প্রায় ৭৭ কোটি টাকা লুটপাট হয়েছে বই উৎসবের নামে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়, জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড, শিক্ষাবোর্ড এবং জেলা প্রশাসকরা এই উৎসবের জন্য কাড়ি কাড়ি টাকা খরচ করতেন। অবৈধভাবে বই ছাপার ঠিকাদারদের কাছ থেকেও টাকা আদায় করতেন। তবে, স্কুল, কলেজ ও মাদরাসা পর্যায়ের প্রতিষ্ঠান প্রধান ও শিক্ষক নেতারা বই উৎসবের নামে অপচয় ও প্রহসন আখ্যায়িত করে অবিলম্বে তা বন্ধ করা দাবি জানিয়েছেন। একই সঙ্গে তারা প্রতিষ্ঠান পর্যায়ে প্রতিষ্ঠান প্রধানদের নিয়ন্ত্রণে বই বিতরণ করার তাগিদ দিয়েছেন।
এদিকে বই উৎসবের নামে কোটি কোটি টাকা লুটপাটের এক আওয়ামী মচ্ছবের ধারা চিরতরে বাতিলের সিদ্ধান্ত নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। এতে ফি বছর কয়েক কোটি টাকার অপচয় রোধ হবে। কথিত উৎসবের বদলে স্কুলে স্কুলে বই বিতরণ করবে সরকার।
জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. এ কে এম রিয়াজুল হাসান দৈনিক আমাদের বার্তাকে বলেন, অপচয় রোধে বই উৎসব বাতিল করা হয়েছে। ১ জানুয়ারি শিক্ষাবর্ষের সব পাঠ্যবইয়ের অনলাইন ভার্সন উদ্বোধন করা হবে। প্রাথমিক থেকে দশম শ্র্রেণি পর্যন্ত ৪০ কোটির বেশি বই ছাপা হচ্ছে এবার।
এবার বই থেকে ভুল ইতিহাস ও তথ্য-উপাত্ত বাদ দিয়ে সংশোধিত ও পরিমার্জিত বই ছাপা হচ্ছে। এতে যতোটুকু দেরি হবে তা জুলাই অভ্যুত্থানের চেতনায় শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা ইতোমধ্যে মেনে নিয়েছেন। তবে, প্রিন্টার্সদের অবহেলায় বই ছাপায় দেরি হলে তা সহ্য করা হবে না বলে আগেই জানিয়ে দেয়া হয়েছে, যোগ করেন তিনি।
এর আগে ২০০৯ খ্রিষ্টাব্দে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর নুরুল ইসলাম নাহিদকে একই সঙ্গে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেয়া হয়। প্রথম বছরই বিভিন্ন খাতে ব্যাপক দুর্নীতি ও অনিয়মে জড়িয়ে পড়ায় ওই বছরের সেপ্টেম্বর মাসে নাহিদের কাছ থেকে গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় কেড়ে নিয়ে ডা. আফছারুল আমীনকে দায়িত্ব দেয়া হয়। ২০১০ শিক্ষাবর্ষ থেকে পাঠ্যবইয়ে ইতিহাসসহ নানা বিষয়ে ব্যাপক পরিবর্তন আনতে গিয়ে বই প্রকাশে বিলম্ব হয়। অভিভাবকদের সমালোচনা ঠেকাতে প্রথমবারের মতো বই উৎসব শুরু করা হয় ২০১১ খ্রিষ্টাব্দের ১ জানুয়ারি। প্রথম দিনে বিভিন্ন শ্রেণির আবশ্যিক দুই/একটা বই দিয়ে উৎসব করা হয়। এভাবেই চলতে থাকে। প্রথমে শুধু শিক্ষা মন্ত্রণালয়। পরে যুক্ত করা হয় প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়কে। এরপর ২০১২ খ্রিষ্টাব্দ থেকে বই উৎসব আয়োজনের নামে লুটপাট শুরু হয়। জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডসহ বিভিন্ন শিক্ষাবোর্ড ও জেলা প্রশাসকদের ফান্ড থেকেও টাকা আদায় শুরু হয়। লুপটপাটের এই ধারা চলতে থাকে করোনার লক ডাউনের আগ পর্যন্ত।
মাঝখানে ২০১৫ খ্রিষ্টাব্দে দুই মন্ত্রণালয়ের যৌথ বই উৎসবের টাকা খরচ নিয়ে বিতর্কে গণশিক্ষামন্ত্রীকে প্রকাশ্যে কটূক্তি করেন অবৈধভাবে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের চলতি দায়িত্ব নেওয়া ও অবৈধভাবে অধ্যাপক পদে পদোন্নতি পাওয়া ফাহিমা খাতুন। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে অনুষ্ঠান মঞ্চ ছেড়ে চলে যান মন্ত্রী মোস্তাফিজুর রহমান। সেই থেকে ফের আলাদা উৎসব করা শুরু হয়। বেড়ে যায় উৎসবের নামে চাঁদাবাজি, লুটপাট।
