দেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা কমানোর সুপারিশ করেছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত বৈষম্যহীন টেকসই উন্নয়নের জন্য অর্থনৈতিক কৌশল পুনর্নির্ধারণ ও প্রয়োজনীয় সম্পদ আহরণ বিষয়ক টাস্কফোর্স। সম্প্রতি টাস্কফোর্স কমিটির পক্ষ থেকে এ সুপারিশ সংবলিত একটি প্রতিবেদন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কিছু সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়কে একীভূতকরণের মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা কমিয়ে আনতে। সীমিত শিক্ষা বাজেটের সঠিক ব্যবহার ও আন্তর্জাতিক র্যাংকিংয়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ভালো অবস্থান নিশ্চিতে এ কৌশল নেওয়া যেতে পারে বলে মনে করছেন টাস্কফোর্সের সদস্যরা।
এ বিষয়ে শিক্ষা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেছেন, পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের অধীনে গঠিত টাস্কফোর্স সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় কমানোর সুপারিশ করেছে। দেশে বর্তমানে ৫৫টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। এর মধ্যে গত সাত বছরে অর্ধেক বিশ্ববিদ্যালয় হয়েছে।
সিপিডি নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন টাস্কফোর্সের শিক্ষাবিষয়ক সুপারিশগুলো তৈরিতে দায়িত্বপূর্ণ ভূমিকায় ছিলেন। এ বিষয়ে তিনি বলেন, ‘দেশে ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠা অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ই নিম্ন মানসম্পন্ন। এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিতে এবং মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিতের উদ্দেশ্যেই এ একীভূতকরণের সুপারিশ করা হয়েছে। এক্ষেত্রে কিছু সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়কে অন্য সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে এবং কিছু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়কে অন্য বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে একীভূত করা যেতে পারে। তবে একীভূতকরণের অর্থ এই নয় যে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ হয়ে যাবে। তাদের ক্যাম্পাস আগের জায়গায়ই থাকবে। তবে তারা একই নামে পরিচালিত হবে।
‘সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ক্ষেত্রে সরকারই একীভূতকরণের উদ্যোগ নিতে পারে। আর বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ক্ষেত্রে একটি ন্যূনতম মানদণ্ড নির্ধারণ করে দিতে পারে, যা তাদের নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে অর্জন করতে হবে। যদি কোনো বিশ্ববিদ্যালয় এ সময়ের মধ্যে মানদণ্ড পূরণে ব্যর্থ হয়, তবে তাদের একীভূতকরণের পদক্ষেপ নিতে হবে’, বলেন ড. ফাহমিদা খাতুন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) তথ্যানুযায়ী, দেশে বর্তমানে সরকারি ও বেসরকারি মিলিয়ে মোট বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ১৭০টি। এর মধ্যে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ৫৫টি। আর বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ১১৫টি। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অর্ধেকেরও বেশি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বিগত সরকারের আমলে।
ইউজিসি তথ্য অনুসারে, বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের দেড় দশকে মোট বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ৮৭টি। এর মধ্যে ২৬টি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ও ৬১টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়।
