দেশে উচ্চ শিক্ষার সুযোগ ও সম্ভাবনার বিকাশ এবং কার্যক্রম তদারকির সর্বোচ্চ প্রতিষ্ঠান বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন (ইউজিসি)। ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে রাষ্ট্র কাঠামাতে সাম্প্রতিক বৈপ্লবিক পরিবর্তনের পর প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পেয়েছেন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ প্রফেসর ড. এস এম এ ফায়েজ। এর আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিসহ শিক্ষা সংশ্লিষ্ট অনেক গুরুত্বপূর্ণ পদে সফলভাবে দায়িত্ব পালনের অভিজ্ঞা আছে তার। ইউজিসিতে যোগ দিয়েই উচ্চ শিক্ষার মান উন্নয়নে বাস্তবমুখী নানা পদক্ষেপ গ্রহণের প্রস্তুতি নিচ্ছেন তিনি। সম্প্রতি তার মুখোমুখি হয়েছিলো দৈনিক আমাদের বার্তা। তার সঙ্গে দীর্ঘ কথোপকথনের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সংশ্লিষ্ট অংশ আজ তুলে ধরা হলো পাঠকদের জন্য। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন সিনিয়র রিপোর্টার মিথিলা মুক্তা
আমাদের বার্তা: গত ১৫ বছরে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাবশালী মালিকরা ইউজিসিকে নিজেদের মতো করে ব্যবহার করেছে। বিষয় অনুমোদন, ক্যাম্পাস খোলা, যোগ্যতা না থাকলেও ভিসি পদে নিয়োগ পাওয়া, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের রিজার্ভ ফান্ডের অপব্যবহার ইত্যাদি ক্ষেত্রে অনিয়মের অনেক ঘটনাও আমরা জানি। এ বিষয়ে ইউজিসির পক্ষ থেকে এখন কি ব্যবস্থা নেবেন?
এস এম এ ফায়েজ: এমন অনিয়ম হয়েছে, হচ্ছে- কিছু অনিয়মের খবর তো আমরাও জানি। কিন্তু ইউজিসিকে সম্পৃক্ত করে অনিয়ম- এরকম কোনো প্রমাণ আমাদের কাছে নেই। কিন্তু যদি দেখা যায়, ইউজিসির কেউ কোনোভাবে কোনো অনিয়মে সম্পৃক্ত হয়েছিল, অথবা অনিয়মের সহযোগী হয়েছিলো, সেটাকে অবশ্যই আমরা যথাযথভাবে যাচাই করবো। তারপর আমাদের তরফ থেকে যে পদক্ষেপ নেয়া দরকার সেটা অবশ্যই করবো। তবে আমরা বেশি গুরুত্ব দেব ভবিষ্যতে যেনো সবকিছু ট্রান্সপারেন্ট থাকে। অনেস্টির দিকটি যেনো ক্লিয়ার থাকে। আর একটা বিষয় হচ্ছে, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সাথে যারা সম্পৃক্ত তারা যেহেতু একটা মডেল রেসপনসিবিটি, সামাজিক দায়বদ্ধতা ধারণ করে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সাথে সম্পৃক্ত হয়েছেন, সেই জায়গা থেকে তারা যেনো পিছিয়ে না আসেন। বিশ্ববিদ্যালয় কিন্তু ব্যবসা প্রতিষ্ঠান না। এটা তাদের (বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোক্তা) সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে করতে হবে। সমাজ তাদেরকে অনেক কিছু দিয়েছে। আবার সমাজকে ফিরিয়ে দিতে হবে তাদের। এই যে শিক্ষার্থীরা স্বৈরাচার পতনে এতো কন্ট্রিবিউশন রাখলেন, তাদের ভবিষ্যৎ বিবেচনায় নিয়ে আমাদের ফুললি অনেস্ট থাকতে হবে। ট্রান্সপারেন্ট থাকতে হবে। জবাবদিহিতার জায়গায় কোনো ঘাটতি থাকতে পারবে না।
২০০৪ খ্রিষ্টাব্দে ওই সময়কার ইউজিসি চেয়ারম্যান ডক্টর এম আসাদুজ্জামানের নেতৃত্বে ৯ সদস্যের একটা কমিটি গঠন করা হয়েছিল। সেই কমিটি সব প্রাইভেট ইউনিভার্সিটি তদন্ত করে একটা প্রতিবেদন দিয়েছিল। ওইরকম কোনো কমিটি করবেন কিনা।
সেই সময় যে কমিটি করা হয়েছিল সেটাকে আমি অ্যাপ্রিসিয়েট করব। কিছু সিদ্ধান্ত এসেছে ওই কমিটি থেকে এবং সেগুলো বাস্তবায়িত হয়েছে বলে আমি অবহিত আছি। প্রয়োজন হলে অবশ্যই আমরাও কমিটি করবো। we are waiting for other member to come. যখন ফুল কমিশন গঠিত হবে সেই সময় আমরা অবশ্যই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবো। আমরা মানের দিক দিয়ে, কোয়ালিটি অব এডুকেশনে কম্প্রোমাইজ করবো না। যেখানে কোয়ালিটি অব এডুকেশন এনশিওর করতে পারছে না। তাদের বিষয়ে কি করনীয় সে বিষয়ে অবশ্যই আমরা ব্যবস্থা নেবো। সেটা নিয়ে যদি কমিটি গঠন করতে হয় তবে স্ট্রং কমিটি গঠিত হবে। অন্য যে কোনো ব্যবস্থা নিতে হলে, আমরা পিছপা হবো না।
