
রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের উদ্যোগে ১৯৭৮ খ্রিষ্টাব্দে জাতীয় শিক্ষা পরিবেশ সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়। তৎকালীন দেশবরেণ্য শিক্ষাবিদরা ওই আয়োজনে সক্রিয়ভাবে অংশ নেন। ওই অনুষ্ঠানে দেয়া রাষ্ট্রপতির ভাষণ হুবহু এখানে প্রকাশ করা হলো-
জাতীয় শিক্ষা পরিবেশ সেমিনারে এই বিদ্বজ্জন সমাবেশে উপস্থিত হতে পেরে আমি বিশেষ আনন্দ ও গর্ব বোধ করছি। এই সেমিনার এমন এক সময়ে অনুষ্ঠিত হচ্ছে যখন দেশকে ক্রমান্বয়ে অগ্রগতির পথে নিয়ে যাওয়ার জন্য প্রয়োজন ঐক্যবদ্ধ এবং দৃঢ়চিত্ত প্রয়াস। জাতীয় জীবনে অর্থনৈতিক মুক্তির সঙ্গে সঙ্গে দরকার সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অগ্রগতি এবং বলাই বাহুল্য শিক্ষার অগ্রগতি ছাড়া এর কোনো ক্ষেত্রেই আশানুরূপ সাফল্য অর্জন সম্ভব নয়।
একটি মানবশিশুর মধ্যে বহু সম্ভাবনা নিহিত থাকে। কিন্তু আপনা থেকেই এই শিশুর বৃদ্ধি-বৃত্তি বা ক্ষমতার স্ফুরণ ঘটে না। সেই জন্য উপযুক্ত পরিবেশ ও শিক্ষার বিশেষ প্রয়োজন। মানুষের সকল শক্তির উৎস তার শিক্ষার মধ্যেই নিহিত। তাই শিক্ষাকে বিশেষ অগ্রাধিকার দিয়ে এবং শিক্ষা ব্যবস্থার যুগোপযোগী পুনর্বিন্যাসের মাধ্যমে সকল অগ্রগতির এই মূল চাবিকাঠিকে হাতের মুঠোয় আনতে হবে।
বাংলাদেশের শতকরা নব্বই জন লোক গ্রামে বাস করেন। তাই বর্তমান সরকারের উন্নয়ন তৎপরতার মূল লক্ষ্যই হলো বাংলার সামগ্রিক উন্নয়ন। গ্রাম বাংলার জনসাধারণকে আধুনিক চিন্তাধারায় উদ্বুদ্ধ করে তোলার জন্য, তাদেরকে সচেতন করে তোলার জন্য, আজ আমরা সবাই গ্রামমুখী হবার চেষ্টা করছি। বর্তমানে প্রশাসনিক কর্মকর্তারা জনসাধারণের সঙ্গে মিলে মিশে উন্নয়ন কাজে অংশ গ্রহণ করছেন। এই সব উদ্যোগ, গ্রাম বাংলার অগ্রগতির পথে সবচেয়ে বড় অন্তরায় অশিক্ষা, কুশিক্ষা দুর করতে সহায়ক হবে।
শিক্ষাক্ষেত্রের সাময়িক উন্নয়নের জন্ম যে কটি বিষয়ের উপর আমাদের বিশেষ নজর দেওয়া দরকার সেগুলি হচ্ছে শিক্ষা প্রশাসন, শিক্ষাক্রম, শিক্ষাদান পদ্ধতি, শিক্ষার মূল্যায়ন এবং শিক্ষক-ছাত্র সম্পর্ক; এর প্রতিটি ক্ষেত্রে আপনাদের যোগ্য নেতৃত্ব এবং সঠিক পথনির্দেশ জাতি কামনা করে। বাক্তি, সমাজ ও জাতীয় জীবনে আমরা যে পরিবর্তন সাধনে আগ্রহী, শিক্ষাই হচ্ছে তার হাতিয়ার।
আরো পড়ুন:
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় উপাচার্যের বিশেষ সাক্ষাৎকার-প্রথম পর্ব
পিএইচডি একজন শিক্ষকের পূর্ব শর্ত হওয়া উচিত-শেষ পর্ব
ঢাবি জনসংযোগ পরিচালকের সাক্ষাৎকার
