
ছাত্রজনতার গণঅভ্যুত্থানে রাষ্ট্রীয় ও রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস-চ্যান্সেলনের দায়িত্ব নিয়েছেন অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ কামরুল আহসান। শিক্ষার্থীদের প্রতি দর্শনের এই অধ্যাপকের শ্রদ্ধা অসীম। শিক্ষক নিয়োগেও স্বচ্ছতা প্রতিষ্ঠায় অতীব আগ্রহী। এসব ছাড়াও সমসাময়িক নানা বিষয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন ও ভবিষ্যত করণীয় সম্পর্কে নিজের মতামত তিনি সম্প্রতি তুলে ধরেছেন দৈনিক আমাদের বার্তার কাছে। তার এই একান্ত সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন জাবি প্রতিনিধি মেহেদী হাসান
আমাদের বার্তা: একটা ভিন্ন পরিস্থিতিতে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের দায়িত্ব পেয়েছেন, দায়িত্ব নেয়ার পর থেকে আপনার অভিজ্ঞতা বা অনুভূতি কেমন?
অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ কামরুল আহসান: এটা সত্য যে অন্য যে কোন পরিস্থিতি বিবেচনায় ২৪ এর যে ছাত্রজনতার গণঅভ্যুত্থান ছিলো, তারপর বিশ্ববিদ্যালয়ের দায়িত্ব নেওয়াটা আসলেই একটা ভিন্ন পরিস্থিতিতে ভিন্ন চ্যালেঞ্জ নিয়ে আসা এবং দীর্ঘদিনের যে অনিয়ম, যে অচল অবস্থা ছিল সেই অচল অবস্থাগুলোকে চলমান করা এবং প্রত্যাশার জায়গায় নিয়ে যাওয়া। এসব সত্যিই চ্যালেঞ্জের বিষয়, তবে ভালো লাগছে এই জন্য যে, যদি সামান্য কিছু পরিবর্তন করার সুযোগ পাই সেটা কাজে লাগাবো। আর তার সঙ্গে একটা ঝুঁকির বিষয় আছে যে, যদি প্রত্যাশার কাছাকাছি না যাওয়া যায় সেটা শুধু জনগণের বিবেচনা কিংবা মূল্যায়নটার চেয়েও নিজের সন্তুষ্টির যে ব্যাপারটা সে ব্যাপারটাও গুরুত্বপূর্ণ বিবেচ্য বিষয় বলে মনে করি। ফলে এই চ্যালেঞ্জটি মাথায় কাজ করছে দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই। আশা করছি, কিছু কিছু জায়গায় আমরা প্রত্যাশার কাছাকাছি যেতে পেরেছি। যেমন গণঅভ্যুত্থানের সময় যে হামলা হয়েছে সেগুলোর একটা সুরাহা করা গেছে ইতোমধ্যে। শিক্ষক শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে যে অভিযোগগুলো এসেছে সেগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ের আমাদের যে বিধান রয়েছে সে বিধান অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে এবং পর্যায়ক্রমে অতি দ্রুত তদন্তের মাধ্যমে দোষী সাব্যস্ত হলে সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। এর মাধ্যমে দুই হাজার ছাত্রজনতার রক্তে রঞ্জিত বাংলাদেশে আমাদের এই নতুন প্রশাসনের যে ঋণ আছে, সেই ঋণ পরিশোধ করা সম্ভব হবে।
আপনার দায়িত্ব গ্রহণের প্রায় ছয় মাস পার হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে কী ধরনের পরিবর্তন এসেছে? সকলের সহযোগিতা কেমন পাচ্ছেন?
