ঢাকা শনিবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৫ , ৫ বৈশাখ ১৪৩২ আর্কাইভস ই পেপার

bkash
bkash
udvash
udvash
uttoron
uttoron
Rocket
Rocket
bkash
bkash
udvash
udvash

কর্মক্ষেত্রে সুযোগ-সুবিধার ঘাটতিতে কমছে পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে শিক্ষার্থী

শিক্ষা

আমাদের বার্তা প্রতিবেদক

প্রকাশিত: ০৯:২৩, ১৯ এপ্রিল ২০২৫

আপডেট: ১০:১৮, ১৯ এপ্রিল ২০২৫

সর্বশেষ

কর্মক্ষেত্রে সুযোগ-সুবিধার ঘাটতিতে কমছে পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে শিক্ষার্থী

সিলেট পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট থেকে সাহেদুর রহমান ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিং শেষ করেছেন ২০১৭ খ্রিষ্টাব্দে। তিনি এ পর্যন্ত চারটি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেছেন। প্রথমটিতে বেতন ছিল মাত্র ১০ হাজার টাকা। এরপর অন্য আরেকটি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন ১২ হাজার টাকায়। সেখানে আবার বেতনের তুলনায় কাজের চাপ ছিল অনেক বেশি। অথচ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করা তারই সহকর্মীরা একই পদে পেতেন প্রায় তিন গুণ বেতন। সেই কষ্টে চাকরি ছেড়ে দিয়ে রবিউল এখন ব্যবসা শুরু করেছেন।

সরকারি একটি পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট থেকে ২০২২ খ্রিষ্টাব্দে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিং করেন শাহরিয়ার আহমেদ। এরপর মোট তিনটি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেছেন। বর্তমানে যে প্রতিষ্ঠানে কাজ করছেন সেখানে বেতন পান কেবল ১৫ হাজার টাকা। শাহরিয়ার আহমেদ বলেন, আমরা চাকরি পাচ্ছি না, বিষয়টি এমন নয়। কিন্তু যে কাজ পাচ্ছি তা মানসম্মত নয়। আমার অনেক সহপাঠী চাকরি না করে গ্রামের বাড়িতে বসে আছে, কারণ যে বেতনে তারা চাকরি পাচ্ছে তা দিয়ে ঢাকায় থাকাই সম্ভব নয়। আমার পরিবার গ্রামে থাকে। ঢাকায় নিজের খরচ চালিয়ে তাদের তেমন সহযোগিতা করতে পারি না।

শাহরিয়ার আহমেদ আরও বলেন, আমাদের যদি ভালো অবস্থানে যেতে হয় তবে ডিপ্লোমা শেষে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আবার চার বছরের বিএসসি করতে হয়। কিন্তু এটি অনেক ব্যয়বহুল। এসব কারণে এখন অনেকেই আর ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পড়তে আগ্রহী হয় না।

এদিকে কয়েক বছর ধরেই দেশে কারিগরি শিক্ষার প্রতি গুরুত্ব দিয়ে আসছে সরকার। ফলে সরকারি-বেসরকারি পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের সংখ্যাও বেড়েছে। কিন্তু শিক্ষাসংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রতিষ্ঠান বাড়লেও সেগুলোয় শিক্ষক সংকট, উপযুক্ত শিক্ষার পরিবেশের অভাব এবং শিক্ষাজীবন শেষে চাকরিক্ষেত্রে পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা না পাওয়ায় ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যা কমে যাচ্ছে।

কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের সর্বশেষ বার্ষিক প্রতিবেদনেও এ তথ্যটি উঠে এসেছে। দেশের সরকারি-বেসরকারি পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটগুলোয় ২০২৩-২৪ শিক্ষাবর্ষে মোট আসন ছিল ১ লাখ ৭১ হাজার ৫০০টি। এর বিপরীতে ভর্তি হয় ৬৮ হাজার ৭৮২ শিক্ষার্থী, যা বিগত পাঁচ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। অর্থাৎ ইনস্টিটিউটগুলোয় প্রায় ৬০ শতাংশ আসনই ওই শিক্ষা বছরে ফাঁকা ছিল।