সাম্প্রতিক বছরগুলোয় দেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা অত্যন্ত দ্রুতগতিতে বেড়েছে। এর সঙ্গে সঙ্গে বেড়েছে উচ্চশিক্ষিত বেকারের সংখ্যাও। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী, দেশে ছয় বছরের ব্যবধানে উচ্চশিক্ষিত বেকারের সংখ্যা বেড়ে দ্বিগুণেরও বেশি হয়েছে। শ্রমশক্তি জরিপ ২০২৩-এ উঠে আসা এ তথ্য অনুযায়ী, দেশে উচ্চশিক্ষিত অর্থাৎ স্নাতক বা স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী বেকারের সংখ্যা ৯ লাখ ৬ হাজার।
এর আগে, ২০১৭ খ্রিষ্টাব্দের শ্রমশক্তি জরিপে ৪ লাখ ৫ হাজার জন উচ্চশিক্ষিত বেকারের তথ্য উঠে এসেছিল। সে হিসেবে ছয় বছরের ব্যবধানে উচ্চশিক্ষিত বেকারের সংখ্যা বেড়েছে প্রায় ৫ লাখ ৪ হাজার। শিক্ষাসংশ্লিষ্টদের মতে মান নিশ্চিত না করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠাই উচ্চশিক্ষিতদের মধ্যে বেকারত্ব বেড়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ।
টাস্কফোর্স কমিটির সদস্য এবং বিডিজবস ডটকমের সিইও একেএম ফাহিম মাশরুর বলেন, ‘আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের কমতি নেই। কিন্তু আমাদের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে আমরা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষায় গুণগত মান নিশ্চিত করতে পারছি না। ইন্ডাস্ট্রির চাহিদা অনুযায়ী তা পরিপূর্ণ হচ্ছে না। এ জায়গায় বিনিয়োগ তো অনেক হয়েছে। সরকারও অনেক বেশি পরিমাণে বিশ্ববিদ্যালয় তৈরি করে ফেলেছে। এত বিশ্ববিদ্যালয়ের তো দরকার আছে বলে মনে হয় না। সংখ্যার বাইরে গিয়ে এখন গুণগত মানে ফোকাস করা দরকার। এক্ষেত্রে সংখ্যায় কমিয়ে হলেও গুণগত মান নিশ্চিত করাটা গুরুত্বপূর্ণ বলে আমি মনে করি।’
ইউজিসির সর্বশেষ বার্ষিক প্রতিবেদনের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, এ দেড় দশকে প্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে অধিকাংশেরই পর্যাপ্ত শিক্ষক, নিজস্ব ক্যাম্পাস, আবাসন ও ল্যাবসহ প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা নেই। নিয়ম অনুযায়ী, উচ্চশিক্ষা পর্যায়ে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর আদর্শ অনুপাত বিবেচনায় প্রতি ২০ জন শিক্ষার্থীর জন্য অন্তত একজন শিক্ষক থাকার কথা। কিন্তু দেশে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর আদর্শ অনুপাত বজায় নেই ৬৩টি বিশ্ববিদ্যালয়ে। এর মধ্যে ১৮টি পাবলিক ও ৪৫টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়।
এছাড়াও ইউজিসির নীতিমালা অনুযায়ী অনেক বিশ্ববিদ্যালয় মানদণ্ড বজায় রাখার ক্ষেত্রে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের প্রতিটি প্রোগ্রামে ন্যূনতম একজন অধ্যাপক বা সহযোগী অধ্যাপক থাকা বাধ্যতামূলক। দেশের ১৩টি সরকারি ও ৬০টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় এ শর্ত পূরণ করতে পারছে না। এমনকি কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয় চলছে কোনো অধ্যাপক বা সহযোগী অধ্যাপক ছাড়াই। দেশের সাতটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় এবং নয়টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়সহ মোট ১৬টি বিশ্ববিদ্যালয়ে এমন পরিস্থিতি দেখা যায়।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের দক্ষ জনসম্পদে রূপান্তরের জন্য মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করা জরুরি উল্লেখ্য করে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. মোহাম্মদ কামরুল আহসান বলেন, ‘তবে বর্তমানে অনেক বিশ্ববিদ্যালয়েই প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা নেই। এর ফলে শিক্ষার্থীরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বিষয়গুলো বিবেচনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের মান উন্নয়নে কিছু বিশ্ববিদ্যালয়কে একীভূত করার সুপারিশটি ইতিবাচক। এটি করা হলে যেসব বিশ্ববিদ্যালয়ে অভিজ্ঞ শিক্ষকের অভাবসহ বিভিন্ন সংকট রয়েছে, সেগুলোর শিক্ষার্থীরা উপকৃত হবে।’