অতএব শিক্ষার পাঠক্রম অবশ্যই যুগোপযোগী চাহিদা ও প্রেরণার উপযোগী করে গড়ে তুলতে হবে। সরকার ইতিমধ্যেই শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যসূচী প্রণয়ন কমিটি গঠন করেছেন এবং এ বছর থেকে নূতন শিক্ষাক্রম অনুযায়ী প্রথম তিন শ্রেণীর জন্য পাঠ্য পুস্তক প্রকাশিত হয়েছে। ক্রমে ক্রমে অন্যান্য শ্রেণীতেও নূতন শিক্ষাক্রম চালু হবে। শিক্ষার সর্বস্তরে অভিজ্ঞ শিক্ষক, গবেষক, এবং অন্যান্য কর্মীদের সমবেত প্রয়াসে শিক্ষাক্রমের উন্নয়ন এবং গবেষণার জন্য একটি স্থায়ী ব্যবস্থার কথা সরকার সক্রিয়ভাবে বিবেচনা করছেন।
শিক্ষাদানের জন্য উপযুক্ত পদ্ধতির প্রয়োগ এবং জ্ঞানের চর্চা ও প্রসারের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষাদানকে সার্থক করে তুলতে হলে যেমন প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত শিক্ষকের প্রয়োজন, তেমনি প্রয়োজন উপযুক্ত বিদ্যালয়গৃহ এবং বিষয়োপযোগী শিক্ষার উপকরণ। শিক্ষাদান পদ্ধতির সঠিক উন্নয়নের জন্য ব্যাপক প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্কুল শিক্ষক, মাদরাসা শিক্ষক এবং কলেজ শিক্ষকগণের প্রশিক্ষণ ব্যবস্থা জোরদার করার জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ-করা হচ্ছে।
সুনাগরিক গড়ে তোলার জন্য দেশের শিক্ষা ব্যবস্থাকে অবশ্যই শিক্ষার্থীর সার্বিক গুণাবলীর বিকাশ সাধনে সক্ষম হতে হবে। এই জন্য শিক্ষার মূল্যায়ন ব্যবস্থার পরিবর্তন আবশ্যক। শিক্ষার্থীর আচার-ব্যবহার, দেহগঠন ও খেলাধুলায় পারদর্শিতা, দেশের উন্নয়ন এবং সেবামূলক কাজের প্রতি আগ্রহ, উন্নত শ্রমে কুশলতা অর্জন, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক ক্রিয়াকলাপে অংশগ্রহণ ইত্যাদি গুণাবলীর বিকাশ সাধন প্রয়োজন। অথচ গতানুগতিক ব্যবস্থা এসব গুণাবলীর পরিমাপ করতে বহুলাংশে বার্থ হচ্ছে।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক ও ছাত্রদের কখনো বিচ্ছিন্ন করে দেখা যায় না। প্রকৃত শিক্ষক শুধু শ্রেণীকক্ষের শিক্ষক নন। ছাত্রদের সকল সময়ের সহচর ও পরামর্শদাতার ভূমিকাও তাকে পালন করতে হবে। তাকে উপলব্ধি করতে হবে ছাত্র-ছাত্রীদের বিভিন্ন বাক্তিগত সমস্যার বিষয়েও শিক্ষকদের সুপরামর্শ ও সাহায্যের প্রয়োজন রয়েছে। সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পারস্পরিক সহযোগিতার মাধ্যমে শিক্ষক-ছাত্র সম্পর্ক আরো জোরদার করার ব্যবস্থা আমাদের নিতে হবে।
আমাদের স্মরণ রাখতে হবে যে, জ্ঞানের চর্চা ও ব্যবহারের মধ্যেই নিহিত আছে একটি দেশ ও জাতীর উন্নয়নের চাবি কাঠি। শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশই এই পথকে নিরবচ্ছিন্ন এবং গতিশীল করতে পারে। দেশের সর্বাপেক্ষা মূল্যবান সম্পদ যুবশক্তি। যথাযথ ব্যবহার ও সার্বিক কল্যাণের জন্য শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ সংরক্ষণ আজকের দিনে একটি জরুরি প্রয়োজন। আজকের এই গুরুত্বপূর্ণ সেমিনারে আপনারা এইসব বিষয়ে মূল্যবান মতামত পেশ করে দেশ ও জাতির কৃতজ্ঞতাভাজন হবেন বলে আমি আশা পোষণ করি।