দৈনিক আমাদের বার্তার অনুসন্ধানে ১০টি শিক্ষাবোর্ড, জেলা প্রশাসক অফিসসহ কয়েকটি অফিস থেকে চেকের মাধ্যমেই মোট ৭৭ কোটি টাকা দেয়ার হিসেবে পাওয়া গেছে। এদের মধ্যে এশিয়াটিক ইভেন্ট মার্কেটিং লিমিটেড, কাজলা টেকনোলজি, ইভেন্টকম, সরোজ ক্রিয়েটিভ, জার্নি, বাংলাদেশ সার্ভিস লিমিটেড ও মা জুট প্রোডাক্টসকে গত ১০টি শিক্ষাবর্ষে শুধু চেকের মাধ্যমে ২৭ কোটি টাকা দিয়েছে এনসিটিবি। প্রকৃত টাকার পরিমাণ আরো বেশি হলেও এ সংক্রান্ত সব পুরনো নথি বাসায় নিয়ে গেছেন আওয়ামী লীগপন্থি হিসেবে পরিচিত চেয়ারম্যান অধ্যাপক মো. ফরহাদুল ইসলাম ও সচিব মোসা. নাজমা আখতার। এ ছাড়া ১০টি শিক্ষাবোর্ড, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং অধিদপ্তর থেকে প্রায় ৫০ কোটি টাকা আদায় করা হয়েছে। এ ছাড়া বই উৎসবের নামে অভিভাবকদের কাছে চাঁদাবাজি করা অব্যাহত ছিলো চলতি বছর অব্দি। সেই সব টাকার কোনো হিসাব নেই।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সাবেক শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী আ ন ম এহছানুল হক মিলন দৈনিক আমাদের বার্তাকে বলেন, আমাদের সরকারের সময় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে রাজধানীর কয়েকজন শিক্ষার্থীর হাতে বই তুলে দিয়ে বই বিতরণ কার্যক্রম উদ্বোধন করতেন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া। স্কুলগুলোকে শত শত ছাত্র-ছাত্রী নিয়ে উৎসবে যোগ দেয়ার বাড়তি খবচ করতে হতো না। স্কুলগুলো নিজেদের মতো করে বই বিতরণ করতো। এতে বাড়তি কোনো খরচ বা সময় নষ্ট হতো না।
বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও বাংলাদেশ অধ্যক্ষ পরিষদের সভাপতি অধ্যাপক মোহাম্মদ মাজহারুল হান্নান বলেন, বই বিতরণের নামে লুটপাট বন্ধের যে সিদ্ধান্ত অন্তর্বতী সরকার নিয়েছে সেটাকে সাধুবাদ জানাই। বই উৎসবের নামে স্কুল ব্যবস্থাপনা কমিটি ও স্থানীয় সরকারি কর্মকর্তারা প্রতিষ্ঠান প্রধানদের ওপর ছড়ি ঘোরান, যেটা মোটেই ঠিক নয়। নিজ নিজ প্রতিষ্ঠানে বই বিতরণ হবে প্রতিষ্ঠান প্রধানদের নেতৃত্বে।
প্রসঙ্গত, বিদায়ী বছরের শুরুতেই বই উৎসব নিয়ে বিভিন্ন পত্রিকাও প্রকাশিত খবরে দেখা গেছে, সারা দেশে বিনামূল্যে বই বিতরণ শুরু হলেও কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ী উপজেলার একটি বিদ্যালয়ে সেশন ফির নামে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে হাতিয়ে নেয়া হয়েছে টাকা। ফলে সরকারের বিনামূল্যের বই বিতরণ উৎসব পরিণত হয়েছে ভর্তি ফিসহ বিভিন্ন খাতের টাকা আদায়ের উপলক্ষে। নতুন বইয়ের বিনিময়ে টাকা নেয়ায় অভিভাবকেরা তখন ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দেখান।
সে সময় দেখা যায়, ফুলবাড়ী উপজেলায় মাধ্যমিক পর্যায়ে ৬০টি স্কুল ও মাদরাসা এবং ১৫০টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বই বিতরণ করা হয়। এর মধ্যে বালারহাট আদর্শ স্কুল অ্যান্ড কলেজে স্কুল পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে টাকা নেওয়ার উভিযোগ ওঠে। প্রতিষ্ঠানের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ মনিরুজ্জামানের নির্দেশে অফিস সহকারী ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীরা সেশন ফি, ভর্তি ফির নামে প্রত্যেক শিক্ষার্থীর কাছ থেকে তিনশ টাকা আদায় করেন। এ সময় শিক্ষার্থীরা প্রতিবাদ করলেও নিয়মবহির্ভূতভাবে টাকা আদায় বন্ধ হয়নি। নতুন বই পাওয়ার আশায় বাধ্য হয়ে টাকা দিয়েছে তারা।
শিক্ষার্থীদের অভিভাবক ও শিক্ষা সংশ্লিষ্টদের আশা, এ বছর হয়তো তেমনটি হবে না।