বেশিরভাগ শোনেনি bank of the river শব্দগুলো। সার্বিকভাবে ইংরেজি কিছুই জানে না এমন শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় ৯০ ভাগ। জাতীয় ৪ নেতার নাম বলতে পারেনি প্রায় ৮৫ ভাগ শিক্ষার্থী। জাতীয় দিবস কোনটি উত্তর দিতে পারেনি ৭০ ভাগ পরীক্ষার্থী। নিজের বিষয়ের Basic জানে না ৯৬ ভাগ পরীক্ষার্থী। ভাইভাতে মেয়েদের শাড়ি পরা উচিত এটা জানে না ৭৫ ভাগ মেয়ে পরীক্ষার্থী। বাংলা ব্যাকরণ ও ইংরেজি ব্যাকরণে ৮০ ভাগের তেমন কোনো ধারণা নেই। নমুনা প্রশ্ন ছিল শব্দ কয় প্রকার, এক কথায় প্রকাশ, সমাস কী। English phrase সম্পর্কে ধারণা নেই প্রায় ৮৫ ভাগ ছাত্র-ছাত্রীর। যে প্রতিষ্ঠানে পড়েছে সে প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে জানে না প্রায় ৯৫ ভাগ পরীক্ষার্থী। তাদের ৪/৫ বছরে এটা নিয়ে আগ্রহও জাগেনি। নিরাশার আরো জায়গা ছিলো। ৯৯ ভাগ পরীক্ষার্থী বাক্য লিখে শেষে বিরাম চিহ্ন ব্যবহার করেননি। ইংরেজি বাক্যের শেষে Full stop ব্যবহার করেননি। জিজ্ঞেস করলে বলেছে, ফেসবুকে লিখে তারা অভ্যস্ত তাই বিরাম চিহ্নের ব্যবহার মনে ছিলো না!’ 

এডিসি লিখেছেন, ‘করোনাভাইরাসকালীন অনেক ছেলে-মেয়ে চাকরির আবেদন করতে পারেনি কাজেই অনেকের বয়স শেষ। তার অর্থ হচ্ছে, অনার্স-মাস্টার্স পাস অনেক ছেলেমেয়ে আজীবন বেকার থেকে যাবে। তবে এটা সঠিক তাদের পড়াশোনার মান অত্যন্ত খারাপ ছিলো, তারা নিজেরাও নিজের গুণগত মান বাড়ানোর চেষ্টা করেছে বলে মনে হয় না। অনেককে জিজ্ঞেস করেছি তারা তেমন কিছুই পারে না কেনো? সবাই বলেছে, তারা সব জানে কিন্তু ভাইভার টেনশনে বলতে পারছেন না! এখন যারা পড়াশোনা করছে তাদের শুধু বলতে চাই, সামনের দিনগুলোতে নিজের পণ্য নিজেকেই বিক্রি করতে হবে অর্থাৎ তোমাকেই প্রমাণ করতে হবে তুমি যোগ্য, যোগ্যতা ছাড়া কেউ কাউকে নেবে না, চাকরি দেবে না।।বিশেষ করে ইংরেজিতে অনেক দক্ষ না হলে ভালো কিছুই করার সুযোগ থাকবে না-হোক সেটা নিজস্ব উদ্যোগ বা চাকরি!!

তিনি স্ট্যাটাস শেষ করেছেনে এই বলে, ‘এটা শিক্ষার সার্বিক হতাশাজনক মানকে যেমন উপস্থাপন করেছে ঠিক তেমনি আমাদের সামগ্রিক শিক্ষা ব্যবস্থায় নতুনভাবে কর্মমুখী শিক্ষার প্রয়োজনীয়তাকেই তুলে ধরেছে বলে আমার মনে হয়েছে। এখান থেকে পরবর্তীতে যারা ভাইভা দেবেন, অনেক কিছু ধারণা পাবেন। গদবাধা বাজারের খালি ভাইভার বই পড়লেই হয় না, কী কী জানতে হবে এটাই আগে জানা উচিত।’

