আগের দিন মেগা সানডে কর্মসূচি ঘোষণা করে পুরান ঢাকার ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল হামলা ও ভাঙচুর চালিয়েছিলেন প্রায় ৩৫ কলেজের শিক্ষার্থীরা। আরো হামলা চালিয়েছেন সরকারি কবি নজরুল কলেজে। তাদের ভাঙচুরে যেনো ধ্বংস স্তূপে পরিণত হয়েছিলো সরকারি শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ। ওই মেগা সানডে হামলার নেতৃত্বে ছিলেন যাত্রাবাড়ীর মাতুয়াইলের ডক্টর মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজের শিক্ষার্থীরা। গতকাল সোমবার মেগা মানডে কর্মসূচি ঘোষণা করে আগের দিনের হামলার সহিংস জবাব দিয়েছেন নজরুল ও সোহরাওয়ার্দী কলেজের শিক্ষার্থীরা।
পাল্টা হামলায় গতকাল দুপুর থেকে মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজের সামনে কয়েক ঘণ্টা ধরে সংঘর্ষ চলে। এ সময় পুলিশ সংঘর্ষ থামাতে কয়েকটি টিয়ার গ্যাসের শেল ছুঁড়লেও রক্তপাত এড়াতে সেনাবাহিনী ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বড় কোনো অ্যাকশন থেকে বিরত থাকে। কিন্তু, তাতে রক্তপাত এড়ানো যায়নি। সংঘর্ষে প্রাথমিকভাবে উভয় পক্ষের শতাধিক শিক্ষার্থীর আহত হওয়ার খবর পাওয়া যায়। আর সংবাদপত্র অফিসে বিজ্ঞপ্তি দিয়ে মোল্লা কলেজের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়, তাদের তিন জন শিক্ষার্থী নিহত হয়েছেন। তবে ঢাকা মহানগর পুলিশের পক্ষ থেকে ওই দাবি অস্বীকার করা হয়। সন্ধ্যা নাগাদ মোল্লা কলেজের আর একটি বিবৃিততে আহতদের বিষয়ে বলা হলেও নিহতদের ব্যাপারে কোনো কথা বলা হয়নি।
উদ্ভূত পরিস্থিতিতে সংঘর্ষ এলাকায় ৬ প্লাটুন বিজিবি মোতায়েন করা হয়। বন্ধ ঘোষণা করা হয় নজরুল ও সোহরাওয়ার্দী কলেজ। আর নিরাপত্তাজনিত কারণে স্থগিত করা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত সাত কলেজের চতুর্থ বর্ষের চলমান ফাইনাল ইয়ারের আজকের মঙ্গলবারের পরীক্ষা।
এদিকে আগের দিনের হামলার ঘটনায় গুলিভর্তি ম্যাগজিন চুরির অভিযোগে ড. মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজসহ বিভিন্ন কলেজের আট হাজার শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে মামলা করেছে পুলিশ।
এদিকে ওই সংঘর্ষের পর শিক্ষার্থীদের কোন ধরনের সংঘর্ষে না জড়িয়ে শান্ত থাকার আহ্বান জানিয়ে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেছেন, এ ধরনের সংঘাতের পেছনে কোনো ধরনের ইন্ধন থাকলে তা কঠোর হাতে দমন করা হবে।
তার আগে শিক্ষার্থীদের ন্যায্য দাবি নিয়ে তার কাছে যাওয়ার আহ্বান জানান শিক্ষা উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. ওয়াহিদদ্দিন মাহমুদ।
আর গতকালের সংঘর্ষের পর জরুরি বৈঠকে বসে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন।
