
নানা অজুহাতে স্থায়ী ক্যাম্পাসে শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করতে গড়িমসি করছে ১১টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়। এর কয়েকটির নিজস্ব ক্যাম্পাস প্রতিষ্ঠার সামর্থ থাকলেও স্থায়ী ক্যাম্পাসের ব্যাপারে তাদের কোনো গরজ দেখা যাচ্ছে না। এমনকি বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) বারবার তাগাদা দিলেও গা করছে না তারা।
স্থায়ী ক্যাম্পাসে না যাওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে আছে ২০০১ খ্রিষ্টাব্দে স্থাপিত ব্র্যাক, ২০০২ খ্রিষ্টাব্দে স্থাপিত স্টামফোর্ড, ২০০৬ খ্রিষ্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত আশা, ২০০৩ খ্রিষ্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত প্রাইম এশিয়া, ২০০৩ খ্রিষ্টাব্দে স্থাপিত প্রেসিডেন্সি, ২০০৪ খ্রিষ্টাব্দে অনুমোদিত রয়েল, ২০০৩ খ্রিষ্টাব্দে অনুমোদিত মিলেনিয়াম, ২০০২ খ্রিষ্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত ইউডা, ২০০২ খ্রিষ্টাব্দে অনুমোদিত স্টেট, ২০০৩ খ্রিষ্টাব্দে স্থাপিত ভিক্টোরিয়া এবং ১৯৯৬ খ্রিষ্টাব্দে অনুমোদিত পিপলস ইউনিভার্সিটি।
দেশে এখন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ১১৩টি। এর মধ্যে শুধু রাজধানীতেই রয়েছে ৫৪টি। মোট ১১৩টি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ৪৪টি নিজস্ব ক্যাম্পাসে শিক্ষা কার্যক্রম চালাচ্ছে। এর কয়েকটি আবার নিজস্ব স্থায়ী ক্যাম্পাসে পুরো শিক্ষা কার্যক্রম চালাচ্ছে না। এসব প্রতিষ্ঠান ‘লিয়াজোঁ অফিসের’ নামে স্থায়ী ক্যাম্পাসের পাশাপাশি ঢাকায় ভাড়া বাড়িতেও শিক্ষা কার্যক্রম চালাচ্ছে। ২০০৩ খ্রিষ্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত উত্তরা ইউনিভার্সিটি গত ৩০ জুন নিজস্ব ক্যাম্পাসে গেছে বলে ইউজিসিকে জানিয়েছে।
দৈনিক আমাদের বার্তার অনুসন্ধানে জানা গেছে, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইনের শর্ত পূরণ করতে না পারায় স্থায়ী ক্যাম্পাসে না যাওয়া প্রতিষ্ঠানগুলো স্থায়ী সনদ পাচ্ছে না। তবে নানা বিতর্ক ও অনিয়মের অভিযুক্ত কয়েকটি প্রতিষ্ঠান স্থায়ী সনদ পেয়েছে। যদিও স্থায়ী ক্যাম্পাসে যাওয়ার কয়েকবছর পেরিয়ে গেলেও নানা অজুহাতে কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয়কে সনদ দেয়া হচ্ছে না। আবার স্থায়ী সনদ না পাওয়া কোনো কোনো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়কে নিয়মিত উপাচার্য নিয়োগ ও কনভোকেশনের অনুমোদন দেয়া হচ্ছে। কোনো কোনোটির বৈধ উপাচার্য না থাকায় কনভোকেশন আটকে রয়েছে। ফলে, এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রাজুয়েটরা ভোগান্তিতে রয়েছেন।
এ বিষয়ে ইউজিসির একজন কর্মকর্তা দৈনিক আমাদের বার্তাকে বলেন, ৯-১০টির মতো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় এখনো স্থায়ী ক্যাম্পাসে যায়নি। এর মধ্যে ৬টি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থায়ী ক্যাস্পাস প্রতিষ্ঠার কার্যক্রম শেষ পর্যায়ে রয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানের কয়েকটিকে তিন মাস ও ছয় মাস করে সময় দেয়া হয়েছে। তবে স্থায়ী ক্যাম্পাস থাকার পরও যারা ঢাকায় শিক্ষা কার্যক্রম চালাচ্ছে সেসব বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক পদক্ষেপ নেয়া হবে।
স্থায়ী ক্যাম্পাসে না যাওয়ার বিষয়ে স্টামফোর্ড ও প্রাইম এশিয়া ইউনিভার্সিটির দু’জন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, তারা রাজধানীর বাইরে স্থায়ী ক্যাম্পাস প্রতিষ্ঠা করছেন। সেখানে এখনই পুরোপুরি শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করা সম্ভব নয়। স্থায়ী ক্যাম্পাস প্রতিষ্ঠা যেমন ব্যয়বহুল, তেমনি সেখানে সব শিক্ষার্থী যেতে চাইবে না। আবার ‘জ্যেষ্ঠ’ শিক্ষকরাও রাজধানীর বাইরে থাকতে চান না।
