পাঠ্যবই ছাপানোর জন্য কাগজের কৃত্রিম সংকট তৈরিতে দায়ীদের বিরুদ্ধে এবার কঠোর ব্যবস্থা নিতে যাচ্ছে সরকার। কাগজের সংকট বলে বিভিন্ন প্রচার ও গণমাধ্যমে অপপ্রচার করানোর দায়ে কালোতালিকাভুক্ত করা হচ্ছে কয়েকটি ছাপাখানাকে। ইতোমধ্যে এই ঘটনায় জড়িত ছাপাখানার কয়েকজন মালিক, জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডে (এনসিটিবি) কর্মরত শিক্ষা ক্যাডার কর্মকর্তা চিহ্নিত হয়েছেন। সাবেক শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনির পছন্দের এনসিটিবির সাবেক চেয়ারম্যান ফরহাদুল ইসলাম ও ও সচিব নাজমা আখতারের সিন্ডিকেটের হয়ে কাজ করছেন কয়েকজন কর্মকর্তা। দুটি সংস্থায় কর্মরত ছাত্রলীগের সাবেক কতিপয় নেতাও এনসিটিবির অভিযুক্ত কর্মকর্তাদের এবং আওয়ামী লীগপন্থী ছাপাখানা মালিকদের রক্ষা করার জন্য ফরমায়েশি রিপোর্ট দিচ্ছেন বলে অভিযোগও পাওয়া যাচ্ছে। একাধিক সূত্র দৈনিক আমাদের বার্তাকে এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
জানা গেছে, জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডে কর্মরত শিক্ষা ক্যাডার কর্মকর্তাদের অধিকাংশই আওয়ামী লীগ আমলের অথবা দীপু মনি সিন্ডিকেটের। আর বই ছাপার ঠিকাদারদের মধ্যে অধিকাংশই আওয়ামী লীগপন্থী অথবা বিএনপি জামায়াতপন্থী হলেও দীপু মনি সিন্ডিকেটের থেকে সুবিধা নিয়েছেন। এসব অবৈধ সুবিধাভোগীর বিরুদ্ধে এবার সোচ্চার হয়েছে সংশ্লিষ্ট সবাই। সরকারের বেঁধে দেয়া সময়ের মধ্যে বই না দিলে অভিযুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোকে কালো তালিকাভুক্ত করে তাদের প্রতিষ্ঠানগুলো ঘেরাও করা হবে। তাদের ব্যবসায়িক লাইসেন্স বাতিল করতে সারাদেশে অভিভাবকরা মিছিল সমাবেশ করবেন।
এর আগে মুদ্রণের দায়িত্ব পাওয়া প্রতিষ্ঠানগুলো নানা অজুহাতে বই ছাপানোর কাজ ধীরগতিতে এগিয়ে নিচ্ছিলেন। অনেকে দরপত্রের শর্তের কেয়ার না করে নিম্নমানের কালি ও কাগজে বই ছাপাচ্ছিলেন। এসব কারণে দুই দফায় প্রায় ৮০ হাজার মুদ্রিত বই বাজেয়াপ্ত করা হলেও মুদ্রণের দায়িত্ব পাওয়া প্রতিষ্ঠানগুলো নানা ধরনের গড়িমসি করে ঢিমে তালে বই ছাপানোর কাজ করছিলেন। ফলে যথাসময়ে শিক্ষার্থীদের হাতে বই তুলে নেয়া নিয়ে শঙ্কা তৈরি হয়।
এমন পরিস্থিতিতে গত বৃহস্পতিবারের এক সভায় পাঠ্যপুস্তক মুদ্রণ, বাঁধাই, বিতরণ ও সরবরাহ কার্যক্রম দ্রুত শেষ করতে কঠোর অবস্থান নেয় শিক্ষা প্রশাসন। এ সময় এনসিটিবি কর্তৃপক্ষ কাগজের কোনো ঘাটতি নেই বলে ছাপাখানার মালিকদের সামনেই তথ্য তুলে ধরেন।
সার্বিক পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে আগামী ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে প্রাথমিকের সব বই ছাপা শেষ করে স্কুলে পৌঁছানোর কড়া নির্দেশ দেন শিক্ষা উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ। একই সঙ্গে ১ জানুয়ারি মধ্যে ছাপা শেষ করে মাধ্যমিকের তিনটি আবশ্যিক বই শিক্ষার্থীদের হাতে তুলে দেয়ার জোর তাগিদ দেন তিনি। এ ছাড়া ২০ জানুয়ারির মধ্যে মাধ্যমিকের সব শ্রেণির সব বই ছাপা শেষ করার নির্দেশ দেন।
