পোল্যান্ডে উচ্চশিক্ষায় যেতে আগ্রহী বাংলাদেশি শিক্ষার্থীরা দিল্লিতে থাকা পোলিশ দূতাবাসে ভিসার জন্য দরকারি সব কাগজপত্র জমা দিয়েও দিনের পর দিন অপেক্ষায় থেকে খালি হাতে ফিরছেন। অনেকে চাকরি নিয়েও পাড়ি দিতে চান। এ জন্য ভিসা ফি বাবদ ১৭ হাজার এবং আপিল বাবদ ১৩ হাজার রুপি জমা এবং ভারতে থাকা ও খাওয়া বাবদ বিপুল ব্যয় করে শেষ পর্যন্ত খালি হাতে ফিরতে হচ্ছে ৮০ শতাংশের বেশি বাংলাদেশি আবেদনকারীকে। এমনকি ভিসা না দেয়ার পেছনে কোনো কারণও দেখাচ্ছে না পোলিশ দূতাবাস। ফলে পোলিশ ভিসার আবেদন করা বাংলাদেশি শিক্ষার্থীরা বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন বলে অভিযোগ করেছেন।
উচ্চশিক্ষায় আগ্রহীদের ক্ষেত্রে পশ্চিমা দেশগুলোর প্রতি শিক্ষার্থীদের আগ্রহ প্রবল। এ জন্য দীর্ঘ প্রস্তুতি নিতে হয়। ভাষা দক্ষতার সনদসহ কাঙ্ক্ষিত বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছ থেকে অফার লেটার জোগাড় পর্যন্ত একজন শিক্ষার্থীকে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়। কিন্তু এত কিছু করেও যদি ভিসার জন্য সাক্ষাৎকারের ডাক না পাওয়া যায় এবং এই ডাক না পাওয়ার কোনো সুস্পষ্ট কারণও তাকে জানানো না হয়, তবে হতোদ্যম হওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় থাকে না।
পোল্যান্ডের কোনো দূতাবাস বাংলাদেশে নেই। যেসব বাংলাদেশি চাকরি কিংবা পড়ালেখার জন্য দেশটিতে যেতে চান, তাদের ভিসার জন্য যেতে হয় দিল্লিতে। সেখানে পোল্যান্ডের যে দূতাবাস আছে, সেখানে প্রয়োজনীয় সব কাগজপত্রসহ ভিসার আবেদন করতে হয়।
পোল্যান্ডে যেতে ইচ্ছুক বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের অনেকেই দূতাবাসটির বিরুদ্ধে বৈষম্যমূলক আচরণের অভিযোগ এনেছেন। তাদের দাবি, সব শর্ত পূরণ করে দিনের পর দিন অপেক্ষার পরও সাক্ষাৎকারের জন্য ডাক পাননি তারা। অনেকে একাধিকবার আবেদন করেও পাননি দেশটির ভিসা ।
শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, শুধু বাংলাদেশি হওয়ার কারণে পোলিশ দূতাবাসের এমন আচরণ। ভারত, নেপাল কিংবা শ্রীলঙ্কার শিক্ষার্থীদের তুলনায় বাংলাদেশিদের ভিসা প্রাপ্তির হারও উল্লেখযোগ্য হারে কম।
অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলছে, বিষয়টি তাদের জানা নেই। অভিযোগ সত্য হলে কূটনৈতিক উদ্যোগ নেয়া হবে।
বেসরকারি নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবু (ছদ্মনাম) জানান, পোল্যান্ডের ওয়ারশ স্কুল অব ইকোনোমিকসে ভর্তি নিশ্চিত হওয়ার পর প্রয়োজনীয় কাগজপত্র নিয়ে তিনি দিল্লির পাহাড়গঞ্জে অবস্থিত পোল্যান্ড দূতবাসে ভিসা আবেদন করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের অফার লেটার এবং ভর্তি ফি জমা দেয়ার পরও তিনি ভিসা পাননি।
আবু অভিযোগ করে বলেন, ‘আমি দুবার রিজেক্ট হয়েছি। আমাকে কেনো রিজেক্ট করা হয়েছে বলেনি। আমার ব্যাংক সলভেন্সি, অফার লেটার সব ছিলো। তবুও ভিসা হয়নি।’