সোহেল মারুফের এই স্ট্যাটাসের পর এ বিষয়ে আর কিছু না বললেও বাস্তবতা বুঝতে সমস্যা হয় না। কিন্তু, সমস্যা যে আরো রয়ে গেছে। তাই, বর্তমান বিষয়ের প্রয়োজনেই এবার একটু অতীত ঘুরে আসা যাক। 

২০১৪ খ্রিষ্টাব্দের আগস্টে দৈনিক প্রথম আলো ‘৬৮ শতাংশ শিক্ষক ফেল কেন?’ শিরোনামে আমার একটা উপ-সম্পাদকীয় প্রকাশ করেছিলো। তখন আমি ইংরেজি দৈনিক নিউ এজের বিশেষ প্রতিবেদক এবং সংসদ ও শিক্ষা বিট দেখি। পাশাপাশি অপ্রকাশ্যে ডিজিটাল পত্রিকা দৈনিক শিক্ষাডটকমও দেখি। প্রথম আলোতে প্রকাশের পরদিন লেখাটা দৈনিক শিক্ষাডটকমে প্রকাশ করি। লেখাটির প্রতিক্রিয়ায় যুক্তি-তর্কের বদলে আমাকে ব্যক্তিগতভাবে গালমন্দ করেছিলেন কয়েকজন। কয়েকমাস তক্কে তক্কে থেকে তাদের ঠিকানা-ঠিকুজি পেলাম। কাকতালীয়ভাবে আমাকে কটূক্তিকারী ৬ জনই টাকা দিয়ে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক পদে চাকরি বাগিয়েছেন। কোনো প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় বসতে হয়নি তাদের। স্থানীয়ভাবে সবার মুখে মুখে অমুকে ‘বখাটে’ ছিলো, মামার জোরে আজ শিক্ষক। মানে মামা হাইস্কুলের সভাপতি ভাগ্নে শিক্ষক পদের প্রার্থী। আর শিক্ষা ভবনে টাকা দিয়ে এমপিওভুক্তি! ব্যস।  

প্রথম আলোতে প্রকাশিত সেই লেখাটির কয়েকটি অনুচ্ছেদ এরকম: ‘শিক্ষাসংশ্লিষ্ট সবার জানা, ইংরেজি ও গণিত বিষয় দুটো পাবলিক পরীক্ষায় পাস-ফেলের নিয়ামক। ২০১৪ খ্রিষ্টাব্দে ৯২ দশমিক ৬৭ শতাংশ পরীক্ষার্থী এসএসসি পাস করেছেন। সামান্য কয়েকজন বাদে এ শিক্ষার্থীরাই ২০১৩ খ্রিষ্টাব্দে দশম শ্রেণিতে, তার আগে ২০১২ খ্রিষ্টাব্দে নবম, ২০১১-তে অষ্টম, ২০১০-এ সপ্তম ও ২০০৯ খ্রিষ্টাব্দে ষষ্ঠ শ্রেণি পড়ুয়া ছিলো।

তারাই ষষ্ঠ শ্রেণিতে থাকাকালে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে ও জেলা প্রশাসক এবং জেলা শিক্ষা কর্মকর্তাদের তত্ত্বাবধানে অনুষ্ঠিত ১০০ নম্বরের প্রাক-মূল্যায়ন সমীক্ষায় বসেছিলেন। পরীক্ষার নম্বর বিভাজন-বাংলা, ইংরেজি ও গণিতে মোট ৬০ এবং সমাজ ও বিজ্ঞানে ৩০ এবং ধর্মে ১০। পঞ্চম শ্রেণির পাঠ্যবই থেকে তৈরি করা প্রশ্নে ২০০৯ খ্রিষ্টাব্দের ফেব্রুয়ারি মাসে অনুষ্ঠিত প্রাক-মূল্যায়ন সমীক্ষার অন্যতম উদ্দেশ্য ছিলো, শিক্ষার্থীরা কী ধরনের দুর্বলতা নিয়ে মাধ্যমিক শ্রেণিতে ভর্তি হয়, তা জানা।