বিগত পাঁচ বছরের প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, ২০১৯-২০ শিক্ষাবর্ষে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে মোট শিক্ষার্থী ভর্তি হয় ৮১ হাজার ৭৬ জন। ওই শিক্ষাবর্ষে আসন ফাঁকা ছিল ৫২ দশমিক ৮ শতাংশ। তার পরের শিক্ষাবর্ষে ৭৭ হাজার ২৭২ শিক্ষার্থী ভর্তি হলেও ৫৪ দশমিক ৩৪ শতাংশ ছিল শূন্য আসন। এছাড়া ২০২১-২২ শিক্ষাবর্ষে শিক্ষার্থী ছিল ৭৩ হাজার ২৭২ জন, ফাঁকা আসন ৫৮ দশমিক ৬২ শতাংশ; ২০২২-২৩ শিক্ষাবর্ষে ভর্তি হয় ৭১ হাজার ৫৫৩ শিক্ষার্থী, আর ফাঁকা পড়ে ছিল ৫৯ দশমিক ৪ শতাংশ আসন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এডুকেশন অ্যান্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. মো. আলী জিন্নাহ বলেন, বিগত কয়েক বছর কারিগরি শিক্ষায় গুরুত্ব দেওয়া হলেও তার বিপরীতে শিক্ষা ও কর্মক্ষেত্রের যথাযথ সংযোগ স্থাপন করা হয়নি। এছাড়া মানসম্মত কারিগরি শিক্ষা নিশ্চিতের জন্য প্রতিষ্ঠানগুলোয় যে ধরনের দক্ষ লোকবল প্রয়োজন সেটিও নিশ্চিত করা যায়নি। এসব কারণে শিক্ষার্থীদের একটি অংশ হতাশাগ্রস্ত হয়ে যাচ্ছে এবং তাদের দেখে নতুন শিক্ষার্থীরাও ভর্তিতে নিরুৎসাহিত হচ্ছে। যদি শিক্ষা ও কর্মসংস্থানের সংযোগ স্থাপন করা যায়, বিশেষত আন্তর্জাতিক শ্রমবাজারের চাহিদা অনুযায়ী শিক্ষার্থীদের দক্ষ করে গড়ে তোলা যায় তবে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ঠিকই শিক্ষার্থীদের আগ্রহ বাড়বে।

জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থাপনা একাডেমিতে (নায়েম) ২০২১ খ্রিষ্টাব্দে জমা দেওয়া এক গবেষণা প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, ডিপ্লোমা ডিগ্রিধারীদের মধ্যে ৫৪ শতাংশ কর্মজীবী, ৪ শতাংশ উদ্যোক্তা, ৩৮ শতাংশ বেকার ও ৪ শতাংশ কাজে আগ্রহী নয়। তবে শহরের তুলনায় গ্রামাঞ্চলে বেকারত্বের হার বেশি। গ্রামাঞ্চলের মাত্র ৪৮ শতাংশ ডিপ্লোমাধারী কর্মক্ষেত্রে রয়েছেন।

সরকারি-বেসরকারি পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের ২৭২ ডিপ্লোমাধারীর ওপর ওই গবেষণা করা হয়। ওই প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, কর্মজীবীদের ৬৫ শতাংশ বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে, ২৪ শতাংশ ব্যক্তি মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানে, ৬ শতাংশ স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান বা এনজিওতে ও ৫ শতাংশ কাজ করছেন সরকারি প্রতিষ্ঠানে। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কর্মরত এ ডিপ্লোমা ডিগ্রিধারীদের ৪৪ শতাংশের মাসিক আয় ১০-১৫ হাজার টাকার মধ্যে এবং ৪৩ শতাংশের আয় ১০ হাজার টাকার কম। মাত্র ১৩ শতাংশের মাসিক আয় ১৫ হাজারের ওপর।

প্রায় একই তথ্য উঠে এসেছে বাংলাদেশ শিক্ষা তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর (ব্যানবেইস) জরিপেও। ব্যানবেইসের ওই জরিপের তথ্য অনুযায়ী, ডিপ্লোমা প্রকৌশলীর ডিগ্রি নিয়ে চাকরিতে প্রবেশ করা শিক্ষার্থীদের মধ্যে ৭১ শতাংশ বেতন পাচ্ছে ১০ থেকে ২০ হাজার টাকার মধ্যে।

পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের শিক্ষকরা অবশ্য বলছেন, শিক্ষাজীবনে যেসব শিক্ষার্থী মনোযোগী এবং দক্ষতা অর্জন করছেন তাদের বেকার থাকতে হচ্ছে না। নরসিংদী পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের অধ্যক্ষ প্রকৌশলী নীহার রঞ্জন দাস এ বিষয়ে বলেন, সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোয় আসন খুব একটা ফাঁকা থাকছে না। আমাদের এখানে যারা ভালোভোবে পড়ালেখা করছে তারা ভালো অবস্থানেও পৌঁছাচ্ছে। তবে কিছু শিক্ষার্থী আছে যারা ড্রপআউট হয়ে যাচ্ছে, আবার অনেকে নিয়মিত ক্লাস না করায় পিছিয়ে পড়ছে। কর্মক্ষেত্রে মূলত তারাই সমস্যার মুখোমুখি হয়। আর বেতন কাঠামো বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে বিভিন্ন রকম। শুরুর দিকে হয়তো কম থাকে, কিন্তু কেউ যদি ভালো দক্ষতা দেখাতে পারে তবে সে দ্রুতই ভালো বেতন অর্জন করে।