নিজের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে তিনি বলেন, ‘ভারতের ডাবল এন্ট্রি ভিসা নিয়ে ভারতে গিয়েছিলাম। আমার ফাইল সাবমিটের পর ১ মাস হোল্ডে রেখেছিলো পোলিশ অ্যাম্বাসি। পরে আমাকে বলেছে, আমার ইনটেনশন ক্লিয়ার না। প্রথমবার রিজেক্ট করার পর আমি আপিল করি। কিন্তু তারপরও আমাকে সাক্ষাৎকারের জন্য ডাকেনি। আমার সঙ্গে আরো যারা ছিলেন, অনেকের ক্ষেত্রে আপিলের পর সাক্ষাৎকারের ডাক এসেছিলো। দ্বিতীয়বার আমি আর আপিল করিনি।’
‘এখানে বাংলাদেশিদের মধ্যে ৭০ থেকে ৮০টি আবেদনের থেকে হয়তো ১–২টা ভিসা হয়। প্রথমে রিজেক্ট করলে পরে অনেকে আপিল করেন। কিন্তু তাতেও সবক্ষেত্রে কাজ হয়না। আমাকে যিনি রিজেক্ট করেছিলেন, তিনি সম্ভবত মুসলিম বিদ্বেষী। আমি পরে বিষয়টি আমার অ্যাডভাইজারকে জানালে তিনি তাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে অ্যাম্বাসির বিরুদ্ধে কমপ্লেইন করেন।’
আবু মনে করছেন, পুরো বিষয়টিই সাধারণ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে এক ধরনের প্রতারণা। তিনি বলেন, ‘পাহাড়গঞ্জ এলাকাটিতেই ইউরোপের দেশগুলোর দূতাবাসগুলো রয়েছে। একেকজন ভিসা প্রত্যাশীকে এখানে ৩ থেকে ৬ মাস পর্যন্ত অবস্থান করতে হয়। কারণ, আপনি যখন পোলিশ অ্যাম্বাসিতে আবেদন করবেন, তারা আপনার পাসপোর্ট রেখে দেবে। ফলে আপনি দেশেও ফিরতে পারবেন না। কবে পাসপোর্ট ফেরত পাবেন, তার কোনো নির্দিষ্ট সময় নেই। এই সময়ের মধ্যে অনেকেরই ভারতের ভিসা শেষ হয়ে যায়। তখন জরিমানা দিয়ে ভিসা বাড়াতে হয়। আর থাকা–খাওয়ার খরচের কথা তো বাদই দিলাম। ভারতে যাওয়া থেকে পাসপোর্ট ফেরত পাওয়া পর্যন্ত একেকজনের কয়েক লাখ টাকা পর্যন্ত খরচ হয়ে যায়। তারপরও আপনি ভিসা পাবেন না। সব মিলিয়ে আমার ৭ লাখ টাকার মতো খরচ হয়েছে। ভিসা পাইনি।’
বাংলাদেশ বিষয়ে পোলিশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অবস্থান স্পষ্ট করা উচিত উল্লেখ করে আবু বলেন, ‘আমার সোজা কথা, পোল্যান্ড যদি মনে করে তারা বাংলাদেশ থেকে কাউকে নেবে না সেটা তাদের সরাসরি বলে দেয়া উচিত। এখানে মানুষকে হয়রানি করা তো সভ্য আচরণ নয়।’
আবুর মতো অনেক শিক্ষার্থীই পোল্যান্ডের ভিসা পাওয়ার ক্ষেত্রে ব্যাপক ভোগান্তিতে পড়েছেন। লাখ লাখ টাকা খরচ করেও ভিসা পাননি। এদের সবার অভিজ্ঞতা প্রায় একই। চলমান পরিস্থিতিতে ভারতের ভিসা বন্ধ থাকায় এই সংকট আরো বেড়েছে।
এমনই আরেক ভুক্তভোগী নরসিংদীর কামরুল ইসলাম শাকিল। তিনি পোল্যান্ডে যেতে ব্যর্থ হয়ে এখন লিথুয়ানিয়ায় যাওয়ার চেষ্টা করছেন।
শাকিল বলেন, ‘ফ্রোকলো বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্টার্সে ভর্তি হয়েছিলাম। এরপর দিল্লিতে গিয়ে পোল্যান্ড অ্যাম্বাসিতে আবেদন করি। আমার কোনো সাক্ষাৎকার তারা নেয়নি। ২৯ দিন পর পাসপোর্ট ফেরত দিয়ে জানায় আমার যাওয়ার উদ্দেশ্য পরিষ্কার না। পরে আমি আপিল করি। তখনও আমার সাক্ষাৎকার নেয়নি। ‘উদ্দেশ্য পরিষ্কার না’ কারণের সঙ্গে তখন আরো দুটো কারণ যোগ করেছে। বলেছে, আমার ব্যাংক সলভেন্সি নেই এবং আমার সার্টিফিকেট আসল নয়। এটাই যদি কারণ হয়, তাহলে শুরুতেই কেনো বলা হলো না?’