শিক্ষা উপদেষ্টা বলেন, যথাসময়ে পাঠ্যপুস্তক মুদ্রণ, বাঁধাই, বিতরণ ও সরবরাহ করে ছাত্র-ছাত্রীদের কাছে পৌঁছে দেয়া বর্তমান সরকারের একটি অন্যতম অগ্রাধিকারমূলক কাজ। এ বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে আমরা দ্রুততম সময়ের মধ্যে বিভিন্ন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেছি।
তিনি বলেন, প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বই ছাপানোর কাজ অনেক দূর এগিয়ে গেছে এবং যথাসময়ে শিক্ষার্থীদের কাছে পৌঁছানো যাবে। তবে মাধ্যমিক শ্রেণির পাঠ্যপুস্তক ছাপানোর কাজ একটু ধীরগতির হওয়ায় এ কার্যক্রম ত্বরান্বিত করতে সংশ্লিষ্টদের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।
প্রসঙ্গত, বর্তমান সরকারের সংস্কারের অংশ হিসাবে আগের শিক্ষাক্রম স্থগিত করে ২০১২ এর শিক্ষাক্রমের ভিত্তিতে বিভিন্ন শ্রেণির পাঠ্যবই পরিমার্জন করা হয়েছে। ২০২৫ খ্রিষ্টাব্দের জানুয়ারিতেই শিক্ষার্থীরা এসব বই হাতে পাওয়ার কথা থাকলেও তা ছাপাখানার মালিকদের ঢিলেমিতে ভেস্তে যাবে বলে আশঙ্কা রয়েছে। গত ৫ আগস্ট রজনৈতিক পট পরিবর্তনের পরে এবার ১২ বছর আগের শিক্ষাক্রমে ফিরছে প্রাথমিক-মাধ্যমিকের শিক্ষাব্যবস্থা। ফলে নতুন বছরে ছাপা মোট বইয়ের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪০ কোটি ১৬ লাখ। উপরন্তু, গত কয়েক বছরে বিপুল সংখক পাঠ্যবই ভারতে ছাপা হলেও আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পরে এবার পুরোটাই দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলোই ছাপার কাজ করছে। সব কিছু গুছিয়ে আওয়ামী আমলের দরপত্র বাতিল করে নতুন করে দরপত্র দেয় সরকার পক্ষ। কিন্তু, নানা অজুহাতে মুদ্রণ কাজে প্রেস প্রতিষ্ঠানগুলোর ঢিলেমি প্রকট হয়ে ওঠে। আবার দীপু মনি সিন্ডিকেটের কতিপয় প্রচার মাধ্যমে নেতিবাচক প্রচার চালানো হয়।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, প্রাথমিকের পাঠ্যবই ১৫ ডিসেম্বরের মধ্যে ছাপানো শেষ হওয়ার কথা, কিন্তু তা হয়নি। এখন অবধি মুদ্রণ কাজের সার্বিক অগ্রগতি হতাশাজনক। এমনকি কোনো কোনো প্রেস নিম্নমানের কাগজ ও কালিতে বই ছাপতে শুরু করে।
নিম্নমানের কাগজে ছাপানোয় ৮০ হাজার পাঠ্যবই ইতোধ্যে বাতিল করা হয়েছে। এর মধ্যে গত ১০ ডিসেম্বর কুমিল্লার দাউদকান্দিতে ফরাজী প্রেস অ্যান্ড পাবলিকসন্সের নিম্নমানের কাগজে ছাপানো প্রায় ৩০ হাজার কপি প্রাথমিকের পাঠ্যবই হাতেনাতে ধরে বাতিল করে এনসিটিবির মনিটরিং টিম। কাগজের বার্স্টিং ফ্যাক্টর না মানায় ও উজ্জ্বলতা কম হওয়ায় শোকজও করা হয় ফরাজী প্রেসকে। এর আগে আরো চারটা প্রেসের ৭০ হাজার বই বাতিল করা হয়।