দক্ষ শিক্ষকের অভাব কারিগরি শিক্ষায় একটি বড় সংকট উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, শিক্ষক সংকটের কারণে বিগত কয়েক বছর প্রতিষ্ঠানগুলো কিছুটা পিছিয়ে পড়েছে। শিক্ষার্থীরাও আশানুরূপ শিক্ষার পরিবেশ পায়নি। এ কারণে কিছু প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীও কমেছে। তবে এ সংকট দূর করতে পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে। বিগত কয়েক মাসে অনেক শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হয়েছে। আমার প্রতিষ্ঠানেই নিয়োগ দেয়া হয়েছে ২৬ জন নতুন শিক্ষক।

এদিকে স্বতন্ত্র ‘কারিগরি ও উচ্চশিক্ষা’ মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠা, ‘কারিগরি শিক্ষা সংস্কার কমিশন’ গঠন এবং উচ্চশিক্ষার সুযোগের লক্ষ্যে টেকনিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দাবিতে অনেকদিন ধরেই আন্দোলন করছেন পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থীরা। গত বুধবার থেকে নতুন করে আন্দোলনে নামা শিক্ষার্থীরা আরও বেশকিছু দাবি সামনে এনেছেন। তার মধ্যে রয়েছে জুনিয়র ইনস্ট্রাক্টর পদে ক্র্যাফট ইনস্ট্রাক্টরদের ৩০ শতাংশ পদোন্নতি কোটা বাতিল, জুনিয়র ইনস্ট্রাক্টর পদে ক্র্যাফট ইনস্ট্রাক্টরদের পদোন্নতির রায় বাতিল, ক্র্যাফট ইনস্ট্রাক্টরদের পদবি পরিবর্তন, মামলার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের চাকরিচ্যুত, ২০২১ সালে নিয়োগপ্রাপ্ত ক্র্যাফট ইনস্ট্রাক্টরদের নিয়োগ বাতিল এবং সেই বিতর্কিত নিয়োগবিধি অবিলম্বে সংশোধন করা।

এসব দাবি-দাওয়ার বিষয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে গত বৃহস্পতিবার শিক্ষার্থীদের দীর্ঘক্ষণ বৈঠক হয়। তবে বৈঠক শেষে পলিটেকনিক শিক্ষার্থীদের প্রতিনিধি মাশফিক ইসলাম বলেন, আমরা মন্ত্রণালয়ের দৃশ্যমান কোনো পদক্ষেপ দেখতে পাইনি। এ বৈঠকে আমরা সন্তুষ্ট নই। দাবি আদায়ের জন্য আমাদের আন্দোলন চলবে।

সে অনুযায়ী ছয় দফা দাবিতে কেন্দ্রীয় কর্মসূচির অংশ হিসেবে সারা দেশের পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থীরা গতকাল শুক্রবার জুমার নামাজের পর ‘কাফন মিছিল’ করেন। বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা তাদের ছয় দফা দাবি অবিলম্বে মেনে নিতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। অন্যথায় তারা আরো কঠোর আন্দোলনের হুঁশিয়ারি দেন।

সার্বিক বিষয়ে বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষা বোর্ডর চেয়ারম্যান প্রকৌশলী মো. রুহুল আমিন বলেন, কারিগরি শিক্ষায় শিক্ষার্থীরা ভালো চাকরি পাচ্ছে না, এটি সঠিক নয়। অনেক শিক্ষার্থীই অনেক ভালো করছে। এখানে একটি বড় সমস্যা প্রচারণার অভাব এবং কারিগরি শিক্ষার সুযোগ সম্পর্কে অজ্ঞতা। প্রচারণা বাড়ানোর জন্য আমরা এখন বিভিন্ন পদক্ষেপ নিচ্ছি। এছাড়া কিছু ভুঁইফোড় বেসরকারি পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটও রয়েছে। দেখা যায় এসব প্রতিষ্ঠানে সুযোগ-সুবিধা না থাকায় শিক্ষার্থীরা ভর্তি হয় না। বোর্ডের পক্ষ থেকে মাঠপর্যায়ে পরিদর্শনের মাধ্যমে সুযোগ-সুবিধাহীন এসব ইনস্টিটিউটের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। সূত্র: বণিক বার্তা।

জনপ্রিয়