দায়িত্ব গ্রহণের পর পরিবর্তন যতোটুকু হয়েছে তা প্রত্যাশার কাছাকাছি এসেছে তা বলা দুরূহ। আমরা প্রায় নবীন প্রশাসন। কিন্তু তারপরেও অনেক ঘটনা ঘটেছে- শামীম মোল্লা হত্যাকাণ্ড হয়েছে, একজন ছাত্রী রিকশা দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন। এখানে জুলাইয়ে ছাত্রজনতার উপর যে নির্যাতন, জুলুম হয়েছে পুলিশ প্রশাসন এবং সরকারের পক্ষ থেকে সেগুলো ফয়সালা করার যে বিষয় ছিল, এসব জায়গাগুলোতে সবাইকে বিচারের আওতায় আনার যে চেষ্টা, সেই চেষ্টার প্রাথমিক ধাপ আমরা পার হতে পেরেছি সর্বশেষ সিন্ডিকেটে। আপনারা দেখেছেন যে অভিযুক্ত শিক্ষার্থী যারা ছিল তাদের বহিষ্কার করা হয়েছে, প্রায় ডজন খানেক শিক্ষককে বিভিন্নভাবে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে, কাউকে কাউকে অভিযুক্তদের মধ্যে রাখা হয়েছে। তো এ বিষয়ে বলতে পারেন যে, বিশ্ববিদ্যালয়ের যে অ্যাকাউন্টিবিলিটি, প্রত্যেককে তাদের নিজেদের কর্মকাণ্ডের দায়বদ্ধতার জায়গায় আনা তাতে কিছুটা অগ্রগতি সাধিত হয়েছে বলে মনে করি। এছাড়া যে পরিবর্তনটি এসেছে তা হচ্ছে শিক্ষার্থীরা বিশ্বাস করতে শুরু করেছেন যে, দুই হাজার ছাত্রজনতা যে রক্ত দিয়েছে তার ঋণ শোধ করার চেষ্টা আছে, সে ঋণ শোধ করার ক্ষেত্রে অনেক শিক্ষার্থীকে মন্তব্য করতে শুনেছি যে, এই প্রশাসন জুলাই এর চেতনা ধারণ করবে। তাদের এই মন্তব্য, মূল্যায়ন এর উপযুক্ত আমরা হয়েছি কি না জানিনা। কিন্তু তার উপযুক্ত হওয়ার জন্য যা যা করা দরকার তা পূরণ করতে প্রশাসন অঙ্গীকার করছে এবং আমি ব্যক্তিগতভাবে করছি।
সহযোগিতার বিষয়ে যদি বলি, শিক্ষার্থীরা হচ্ছে আমার শক্তির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জায়গা। তাদের দাবির তালিকা অনেক বড় আমি জানি। আমার সীমাবদ্ধ সামর্থ্য, বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্থিক যে সীমাবদ্ধতা এবং আমাদের প্রশাসনের যে অভিজ্ঞতার শক্তি সব মিলিয়ে আসলে হয়ত সবটা পূরণ করতে পারছি না, কিন্তু তাদের চাহিদাগুলো পূরণে সর্বোচ্চ চেষ্টা করবো। সাংবাদিক যারা আছেন তাদের সহযোগিতা অসামান্য। এছাড়া সরকারের পক্ষ থেকেও যে সহযোগিতা করার কথা আমরা সেটাও পেয়েছি। পুলিশ- প্রশাসন সর্বোচ্চ সহযোগিতা করছে এ যাবৎকালে বলে আমি মনে করি।
২৪ এর আন্দোলনে শিক্ষার্থীদের পাশে আপনি সামনের সারিতে ছিলেন। আন্দোলনের সময় জাবির শিক্ষক - শিক্ষার্থীদের ভূমিকা কেমন দেখেছেন?