শাকিলের ভাষ্য, ‘আমি আমার ব্যাংকে দেড় হাজার ডলার ব্যালেন্স দেখিয়েছি। ক্রেডিট কার্ডে ৫ হাজার ডলারের মতো ছিলো। মজার বিষয় হলো, আমার চেয়েও কম টাকা দেখানো অনেককেই আবার ব্যাংক সলভেন্সির কথা বলেনি। তাদের ভিসা বাতিল করেছে অন্য কারণ দেখিয়ে।’
শাকিল বলেন, ‘ভারতের ভিসা পেতেই একেকজনের ৫০ থেকে ৬০ হাজার টাকা খরচ হয়ে যায়। এর পরে ভারতে গিয়ে থাকা–খাওয়ার খরচ তো আছেই। আমার পুরো আড়াই লাখ টাকা, পানিতে গেছে।’
এই দুই শিক্ষার্থী যে বিড়ম্বনায় পড়েছেন, এটা যে নতুন কিছু নয় তা জানা গেলো একজন পোলিশ স্টুডেন্ট কাউন্সিলরের কাছ থেকে। তিনি বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে যারা পোল্যান্ডে পড়তে যান, তাদের পরামর্শক হিসেবে কাজ করেন।
জোয়ানা নামের এই নারী গবেষক জানান, তিনি নিজেও বিষয়টি নিয়ে পোল্যান্ডের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে অভিযোগ করেছেন। তিনি বলেন, ‘আমি পোল্যান্ডের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে আসা বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের প্রক্সি হিসেবে কাজ করেছি। আমার শিক্ষার্থীর ভিসা আবেদন ছিলো শতভাগ নির্ভুল। পাশাপাশি তাদের কাছে ভর্তির জন্য প্রয়োজনীয় অফার লেটারও ছিলো। কিন্তু ভিসা হয়নি।’
জোয়ানা বলেন, ‘আমার শিক্ষার্থী দিল্লিতে ৪৫ দিন ছিলেন। তারপরও তাকে সাক্ষাৎকারের জন্য ডাকা হয়নি। তার কোনো কাগজও পরীক্ষা করেনি। এটা শুধু তার ক্ষেত্রে না। ৮০ ভাগ বাংলাদেশির আবেদন বাতিল হয়ে যায়, শুধু তাদের পরিচয়ের কারণে। হয়তো পোলিশ সরকার মনে করে, এখানে বাংলাদেশিদের আসার প্রয়োজন নেই। আমি যখন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে যোগাযোগ করি, তখন আমাকে ভুল তথ্য দেয়া হয়। বাংলাদেশিদের ক্ষেত্রে এমন আচরণে পোলিশ হিসেবে আমি লজ্জিত।’
‘আমার মনে হয় বাংলাদেশ সরকারের ঢাকায় আলাদা দূতবাসের দাবি জানানো উচিত। বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের হয়রানির বিষয়টি পুরোপুরি রাজনৈতিক। আলাদা দূতাবাস হলে আমার মনে হয় এই হয়রানি আর হবে না।’ বিষয়টি নিয়ে দিল্লির পোলিশ দূতাবাসের সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়নি।
এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে বাংলাদেশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রফিকুল ইসলাম জানান, পোলিশ দূতাবাসে বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণের বিষয়টি তাদের জানা নেই।
তিনি বলেন, ‘আমাদের যে কনসার্ন উইং আছে ইস্ট ইউরোপের জন্য, তাদরে সঙ্গে চেক করে দেখবো। যদি এ রকম বৈষম্যের শিকার হয়ে থাকে তাহলে এটা অবশ্যই কূটনৈতিকভাবে টেকআপ করা হবে।’