রাজধানীর কেরাণীগঞ্জের এক বস্তিতে মায়ের সঙ্গে থাকেন দশ বছর বয়সী মুন্না। এক বছর আগে তাকে ও তার মা ডলি বেগমকে রেখে অন্যত্র বিয়ে করেন তারা বাবা। তারপর থেকে জীবন যুদ্ধ শুরু হয় মুন্না ও ডলি বেগমের। জীবিকার তাগিদে রোজ সকালে রাজধানীর কেরাণীগঞ্জ থেকে মায়ের সাথে ভিক্টোরিয়া পার্ক এলাকায় ফুল বেচতে আসেন মুন্না।
দৈনিক আমাদের বার্তাকে মুন্না বলেন, আব্বা মারে ছেড়ে আরেক জায়গায় বিয়ে করছে। আমি আম্মার লগে ফুল বেচি। বাসা ভাড়া দিতে হয় মাসে তিন হাজার টাকা। ফুল বেইচ্চা আর কত টাকা হয়! সারাদিন ফুল বেইচ্চা বাজার কইরা রাইতে বাসায় যাই। আগে একটা স্কুলে যাইতাম। এখন যাই না। একটা ভাই এইখানে মাঝেমধ্যে পড়ায়। তার কাছেই পড়ি। নিজের স্বপ্নের কথা জানিয়ে মুন্না বলেন, আমার ইচ্ছা আছিলো পুলিশ হওনের, গরীব মানুষের সেবা করনের। এখন তো পড়াশোনাও করতে পারি না।
শুধু মুন্না নন, পরিস্থিতির শিকার হয়ে এমন অল্প বয়সেই পড়াশোনা ছেড়ে সংসারের হাল ধরতে হয়েছে অনেক শিশুকে। সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় ও ইউনিসেফ বাংলাদেশের যৌথ উদ্যোগে ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দের এক গবেষণায় দেখা যায়, সারাদেশে ৩৪ লাখেরও বেশি পথশিশু বাবা-মায়ের যত্ন ছাড়াই জীবনযাপন করছে। ‘বাংলাদেশে পথশিশুদের পরিস্থিতি-২০২৪’ শীর্ষক ওই গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, চরম দারিদ্র্য, পারিবারিক অস্থিরতা এবং শারীরিক বা মানসিক নির্যাতনের পটভূমি থেকে বেড়ে ওঠা শুরু হয় পথশিশুদের।
রাজধানীর পুরান ঢাকার ভিক্টোরিয়া পার্ক, লক্ষ্মীবাজার ও সদরঘাট এলাকায় এমন অনেক শিশুরই দেখা মেলে। কেউ নদী ভাঙনে ভিটেহারা হয়ে ঢাকায় উদ্বাস্তু জীবন-যাপন করছেন, আবার কেউ বা-মা হারা হয়ে শিশু বয়সেই ধরেছেন সংসারের হাল। খারাপ সঙ্গে মিশে কেউ কেউ আবার আসক্ত হয়েছেন নেশাদ্রব্যে। অঙ্কুরেই ধ্বংস হয়েছে এসব শিশুর শৈশব, নষ্ট হয়েছে স্বপ্ন। অর্থনৈতিক চাপ প্রায়ই এসব শিশুকে শ্রমে বাধ্য করে, তাদের শিক্ষার সুযোগ কমিয়ে দেয়।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় কলম বেচতে দেখা যায় শিশু রহিমাকে। বই-খাতা-কলম নিয়ে স্কুলে যাওয়ার বয়সে জীবিকার তাগিদে কলম বিক্রিকে বেছে নেয়া। দৈনিক আমাদের বার্তাকে রহিমা বলেন, আগে আমার বাবা রিকশা চালাইতো, আমরা চার বোন মাদরাসায় পড়তাম। আমার বাবাকে কারা মেরে তার ঠ্যাং ভাইঙ্গা দিছিলো। তার রিকশাও ভাইঙ্গা দিছে। এখন বাবা কিছু করতে পারে না। মায়েও অসুস্থ। আমার মাদরাসায় যাওয়া এখন বন্ধ হইয়া গেছে। কলম বেইচা যা টাকা পাই তা দিয়েই চাল, ডাল তেল কিনি।
এদিকে সামাজিক সুরক্ষার অভাবে ড্যান্ডিসহ বিভিন্ন নেশাদ্রব্যে আসক্ত হয়েছেন অনেক শিশুই। কেউ আবার জড়িয়ে পড়ছেন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে। এসব শিশুর অনেকের মা-বাবা থাকলেও দেখাশোনা করেন না তারা। ফলে পার্ক বা ফুটপাত থাকতে হয়। ক্ষুধা মেটানোর তাগিদে রোজগারের চেষ্টাও করেন কেউ কেউ, অনেকেই জড়িয়ে পড়েছেন ভিক্ষাবৃত্তিতে।
মোহাম্মদ আকবর নামের আরেক শিশু দৈনিক আমাদের বার্তাকে বলেন, আমরা নিজেরা ময়লা থেকে ভাঙ্গারি খুঁজে বিক্রি করি। এই পার্কেই থাকি, এইখানেই ঘুমাযই। বহুত সমস্যা আমাগো, আমাগোর মধ্যে যারা ড্যান্ডি খায়, নেশা-ভান করে তারা খিদার লাইগ্যা করে। আশেপাশের মহল্লার পোলাপানে গাঁজা বিক্রি করে, গেঞ্জাম করে। দোষ হয় আমাগো। আমাগোও মন চায় স্কুলে যাইতে, ভালো থাকতে। কিন্তু আমাগো স্কুলে ভর্তিও নিবো না। নিলেও ট্যাকা কই পামু?
এদের সম্পর্কে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. সাবিনা শারমিন দৈনিক আমাদের বার্তাকে বলেন, কেন তারা পথশিশু হলো, কিসের জন্য আজ তারা এখানে এইভাবে অবস্থান করছে সে বিষয়ে আমাদের অনুসন্ধান করতে হবে। আমরা এক একজন পথ শিশুদের একেক জনের একেক রকম কারণ দেখতে পাবো। আমাদের সেই কারণগুলো চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নিতে হবে।
শিক্ষা গবেষক মো. শাহনেওয়াজ খান চন্দন দৈনিক আমাদের বার্তাকে বলেন, পথশিশুদের জন্য বিদ্যালয়গুলোতে আলাদা কোটা রাখা যেতে পারে। প্রয়োজনে তাদের বিদ্যালয়ের বেতন সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় বহন করবে। এ ছাড়া সরকারি শিশু পরবারের আওতায় তাদের আনা যেতে পারে। এটা নতুন না। অনেক দেশেই এমন ব্যবস্থা চালু রয়েছে।