ইউজিসির অনেক কর্মকর্তা বিভিন্ন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে খণ্ডকালীন চাকরি করেন। ইউজিসি'র অনেক কর্মকর্তার আত্মীয়-স্বজনকে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় চাকরি দেওয়া হয়। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সংক্রান্ত যে কোনও সিদ্ধান্ত আগেভাগে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সমিতির কাছে চলে যায়। ফলে ইউজিসি অনেক সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। গত ১৫ বছরে এমন অনেক ঘটনা ঘটেছে। এসব অঘটন ঠেকাতে কি ব্যবস্থা নেবেন ।
আমাদের যারা কর্মকর্তা, তারা অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে কতটুকু সম্পৃক্ত এটা অবশ্যই আমরা খুব সচেতনতার সাথে লক্ষ্য করি। এরকম কিছু এখনো আমরা পাইনি। কোনও একজন কর্মকর্তা খণ্ডকালীন কিছু জায়গায় কাজ করছেন, এরকম কিছু কিন্তু আমাদের দৃষ্টিতে এখনো আসেনি। আমাদের গোচরে আনা হয়নি, যদি আসে অবশ্যই আমরা শক্তভাবে ব্যবস্থা নেবো। আরেকটা যেটা বললেন যে আমাদের সিদ্ধান্ত আগেই সমিতি জেনে ফেলে, সমিতি কিন্তু আমাদের প্রতিপক্ষ না। সঠিক অবস্থানে যাওয়ার জন্য তারা আমাদেরকে সহযোগিতা করবে, আমরাও তাদের সহযোগিতা করবো। যে সিদ্ধান্ত নেয়া হচ্ছে সেগুলো যথাযথভাবে বাস্তবায়িত হচ্ছে কিনা প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে সেটি কিন্তু সমিতি দেখভাল করতে পারে। সে ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার পরে তাদেরকে আমরা অবহিত করবো এবং তাদেরকে ডেফিনিটলি আমরা বলবো- তোমরাও এখানে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দাও। এখানেই তাদের কো-অপারেশন প্রয়োজন আমাদের।
আওয়ামী লীগ সরকার একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়কেও পিএইচডি ডিগ্রি দেওয়ার ক্ষমতা দেওয়া হবে। আমরা জেনেছি, ঢাকা ও জাহাঙ্গীরনগরসহ দুএকটা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে পিএইচডি ডিগ্রি দেওয়ার ক্ষমতার অপব্যবহারের নজির রয়েছে। এ অবস্থায় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়কে এই ক্ষমতা দিলে তার অপব্যবহার হওয়ার সম্ভাবনা কতটুকু মনে করেন?
বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে জ্ঞান সৃষ্টির একটা জায়গা। এই জ্ঞান সৃষ্টি করবেন শিক্ষক senior scholar হিসেবে, শিক্ষার্থীরা younger scholar হিসেবে। তারা সমাজের বিভিন্ন যে সমস্যা সেগুলোকে তুলে আনবেন এবং সমাধানের রাস্তা তারা বের করে নিয়ে আসবেন গবেষণার মধ্য দিয়ে। উচ্চ পর্যায়ের গবেষণা করার জন্য যদি পিএইচডি ডিগ্রির বিষয়টা চলে আসে আমরা সেখানে পজিটিভলি দেখব। নেগেটিভলি দেখবো না। তবে we have to make sure তাদের কোয়ালিফাইড টিচার্স আছে, গবেষক আছে, ল্যাবরেটরি-লাইব্রেরি এভরিথিং এবং ইনফ্রাস্ট্রাকচার আছে । সবচেয়ে বড় কথা, তাদের যে মর্যাদার জায়গাটা, বিশ্ববিদ্যালয়ের যে ডিগনিটি , honour এটা তারা ধরে রাখতে পারছে কিনা।
এই মর্যাদার জায়গায় যারা আসতে পারবেন। যাদের ওপর আস্থা রাখা যায়, গবেষণায় সত্যিকার সেন্সে তারা অবদান রাখবেন এবং সেক্ষেত্রে গবেষণার মধ্য দিয়ে যদি পিএইচডি ডিগ্রি বেরিয়ে আসে তাহলে নাথিং রং হন ইট। কিন্তু যদি দেখা যায়, অন্য কোনোভাবে কোন কিছু ঘটেছে, যেটা আমরা দেখছি, এমনকি পাবলিক ইউনিভার্সিটিগুলোও অত্যন্ত renowned ইনভার্সিটিগুলোতেও দুএকটি ক্ষেত্রে প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। এগুলোর দায়িত্ব প্রথমে বিভাগের, বিভাগের একাডেমিক কমিটির, তারপরে ফ্যাকালটি, ডিনস কমিটি, ফ্যাকাল্টির প্রফেসরদেরকে নিয়ে সেখানে বিষয়টি আলোচনা হবে। তারপর এটা যাবে একাডেমিক কাউন্সিলে। যেখানে উপাচার্যের ভূমিকা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এতগুলো পদক্ষেপের মধ্য দিয়ে যখন অগ্রসর হবে, উপাচার্য যদি যাচাই করে দেখেন যে, পিএইচডি যিনি অর্জন করছেন তিনি সেটার সক্ষমতা রাখেন, গবেষণাটা সেভাবেই হয়েছে। আর এই থিসিস যারা মূল্যায়ন করলেন তারা সমাজের বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ। এ সব কিছুর মধ্য দিয়ে যদি আসে অবশ্যই আমরা সেটাকে অ্যাপ্রিশিয়েট করি। এর মধ্যে যদি প্রশ্নের জন্ম হয়, কোনো কারণে, আমাদের অবশ্যই সম্ভাব্য সব ব্যাপারে সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। কারণ, দায়িত্বটাও তো আমাদেরই নিতে হবে।