হামলার পর সরেজমিনে গিয়ে মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজে ভাঙচুরের চিত্র দেখা গেছে। কলেজটির ১০তলা ভবনের সব তলায় ভাঙচুর চালানো হয়েছে। লুটপাট করা হয়েছে কম্পিউটারসহ বিভিন্ন সরঞ্জাম ও আসবাবপত্র।
সংঘর্ষের বর্ণনা দিতে গিয়ে মোল্লা কলেজের সামনে উপস্থিত পুলিশের ওয়ারী বিভাগের উপ কমিশনার ছালেহউদ্দিন বলেন, সকাল থেকে আমরা যাত্রবাড়ী মোড়ে প্রস্তুত ছিলাম- যাতে মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজ আক্রান্ত না হয়। আমরা যাত্রাবাড়ী মোড়ে পর্যাপ্ত সংখ্যক পুলিশ এপিসিসহ প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছিলাম ডিএমপি কমিশনারের নির্দেশনায়। এরপর হাজার হাজার ছাত্র আমাদের ব্যারিকেড ভেঙে মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজে এসে ভাঙচুর করেছে।
এদিকে ওই সংঘর্ষ চলাকালে আহত কবি নজরুল ইসলাম সরকারি কলেজের ইসলামের ইতিহাস বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী শরীফ হোসেন বলেন, গত রোববারের হামলার ঘটনার প্রতিবাদে আমরা মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজের সামনে শান্তিপূর্ণ অবস্থান নেওয়ার সময় ওই কলেজের পক্ষ হয়ে সন্ত্রাসীরা আমাদের ওপর হামলা চালিয়েছে।
৩ ছাত্র নিহতের দাবি
সংঘর্ষে ড. মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজের তিনজন শিক্ষার্থী নিহত হয়েছেন বলে দাবি করেছে কলেজ কর্তৃপক্ষ। তাৎক্ষণিকভাবে তাদের নাম-পরিচয় জানানো হয়নি। পাশাপাশি নিহতদের মরদেহ কলেজে নাকি কোনো হাসপাতালে, তা নিয়েও নিশ্চিত করে কিছু বলেনি কলেজ কর্তৃপক্ষ।
তাছাড়া শতাধিক শিক্ষার্থী ও শিক্ষক আহত হয়েছে বলে তারা জানিয়েছে। তাদের অনেকের অবস্থা আশঙ্কাজনক বলেও দাবি কলেজটির।
গতকাল সোমবার দুপুর আড়াইটার দিকে কলেজের পক্ষে ব্যবস্থাপনা পরিচালক আশরাফ সামীরের সই করা এক বিজ্ঞপ্তি গণমাধ্যমে পাঠানো হয়। তাতে তিন শিক্ষার্থী নিহত হয়েছে দাবি করা হয়।
তবে এ বিষয়ে পুলিশের পক্ষ থেকে এ নিয়ে কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
নিহতের দাবি অস্বীকার পুলিশের
বিকেলে ডিএমপির এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে ৩ ছাত্র নিহতের দাবি অস্বীকার করে অপপ্রচার না চালানোর অনুরোধ করা হয়।
ওই বিজ্ঞপ্তিতে আরো বলা হয়, হাসপাতালে ছাত্র মৃত্যুর জেরে ৩৫টি কলেজের শিক্ষার্থীদের সমন্বয়ে ইউনাইটেড কলেজ অব বাংলাদেশ নামে একটি ফোরাম গঠিত হয়। অপরদিকে ঢাকা কলেজ, সোহরাওয়ার্দী কলেজ, কবি নজরুল কলেজ, তিতুমীর কলেজ, বদরুন্নেছা কলেজ, মিরপুর বাংলা কলেজ ও ইডেন কলেজ এই সাত কলেজের শিক্ষার্থীদের একটি জোট হয়। গত কয়েক দিন ধরেই উভয় জোটের মধ্যে উত্তেজনা চলছিলো।
৭ কলেজের পরীক্ষা স্থগিত
গতকাল সোমবার বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকের দপ্তর থেকে পাঠানো এক বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়েছে।
