শিক্ষা উপদেষ্টার কড়া ধমকের পর কর্মতৎপরতা বাড়িয়েছেন বিভিন্ন প্রেস মালিকসহ পাঠ্যপুস্তক মুদ্রণের দায়িত্ব পাওয়া সব পর্যায়ের প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তিরা। গতকাল বৃহস্পতিবার সচিবালয়ে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের সম্মেলন কক্ষে পাঠ্যপুস্তক মুদ্রণ, বাঁধাই, বিতরণ ও সরবরাহ কার্যক্রম অগ্রগতি পর্যালোচনা সভায় শিক্ষা উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ আসন্ন ২০২৫ শিক্ষাবর্ষের পাঠ্যবই ছাপানোর কাজ শেষ করে সরবাহের সময় বেঁধে দেন বলে জানায় একাধিক সূত্র। পরে শিক্ষা মন্ত্রণালয় এক বিজ্ঞপ্তিতে বৈঠকের বিষয়ে বিস্তারিত জানায়। তবে ওই বৈঠকের পরই জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডে (এনসিটিবি) জরুরি বৈঠকে বসেন পাঠ্যবই মুদ্রণের দায়িত্ব পাওয়া প্রেস মালিকসহ সংশ্লিষ্টরা। সেখানে তারা উপদেষ্টার নির্দেশিত সময়ে বই ছাপানোর কাজ শেষ করার কর্মকৌশল নিয়ে আলোচনা করেন বলে জানা গেছে।
এর আগে মুদ্রণের দায়িত্ব পাওয়া প্রতিষ্ঠানগুলো নানা অজুহাতে বই ছাপানোর কাজ ধীরগতিতে এগিয়ে নিচ্ছিলেন। অনেকে দরপত্রের শর্তের কেয়ার না করে নিম্নমানের কালি ও কাগজে বই ছাপাচ্ছিলেন। এসব কারণে দুই দফায় প্রায় ৮০ হাজার মুদ্রিত বই বাজেয়াপ্ত করা হলেও মুদ্রণের দায়িত্ব পাওয়া প্রতিষ্ঠানগুলো নানা ধরনের গড়িমসি করে ঢিমে তালে বই ছাপানোর কাজ করছিলেন। ফলে যথাসময়ে শিক্ষার্থীদের হাতে বই তুলে নেয়া নিয়ে শঙ্কা তৈরি হয়।
এমন পরিস্থিতিতে গতকালের সভায় পাঠ্যপুস্তক মুদ্রণ, বাঁধাই, বিতরণ ও সরবরাহ কার্যক্রম দ্রুত শেষ করতে কঠোর অবস্থান নেয় শিক্ষা প্রশাসন। এ সময় ছাপাখানার মালিকরা কাগজ পাওয়া যাচ্ছে না বলে অভিযোগ দিলেও তা ধোপে টেকেনি। এনসিটিবি কর্তৃপক্ষ কাগজের কোনো ঘাটতি নেই বলে ছাপাখানার মালিকদের সামনেই তথ্য তুলে ধরেন।
সার্বিক পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে আগামী ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে প্রাথমিকের সব বই ছাপা শেষ করে স্কুলে পৌঁছানোর কড়া নির্দেশ দেন শিক্ষা উপদেষ্টা। একই সঙ্গে ১ জানুয়ারি মধ্যে ছাপা শেষ করে মাধ্যমিকের তিনটি আবশ্যিক বই শিক্ষার্থীদের হাতে তুলে দেয়ার জোর তাগিদ দেন তিনি। এ ছাড়া ২০ জানুয়ারির মধ্যে মাধ্যমিকের সব শ্রেণির সব বই ছাপা শেষ করার নির্দেশ দেন।
শিক্ষা উপদেষ্টা বলেন, যথাসময়ে পাঠ্যপুস্তক মুদ্রণ, বাঁধাই, বিতরণ ও সরবরাহ করে ছাত্রছাত্রীদের নিকট পৌঁছে দেয়া বর্তমান সরকারের একটি অন্যতম অগ্রাধিকারমূলক কাজ। এ বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে আমরা দ্রুততম সময়ের মধ্যে বিভিন্ন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেছি।
তিনি বলেন, প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বই ছাপানোর কাজ অনেক দূর এগিয়ে গেছে এবং যথাসময়ে শিক্ষার্থীদের নিকট পৌঁছানো যাবে। তবে মাধ্যমিক শ্রেণির পাঠ্যপুস্তক ছাপানোর কাজ একটু ধীরগতির হওয়ায় এ কার্যক্রম ত্বরান্বিত করতে সংশ্লিষ্টদের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।