আমার ব্যক্তিগত সংগ্রহে থাকা প্রায় সব জেলার মূল্যায়ন সমীক্ষার সমন্বিত ফলাফলের সারাংশ থেকে গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি জেলার উদাহরণ দিচ্ছি। ওই সমীক্ষায় ঢাকা মহানগরসহ ঢাকা জেলার মোট ২৬টি থানা/উপজেলার ষষ্ঠ শ্রেণির প্রায় ৭৫ হাজার শিক্ষার্থী অংশ নিয়ে ৩৯ শতাংশের বেশি ফেল করেছে। অর্থাৎ ১০০ নম্বরের পরীক্ষায় বসে ২৯-এর কম নম্বর পেয়েছে।

সমীক্ষায় শূন্য থেকে ২৯ নম্বরধারীদের ফেল ও ৩০-এর বেশি পেলে পাস ধরা হয়েছিলো। পাঠক, মিলিয়ে দেখুন, ২০১৪ খ্রিষ্টাব্দে এসএসসিতে ঢাকা বোর্ডের পাসের হার ৯৩ দশমিক ৯৪ শতাংশ। মাত্র ৬ শতাংশ ফেল। আর এরাই যখন ষষ্ঠ শ্রেণিতে ছিলেন, তখন ফেলের হার ৩৯ শতাংশের বেশি। তা-ও আবার ঢাকা মহানগরসহ ঢাকা জেলায় যেখানে ভালো প্রতিষ্ঠান ও শিক্ষকের সংখ্যা বেশি বলে ধরা হয়। এবার দেখুন, চট্টগ্রাম মহানগরসহ এ জেলার প্রায় ৭৭ হাজার শিক্ষার্থী অংশ নিয়ে ফেল করেছে ৪৪ শতাংশ।

শিক্ষানগর হিসেবে খ্যাত রাজশাহী মহানগরসহ ১০ উপজেলার প্রায় ৩৫ হাজার শিক্ষার্থীর ৪৬ শতাংশই ফেল। নানা বিবেচনায় গুরুত্বপূর্ণ কুমিল্লা জেলা থেকে ৬৭ হাজার অংশ নিয়ে ফেল করেছে প্রায় ৪৮ শতাংশ। বরিশাল জেলার প্রায় ৩০ ও কিশোরগঞ্জের ৪৪ শতাংশ ফেল।’

পাঠক, আসুন একটু হিসেব মিলিয়ে নিই। ২০১৪ খ্রিষ্টাব্দে যারা এসএসসি পাস করেছিলেন তারাই ২০১৬ খ্রিষ্টাব্দের এইচএসসি। সামান্য কয়েক হাজার মানোন্নয়ন, ফেল থেকে পাস বাদে এই ব্যাচটিই ২০১৭ খ্রিষ্টাব্দে স্নাতক (সম্মান) ও পাস কোর্সে ভর্তি হয়েছিলেন। মোটামুটি হিসেবে ২০২১ ও ২০২২ খ্রিষ্টাব্দে অনার্স-মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জনকারীদের অধিকাংশই সেই ব্যাচটির। সোজা কথায় ফ্রেশ গ্র্যাজুয়েট।

তাহলে এ সময়ে ঢাকা, বরিশাল কিংবা রাজশাহী, কুমিল্লা বা কিশোগঞ্জের হবু শিক্ষকদের ইংরেজি, গণিত ও সাধারণ জ্ঞানের এমন বেহাল দশায় পতিত হওয়ার ঘটনায় খুব বেশি আশ্চর্য হওয়ার সুযোগ আছে কি। গলদটা কি গোড়াতেই রয়ে যায়নি!

লেখক: সম্পাদক, দৈনিক শিক্ষাডটকম এবং প্রধান সম্পাদক, দৈনিক আমাদের বার্তা

জনপ্রিয়