এতে বলা হয়েছে, অধিভুক্ত সরকারি সাত কলেজের অনার্স চতুর্থ বর্ষের আজ মঙ্গলবারের পরীক্ষা ‘অনিবার্য কারণে’ স্থগিত করা হয়েছে। এ পরীক্ষার নতুন সময়সূচি ‘শিগগিরই’ ঘোষণা করা হবে। তবে অন্যান্য পরীক্ষার সময়সূচির অপরিবর্তিত থাকবে বলে বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে।
প্রসঙ্গত, গত সপ্তাহে সাত কলেজের অনার্স চতুর্থ বর্ষের পরীক্ষা শুরু হয়। এর মধ্যে ঢাকা ন্যাশনাল মেডিকেলে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মাহাবুবুর রহমান মোল্লা কলেজের এক শিক্ষার্থীর মৃত্যুকে কেন্দ্র করে গত দুইদিন ধরে পুরান ঢাকার বিভিন্ন কলেজের শিক্ষার্থীরা সংঘর্ষে জড়িয়েছে।
এর মধ্যে আজ সোমবার সরকারি শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজে অনার্স প্রথম বর্ষের ফাইনাল পরীক্ষা দিতে গিয়ে বিপাকে পড়েন কবি নজরুল কলেজের শিক্ষার্থীরা। সংঘর্ষের মধ্যে মাঝপথে ইতিহাস পরীক্ষা স্থগিত করা হয়। সোহরাওয়ার্দী ও নজরুল দুই কলেজই রয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত সাত কলেজের মধ্যে।
পুলিশের মামলা
এদিকে গত রোববারের ভাঙচুর চলাকালে গুলিভর্তি ম্যাগজিন চুরির অভিযোগে ড. মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজসহ বিভিন্ন কলেজের আট হাজার শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে মামলা করেছে পুলিশ।
পুলিশের উপ-পরিদর্শক এ কে এম হাসান মাহমুদুল কবীর বাদী হয়ে রাজধানীর সূত্রাপুর থানায় এই মামলা করেন। গতকাল সোমবার আদালতের সূত্রাপুর থানার সাধারণ নিবন্ধন শাখারুম সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
মামলার অভিযোগে বলা হয়েছে, গত ২৪ নভেম্বর ড. মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজসহ বিভিন্ন কলেজের ৭/৮ হাজার শিক্ষার্থী বেআইনি জনতাবদ্ধে মারাত্মক অস্ত্র-শস্ত্রসহ দাঙ্গা সৃষ্টি করে সরকারি সম্পত্তি ভাঙচুর করে। সরকারি অস্ত্রের (পিস্তল) গুলি ভর্তি ম্যাগজিন চুরি, সরকারি ডিউটিতে ব্যবহৃত এপিসি গাড়ি ভাঙচুর করে ক্ষতিসাধন করে।
কর্তব্যরত পুলিশ সদস্যদের ওপর আক্রমণ করা, জীবননাশের হুমকি দেওয়া এবং ত্রাস সৃষ্টির মাধ্যমে অন্তর্ঘাতমূলক কাজ করেন। এছাড়া পুলিশের আর্মড পুলিশ কার (এপিসি) ও ডিউটিরত পুলিশের মটরসাইকেল ভাঙচুর করে সর্বমোট দুই লাখ ৭০ হাজার টাকার ক্ষতি হয়েছে বলে মামলায় উল্লেখ করা হয়েছে। এতে পেনাল কোড ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনের ১৫(৩) ধারার অপরাধ আনা হয়েছে।
সেন্ট গ্রেগরী স্কুল ভাঙচুর
রোববার দুপুরে সোহরাওয়ার্দী কলেজে ভাঙচুর ও লুটপাটের ঘটনায় পুরান ঢাকার সেন্ট গ্রেগরী স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষার্থীরাও ছিলেন অভিযোগ তুলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটিতে হামলার ঘটনা ঘটেছে।
রোববার সন্ধ্যা ৬টার দিকে সেন্ট গ্রেগরীতে হামলার ঘটনা ঘটে বলে জানিয়েছেন সূত্রাপুর থানার ওসি সাইফুল ইসলাম। তবে কারা হামলা চালিয়েছে তা নিয়ে মন্তব্য করতে চাননি তিনি।
একাধিক প্রত্যক্ষদর্শী জানিয়েছেন, সোহরাওয়ার্দী কলেজের একদল শিক্ষার্থী ওই হামলা চালান।
আহত কতো
দুই দিনের সংঘর্ষে দুই শতাধিক শিক্ষার্থী আহত হয়েছেন বলে প্রাথমিকভাবে জানা গেছে। ঢাকা মেডিক্যাল পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ মো. ফারুক জানান, বিকাল ৪টা নাগাদ হাসপাতালের জরুরি বিভাগে ২১ শিক্ষার্থীকে আহত অবস্থায় আনা হয়।
তাদের মধ্যে পরিচয় পাওয়া কয়েকজন হলেন- সোহরাওয়ার্দী কলেজের উচ্চ মাধ্যমিক প্রথম বর্ষের রাজীব (১৯) ও দ্বিতীয় বর্ষের শাহেদুল (২০); কবি নজরুল সরকারি কলেজের উচ্চ মাধ্যমিক প্রথম বর্ষের রানা (২০), মারুফ (১৯), রুমান (১৯), হাসিনুর (১৯), আরাফাত (১৯); একই কলেজের স্নাতক প্রথম বর্ষের অনুপম দাস (২৩) ও দ্বিতীয় বর্ষের সুমন (২২) এবং ইম্পেরিয়াল কলেজ হাতিরঝিল শাখার উচ্চ মাধ্যমিক প্রথম বর্ষের হুমায়ুন (২০)।
এছাড়া সংঘর্ষে আহত হয়ে ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে গেছেন সোহরাওয়ার্দী ও নজরুল কলেজের অন্তত ৩০ শিক্ষার্থী।
তাদের মধ্যে পরিচয় পাওয়া কয়েকজন হলেন- নাইম (২০), সিয়াম (১৯), মোল্লা সোহাগ (১৮), রাজিম (১৭), শরিফুল (১৭), জাহিদ (২৫), মোস্তফা (২৩), রাতুল (২১), শফিকুল ইসলাম (২৬), মেহেদী হাসান (২৪), সজীব বেপারী (২৮), ফয়সাল (১৯), সাগর (২১), ইমন (২৪), সিয়াম (১৮)।
ন্যাশনাল মেডিক্যালের জরুরি বিভাগের চিকিৎসক মাহমুদ বিকাল সোয়া ৩টায় বলেন, এখন পর্যন্ত প্রায় ৩০ জন আহত এসেছে আমাদের কাছে। এদের মধ্যে ১০ জনের অবস্থা গুরুতর।
সেন্ট গ্রেগরী স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষার্থী নাজমুল ইসলাম বলেন, “হঠাৎ করে একদল পোলাপান এসে আমাদের কলেজে কলেজে হামলা চালায়। কিছু বুঝে ওঠার আগেই তারা কলেজ বিল্ডিংয়ের কাঁচের গ্লাস, চেয়ার, টেবিল এসব ভাঙচুর করে।
“আমাদের শ্রেণিকক্ষ, অধ্যক্ষের রুমের দরজা, শিক্ষকরুমসহ প্রায় ৩০/৪০টি কক্ষে তারা ভাঙচুর করেছে। কলেজের দ্বিতীয় তলায় একটি কক্ষে তারা আগুন ধরিয়ে দেয়।”
এ হামলার নিন্দা জানিয়ে সেন্ট গ্রেগরী স্কুল কর্তৃপক্ষ এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলেছে, “সেন্ট গ্রেগরী হাই স্কুল এন্ড কলেজে বহিরাগত ৩০/৩৫ জন উশৃঙ্খল যুবক নিরাপত্তা বেষ্টনী অতিক্রম করে সন্ত্রাসী কায়দায় হামলা, ভাঙচুর, লুটপাট চালিয়েছে। এ সময় তারা নিরাপত্তাকর্মী নাজমুল হক ও সুমন গোমেজকে ব্যাপক মারধর করে।
“গুরুতর আহত অবস্থায় তাদের উদ্ধার করে সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজে ভর্তি করা হয়েছে। সেন্ট গ্রেগরি হাই স্কুল এন্ড কলেজ এই সন্ত্রাসী হামলার তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাচ্ছে।'