সভায় প্রেস মালিকরা তাদের বিভিন্ন সমস্যার কথা তুলে ধরেন। শিক্ষা উপদেষ্টা তাদের এসব সমস্যা দ্রুত সমাধানের আশ্বাস দেন এবং জাতীয় স্বার্থে পাঠ্যপুস্তক দ্রুত ছাপানোর আহ্বান জানান।
এ সময় নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় এবং শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) ড. এম সাখাওয়াত হোসেন, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের বিশেষ সহকারী (প্রতিমন্ত্রীর পদমর্যাদা) অধ্যাপক ড. এম আমিনুল ইসলাম, মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের সিনিয়র সচিব সিদ্দিক জোবায়ের, কারিগরি ও মাদরাসা শিক্ষা বিভাগের সচিব ড. খ ম কবিরুল ইসলাম, জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড এর চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. এ কে এম রিয়াজুল হাসান, বিভিন্ন প্রিন্টিং প্রেসের প্রতিনিধিরা এবং মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
প্রসঙ্গত, গত ৫ আগস্ট রজনৈতিক পট পরিবর্তনের পরে এবার ১২ বছর আগের শিক্ষাক্রমে ফিরছে প্রাথমিক-মাধ্যমিকের শিক্ষাব্যবস্থা। ফলে নতুন বছরে ছাপা মোট বইয়ের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪০ কোটি ১৬ লাখ। বেড়েছে বাজেটও। উপরন্তু, গত কয়েক বছরে পাঠ্যবই ভারতে ছাপা হলেও আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পরের বাস্তবতায় এবার দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলোই ছাপার কাজ করছে। সব কিছু গুছিয়ে আওয়ামী আমলের দরপত্র বাতিল করে নতুন করে দরপত্র দেয় সরকার পক্ষ। কিন্তু, প্রেস প্রতিষ্ঠানগুলো নানা অজুহাতে মুদ্রণ কাজে ঢিমে তাল প্রকট হয়ে ওঠে। এখন অবধি মুদ্রণ কাজের সার্বিক অগ্রগতি হতাশাজনক। এমনকি কোনো কোনো প্রেস নিম্নমানের কাগজ ও কালিতে বই ছাপতে শুরু করে।
গত ১০ ডিসেম্বর কুমিল্লার দাউদকান্দিতে ফরাজী প্রেস অ্যান্ড পাবলিকসন্সে নিম্নমানের কাগজে ছাপানো প্রায় ৩০ হাজার কপি প্রাথমিকের পাঠ্যবই হাতেনাতে ধরে বাতিল করে এনসিটিবির মনিটরিং টিম। কাগজের বার্স্টিং ফ্যাক্টর না মানায় ও উজ্জ্বলতা কম হওয়ায় শোকজও করা হয় ফরাজী প্রেসকে।
তার আাগে ৫ ডিসেম্বর নিম্নমানের কাগজে পাঠ্যবই ছেপে হাতেনাতে ধরা পড়ে অগ্রণী প্রিন্টিং প্রেস ও কর্ণফুলী আর্ট প্রেস। নোয়াখালীর চৌমুহনীতে গিয়ে এই দুটি প্রেসে নিম্নমানের কাগজে ছাপানো প্রাথমিকের পাঠ্যবইও হাতেনাতে ধরেন এনসিটিবি কর্মকর্তারা। দুটি প্রেসের প্রায় ৫০ হাজার পাঠ্যবই বাতিল করা হয়।
গত কয়েক বছরে পাঠ্যবই ভারতে ছাপা হলেও আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পরের বাস্তবতায় এবার দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলোই ছাপার কাজ করছে। কিন্তু এখনো মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের বই ছাপার কাজই শুরু করতে পারেনি বেশিরভাগ ছাপাখানা। প্রাথমিকের তিনটি শ্রেণির বই ছাপার কাজও কাগজ সংকটে চলছে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে।