
সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের খাদ্য ও পুষ্টিসেবা নিশ্চিত করতে এবং স্কুলে তাদের অংশগ্রহণ বাড়াতে স্কুল ফিডিং কার্যক্রম চালুর উদ্যোগ নিয়েছে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। প্রাথমিক পর্যায়ে দেশের ১৫০টি উপজেলার ১৯ হাজার ৪১৯টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে এ উদ্যোগ বাস্তবায়ন হবে।
সরকারি স্কুল ফিডিং কর্মসূচি (ফেইজ-১) প্রকল্পের আওতায় এ উদ্যোগ নেওয়া হবে। প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এসব বিদ্যালয়ে ফিডিং কর্মসূচি সম্পর্কে সচেতনতায় ১৯২টি ব্যাচে প্রায় ১৯ হাজার ৭১৯ জন প্রধান শিক্ষককে প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে।
জানা গেছে, প্রাথমিকে শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়া ঠেকাতে বিদ্যালয়ে খাবার কর্মসূচি শেষ হয়েছে ২০২২ সালে। কিন্তু এরপর শিক্ষার্থীদের মিড-ডে মিল হিসেবে গরম খাবার বা খিচুড়ি দেওয়ার জন্য ১৭ হাজার ২৯০ কোটি টাকার একটি প্রকল্পের প্রস্তাব করেছিল প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। সেটি বাস্তবসম্মত নয় উল্লেখ করে ২০২১ সালের ১ জুন প্রকল্পটি বাতিল করে দেয় জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক)।
পরিকল্পনা কমিশন সূত্রে জানা গেছে, ১৭ হাজার কোটি টাকার বিতর্কিত প্রকল্পটি আগামী ২৩ মার্চের একনেক সভায় অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করবে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর। ‘সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ফিডিং কর্মসূচি’ নামে নতুন প্রকল্পটিতে প্রাক্কলন ব্যয় ধরা হয়েছে ৫ হাজার ৪৫২ কোটি টাকা।
প্রকল্প সূত্র বলছে, প্রাথমিকের শিক্ষার্থীরা স্কুলে গেলেই ফটিফাইড বিস্কুট, কলা বা মৌসুমি ফল, বান, ডিম ও ইউএইচটি দুধ দেওয়া হবে। এ প্রকল্পের অধীনে শুধু খাবারের প্যাকেজেই ব্যয় হবে ৫ হাজার ২৯৯ কোটি টাকা। ২০২৫ সাল থেকে ২০২৭ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত এ কর্মসূচি চলবে। এ প্রকল্পের অধীনে ৫৮ কোটি টাকার বেশি হ্যান্ডওয়াশ কেনার প্রস্তাব করা হয়েছে। স্কুল ফিডিংয়ের জন্য আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে ৩০০ জনবল নিয়োগ দেওয়া হবে। এসব জনবলের জন্য খরচ ধরা হয়েছে প্রায় ২২ কোটি টাকা।
শিক্ষায় বিনিয়োগ ও সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিতে বিশ্বের প্রায় ৮০ শতাংশ দেশে ফুল মিল কর্মসূচি চালু রয়েছে। স্কুল মিল কর্মসূচিকে সর্বজনীন করার মাধ্যমে শিক্ষায় সব ধরনের বৈষম্য নিরসন, শিক্ষার্থীদের জন্য খাদ্য নিরাপত্তা বলয় সৃষ্টি করা এবং শিক্ষনফল ত্বরান্বিত করার মাধ্যমে জাতীয় উন্নয়নকে গতিশীল করার লক্ষ্যে জাতীয় স্কুল মিল নীতি ২০১৯ প্রণয়ন করা হয়। এ স্কুল মিল নীতিতে ৩০ লাখের বেশি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের অন্তত ৩০ শতাংশ ক্যালরি ও ৫০ শতাংশ মাইক্রো-নিউট্রিয়েন্টের চাহিদা পূরণে সক্ষম দুপুরের খাবার সরবরাহ করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে।
প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, অপেক্ষাকৃত কম মূল্যে শিক্ষার্থীদের পুষ্টি চাহিদা মেটানো সম্ভব হবে। অধিকাংশ খাদ্যসামগ্রী স্থানীয়ভাবে কেনা হবে বিধায় স্থানীয় পর্যায়ের অর্থনীতি গতিশীল হবে, প্রকল্প এলাকার দারিদ্র্যের মাত্রা কমবে।
প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, স্কুল ফিডিং কার্যক্রম ব্যবস্থাপনা, প্রদেয় খাবারের পুষ্টিমান, ব্যয় ইত্যাদি বিবেচনায় যল্প মেয়াদে সপ্তাহের পাঁচদিন উচ্চ পুষ্টিমান সম্পন্ন ফটিফাইড বিস্কুট, বান, পাস্তুরিত দুধ, ফল ও ডিমের সমন্বয়ে গঠিত প্যাকেটজাত করা খাবার সরবরাহ করা হবে।
এ বিষয়ে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের পরিকল্পনা ও উন্নয়ন বিভাগের পরিচালক মিরাজুল ইসলাম উকিল বলেন, শিক্ষার গুণগত মান উন্নয়নে ও ঝরে পড়া রোধে স্কুল ফিডিং কার্যক্রম চালু রাখার বিষয়ে বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। অপেক্ষাকৃত দরিদ্র এলাকার প্রাথমিক শিক্ষার্থীরা এ সুবিধা পাবেন। প্রকল্পে খাবারের প্যাকেজের যে মূল্য ধরা হয়েছে মূল্যস্ফীতি বিবেচনায় তা নেওয়া হয়েছে কি না প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমাদের আরো একটি বৈঠক আছে সেখানে সম্পূর্ণ বিষয়টি নির্ধারণ করা হবে।
বাংলাদেশে স্কুল ফিডিং কর্মসূচি ২০০১ সালে বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির (ডব্লিউএফপি) সহায়তায় শুরু হয়। ২০১০ থেকে ২০২২ সালে 'দারিদ্র্য পীড়িত এলাকায় স্কুল ফিডিং কর্মসূচি' প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হয়। এরপর ৪৯২টি উপজেলা ও ২১টি শিক্ষা থানার প্রাথমিক শিক্ষার্থীদের জন্য সরকারি অর্থায়নে 'প্রাইমারি স্কুল মিল' প্রকল্প প্রস্তাবিত হয়, যার প্রাক্কলিত ব্যয় ধরা ১৭ হাজার ২৯০ কোটি টাকা।
এ প্রকল্পের অধীনে খিচুড়ি রান্না শিখতে কর্মকর্তাদের বিদেশ যাওয়ার বিষয়টি বিতর্ক সৃষ্টি করে। একনেক সভায় প্রকল্পটি অনুমোদন না পেয়ে, 'কার্যকর বিকল্প ব্যবস্থা' গ্রহণের নির্দেশনা দেওয়া হয়।
২০২৫ থেকে ২০২৭ সালের মধ্যে 'সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ফিডিং কর্মসূচি' নামে নতুন প্রকল্পটি বাস্তবায়নের জন্য ৫ হাজার ৪৫২ কোটি টাকার প্রাক্কলিত ব্যয়ে ডিপিপি প্রক্রিয়া পাঠানো হয়। সর্বশেষ পিইসি সভার সুপারিশ অনুযায়ী, প্রকল্পের ব্যয় ১১৮ কোটি টাকা কমিয়ে ৫ হাজার ৪৫৩ কোটি টাকা পুনর্নির্ধারণ করা হয়েছে এবং পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হয়েছে।