আমার জীবনের যে উল্লেখযোগ্য ভালো কাজ গুলো করেছি, তারমধ্যে ২৪ এর আন্দোলনে শিক্ষার্থীদের পাশে থাকা উল্লেখযোগ্য। যদিও অনেক ঝুঁকি ছিল, বিভিন্ন ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় কথা বলার চেষ্টা করেছি, যারা সরকারে ছিলেন দমন পীড়ন করেছেন প্রত্যেককে দেশের পরিস্থিতি বোঝানোর চেষ্টা করেছি। এই আন্দোলনে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের ভূমিকা স্ট্যালিনগ্রাদ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। নিষিদ্ধ সংগঠন ছাত্রলীগকে ক্যাম্পাস থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। ঢাকা-আরিচা মহাসড়কে জাবি শিক্ষার্থীরা জনতাকে সাথে নিয়ে, গোটা বাংলাদেশে আন্দোলন যখন স্তিমিত হয়ে যাচ্ছিল, তখন নজিরবিহীনভাবে ভূমিকা রেখেছে। তাদের পাশে অনেক শিক্ষকও ছিলেন। এটি আমাদের জন্য গর্ব করে বলার মতো বিষয়।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের বড় বেনিফিশিয়ারি সাধারণ মানুষ। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন স্বৈরাচার সরকারের পতনের মাধ্যমে বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতারাসহ সাধারণ জনতার মুক্তি মিলেছে। সবাই এখন স্বাধীনভাবে কথা বলতে পারছে। এটা কিন্তু খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এখন ভীতিহীন পরিবেশ ফিরে এসেছে, বিগত সময়ে যেটা ছিল না। তবে আমি মনে করি, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের দায়িত্ব শেষ হয়ে যায়নি, টেকসই রাষ্ট্র নির্মাণে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের এগিয়ে আসতে হবে।
এবার একটু ভিন্ন প্রসঙ্গ। বিভিন্ন সময়ে শিক্ষকদের বিরুদ্ধে ফল টেম্পারিংয়ের অভিযোগ আসে। এছাড়া শিক্ষার্থী কর্তৃক শিক্ষকদের মূল্যায়নের একটা বিষয় অনেকদিন থেকে আলোচনা হচ্ছে। এগুলো নিয়ে কিছু ভাবছেন কিনা?
ফল টেম্পারিংয়ের বিষয়টা একটা গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার বিষয় হয়ে গেছে বর্তমানে। যেমন আইন অনুষদের শিক্ষার্থীরা আবেদন করেছেন, তাদের আবেদনের প্রেক্ষিতে আমরা কমিটি করে দিয়েছি। ফলে তাদের যে দীর্ঘদিনের বঞ্চনা সেটা তদন্ত কমিটি দেখবে, তদন্ত হওয়ার পর আমরা নিশ্চিত হতে পারবো। তবে অভিযোগের যে তীব্রতা তাতে বোঝা যায়, একটি বিভাগের সকল শিক্ষার্থী সমানভাবে খারাপ করার কথা নয়। তাদের অভিযোগগুলো সত্যতার পথেই যায়, তবুও আমরা পদ্ধতিগতভাবে চেষ্টা করবো তাদের অভিযোগ গুলো খতিয়ে দেখতে। এছাড়া শিক্ষার্থী কর্তৃক শিক্ষক মূল্যায়নের যে বিষয়টি আলোচনা হচ্ছে, সেটা অনেক গুরুত্বপূর্ণ। প্রত্যেক শিক্ষক নিজেদের সর্বোচ্চ দেওয়ার চেষ্টা করেন, তবুও প্রত্যেকের সীমাবদ্ধতা থাকে। কেউ সীমাবদ্ধতার ঊর্ধ্বে নয়, শিক্ষার্থীরা যখন শিক্ষককে মূল্যায়ন করবেন সেটা সীমাবদ্ধতা দূর করার জন্য অত্যন্ত ইতিবাচক একটি দিক হবে। আমরা আশা করছি শীঘ্রই যথাযথ ফোরামে এরকম একটা সিদ্ধান্তের বিষয়ে আলোচনা করবো। (চলবে)
শিক্ষাসহ সব খবর সবার আগে জানতে দৈনিক আমাদের বার্তার ইউটিউব চ্যানেলের সঙ্গেই থাকুন। ভিডিওগুলো মিস করতে না চাইলে এখনই দৈনিক আমাদের বার্তার ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন এবং বেল বাটন ক্লিক করুন। বেল বাটন ক্লিক করার ফলে আপনার স্মার্ট ফোন বা কম্পিউটারে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ভিডিওগুলোর নোটিফিকেশন পৌঁছে যাবে।
দৈনিক আমাদের বার্তার ইউটিউব চ্যানেল SUBSCRIBE করতে ক্লিক করুন।