![প্রাথমিকের ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি বন্ধের সুপারিশ প্রাথমিকের ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি বন্ধের সুপারিশ](https://www.amaderbarta.net/media/imgAll/2023November/student-2502120439.jpg)
জাতীয় শিক্ষা নীতি-২০১০ অনুসারে প্রাথমিক শিক্ষার মেয়াদ পাঁচ বছর থেকে বৃদ্ধি করে আট বছর অর্থাৎ অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত সম্প্রসারণ করার ক্ষেত্রে একাডেমিক কার্যক্রম বিবেচনায় বিদ্যালয়গুলোতে প্রয়োজনীয় অবকাঠামো নেই। পাশাপাশি পাঠদানের জন্য রয়েছে শিক্ষক সংকট ও দক্ষতার ঘাটতি। প্রাথমিক ও উপানুষ্ঠানিক শিক্ষার মানোন্নয়নে গঠিত কনসালটেশন কমিটির প্রতিবেদনে এমন তথ্য উঠে এসেছে।
কমিটি মনে করে, প্রাথমিক স্তরকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত উন্নতিকরণ করার যুক্তি ও বাস্তবতা প্রশ্নসাপেক্ষ। তাই বর্তমানে যেসব প্রাথমিক বিদ্যালয় অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ানো হচ্ছে, সেগুলোতে অবিলম্বে ষষ্ঠ শ্রেণির ভর্তি বন্ধের সুপারিশ করা হয়েছে প্রতিবেদনে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, জাতীয় শিক্ষা নীতি-২০১০ অনুযায়ী প্রাথমিক শিক্ষা অষ্টম শ্রেণিতে উন্নীতকরণের ক্ষেত্রে একাডেমিক ও প্রশাসনিক পুনর্বিন্যাসে অনেক চ্যালেঞ্জ রয়েছে। বিদ্যালয়ের অবকাঠামো, শিক্ষক, শিক্ষা প্রশাসন, পাঠ্যক্রম, পাঠদান, প্রশিক্ষণ ও আইনগত বিষয়সহ বহুমুখী চ্যালেঞ্জে চাপা পড়েছিল প্রাথমিক শিক্ষাস্তর অষ্টম শ্রেণিতে উন্নীত করার উদ্যোগ।
নীতিমালা অনুযায়ী দেশে শিক্ষার স্তর হবে তিনটি। এর মধ্যে প্রথম থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত প্রাথমিক, নবম থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত মাধ্যমিক এবং এরপর উচ্চশিক্ষা স্তর। বর্তমানে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত প্রাথমিক, ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত নিম্নমাধ্যমিক, নবম-দশম শ্রেণি মাধ্যমিক, একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণি উচ্চ মাধ্যমিক এবং তারপর শুরু উচ্চশিক্ষা।
অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত প্রাথমিক স্তর করার লক্ষ্যে জাতীয় শিক্ষা নীতিতে বলা হয়, প্রাথমিক শিক্ষার মেয়াদ পাঁচ বছর থেকে বৃদ্ধি করে আট বছর, অর্থাৎ অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত সম্প্রসারণ করা হবে। এটি বাস্তবায়নে দুটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের একটি হলো অবকাঠামো এবং প্রয়োজনীয় সংখ্যক উপযুক্ত শিক্ষকের ব্যবস্থা করা। প্রাথমিক পর্যায়ের সব শিক্ষকের জন্য শিক্ষাক্রম বিস্তারসহ পাঠদানের ওপর ফলপ্রসূ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা এবং শিক্ষা প্রশাসন ও ব্যবস্থাপনার প্রয়োজনীয় পুনর্বিন্যাস বাড়ানো। এজন্য প্রাথমিক পর্যায়ের সব বিদ্যালয়ের ভৌত সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি এবং শিক্ষকের সংখ্যা বাড়ানো। যথাযথ পদ্ধতি অনুসরণে আর্থ-সামাজিক অবস্থা ও
জাতিসত্তা নির্বিশেষে পর্যায়ক্রমে দেশের সব শিশুর জন্য আট বছরব্যাপী প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করা হবে।
এক্ষেত্রে অনেক চ্যালেঞ্জ আছে বলে মনে করেন প্রাথমিক ও উপানুষ্ঠানিক শিক্ষার মানোন্নয়নের উদ্দেশ্যে গঠিত কনসালটেশন কমিটির আহ্বায়ক ও ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির প্রফেসর ইমেরিটাস ও প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ মনজুর আহমেদ। তিনি বলেন, বড় বিষয় হচ্ছে- ব্যবস্থাপনা কী হবে? শিক্ষা প্রশাসন কীভাবে চলবে। বর্তমানে মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে নবম-দশম শ্রেণি আছে। একটি স্কুলকে দুই মন্ত্রণালয় ও দুই অধিদপ্তরে ছোটাছুটি করতে হবে। শিক্ষক ও শ্রেণিকক্ষ সংকট আছে। এ অবস্থায় অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত কীভাবে চলবে? শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ কীভাবে চলবে? প্রাইমারি ট্রেনিং ইনস্টিটিউটের ইনস্ট্রাক্টররা কি অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দেবেন? টিচার ট্রেনিং কলেজগুলো কি তাহলে শুধু নবম ও দশম শ্রেণির শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দেবে?- এ বিষয়গুলোর সুরাহা হওয়া দরকার।
মনজুর আহমেদ বলেন, এছাড়া প্রাথমিক শিক্ষা অবৈতনিক। আর ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের বেতন দিতে হয়। যদি তাদেরও বেতন দিতে না হয়, তা হলে যে অর্থের প্রয়োজন হবে তার বরাদ্দ বাজেটে থাকবে কিনা, সেটা অজানা। অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত যদি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে চলে যায়, তা হলে ওই সব স্কুল কি শুধু নবম ও দশম শ্রেণি দিয়ে চলবে, নাকি দ্বাদশ শ্রেণিতে উন্নীত করা হবে- এ বিষয়ে কোনো রূপরেখা তৈরি হয়নি। আবার যেসব কলেজ শুধু একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণি নিয়ে গঠিত সেগুলোর কী হবে? এগুলো কি কোনো মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সঙ্গে সংযুক্ত হবে, নাকি সেখানে নবম ও দশম শ্রেণি খোলা হবে? আরেকটি চ্যালেঞ্জ হচ্ছে বিদ্যমান শিক্ষক দিয়ে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পাঠদান করা।
এ বিষয়ে শিক্ষাবিদ প্রফেসর মোহাম্মদ কায়কোবাদ বলেন, প্রাথমিক শিক্ষাকে অষ্টম শ্রেণিতে উন্নীত করায় অনেকগুলো চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হবে সরকারকে। একাডেমিক ও প্রশাসনিক পুনর্বিন্যাসের ক্ষেত্রে কী হবে? এটা নিয়ে একটা সমীক্ষা নেই। এমপিওভুক্ত অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত কতগুলো প্রতিষ্ঠান আছে, কতজন শিক্ষক আছেন। এমপিওবিহীন কতগুলো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া হচ্ছে। বর্তমান সরকারি-বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোর অবকাঠামো কী পরিমাণ আছে? এসব তথ্য বিশ্লেষণ করে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
জানা গেছে, গত বছর ৫ মে অনুষ্ঠিত এক আন্তঃমন্ত্রণালয়ের সভায় সিদ্ধান্ত হয়েছিল, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় অবৈতনিক পাঠদান কার্যক্রম ষষ্ঠ, সপ্তম ও অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত বিস্তৃত করা হবে। আর শিক্ষা মন্ত্রণালয় নিম্নমাধ্যমিক পর্যায়ে বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ব্যয় কমাতে কাজ করবে।
তৎকালীন সরকারের সময়ে করা জাতীয় শিক্ষা নীতি-২০১০ অনুযায়ী প্রাথমিক শিক্ষাস্তর অষ্টম শ্রেণিতে উন্নীত করার ঘোষণা ছিল ২০১৮ সালের মধ্যে। এরপর আরও সাত বছর কেটে গেছে নীতিমালার বাস্তবায়ন পরিকল্পনায়। শিক্ষা মন্ত্রণালয়, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের রশি টানাটানিতে থমকে গেছে প্রাথমিক শিক্ষা অষ্টম শ্রেণিতে উন্নীত করার উদ্যোগ।
উল্লেখ্য, দেশে ৬৫ হাজার ৫৬৬টি সরকারি প্রাথমিক স্কুলের মধ্যে ৬৯৫টি বিদ্যালয়ে অষ্টম শ্রেণি চালু রয়েছে।