জানা গেছে, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির স্থায়ী ক্যাম্পাস প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে সাভারের বিরুলিয়ায়। কিন্তু কর্তৃপক্ষ সেখানে পুরো শিক্ষা কার্যক্রম স্থানান্তর না করে রাজধানীর সোবহানবাগ ও উত্তরায় বিশ্ববিদ্যালয়টির অস্থায়ী ক্যাম্পাসেও শিক্ষা কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছে। শিক্ষার্থী সংখ্যা কমে যাওয়ার আশঙ্কায় প্রতিষ্ঠানটি স্থায়ী ক্যাম্পাসে যাচ্ছে না বলে ইউজিসি কর্মকর্তাদের ধারণা।
তবে, সোবহানবাগ ও উত্তরায় অস্থায়ী ক্যাম্পাস চালানোর কথা অস্বীকার করে ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির রেজিস্ট্রার ড. মোহাম্মদ নাদীর বিন আলী দৈনিক আমাদের বার্তাকে বলেন, আমরা স্থায়ী ক্যাম্পাসে চলে গিয়েছি। খোঁজ নিয়ে দেখেন, আমাদের অস্থায়ী শাখাগুলো আর নেই।
১৯৯৬ খ্রিষ্টাব্দে রাজধানীর আসাদ এভিনিউতে ক্যাম্পাস স্থাপনের অনুমোদন নিয়ে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা শুরু করে দি পিপলস ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ। এই প্রতিষ্ঠানের কর্তৃপক্ষ ইউজিসিকে স্থায়ী ক্যাম্পাস স্থাপনের জন্য ‘জমি কেনার’ কথা জানিয়েছে। তারা স্থায়ী ক্যাম্পাস প্রতিষ্ঠায় খুব একটা আগ্রহ দেখাচ্ছেন না বলে সংশ্লিষ্ট শাখার কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।
২০২১ খ্রিষ্টাব্দের সেপ্টেম্বরে ইউজিসি ২৬টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের নানা সীমাবদ্ধতা ও অনিয়মের চিত্র তুলে ধরে গণবিজ্ঞপ্তি জারি করেছিল। এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের সনদ বিক্রি, মালিকানা দ্বন্দ্ব, অনুমোদনহীন প্রোগ্রাম পরিচালনাসহ নানা অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে ইউজিসির কাছে।
গণবিজ্ঞপ্তিতে এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিতে শিক্ষার্থীদের নিরুৎসাহিত করা হয়েছিল। ওই তালিকায় থাকা প্রায় সবকটি বিশ্ববিদ্যালয়েই সমাবর্তন না হওয়ার অভিযোগ রয়েছে।
অভিযুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকটি সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে তদবির করে ‘স্থায়ী সনদ’ও বাগিয়ে নিয়েছে। আবার ‘তুলনামূলক ভালো’ শিক্ষা কার্যক্রম অব্যাহত রেখেও অনেক বিশ্ববিদ্যালয় স্থায়ী সনদ পাচ্ছে না বলে অভিযোগ রয়েছে।
১৯৯২ খ্রিষ্টাব্দে দেশে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের যাত্রা শুরু হয়। এরপর ২০১০ খ্রিষ্টাব্দে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন সংশোধন করা হয়। স্থায়ী সনদ পেতে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন অনুযায়ী কয়েকটি শর্ত প্রতিপালন করতে হয়। শর্তগুলো প্রতিপালনের জন্য সাধারণত ১০-১২ বছর সময় দিয়ে থাকে ইউজিসি।
শর্তগুলো হলো- ১. ঢাকা ও চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন এলাকার ক্ষেত্রে, প্রতিষ্ঠানের নামে অন্যূন এক একর পরিমাণ এবং অন্যান্য এলাকার জন্য দুই একর পরিমাণ নিষ্কণ্টক, অখণ্ড ও দায়মুক্ত জমি থাকতে হবে ২. নিজস্ব জমিতে যথাযথ কর্তৃপক্ষ কর্তৃক ক্যাম্পাস ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ভবনাদির প্ল্যান অনুমোদন করে সাময়িক অনুমতিপত্রে প্রদত্ত মেয়াদের মধ্যে স্থায়ী অবকাঠামো নির্মাণ করতে হবে ৩. বিশ্ববিদ্যালয়ের জমি কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের কাছে কোনোভাবে দায়বদ্ধ বা হস্তান্তর করা যাবে না ৪. প্রত্যেক শিক্ষাবর্ষে ভর্তিকৃত পূর্ণকালীন শিক্ষার্থীদের ন্যূনতম শতকরা ছয় ভাগ, যার মধ্যে তিন ভাগ আসন মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তান এবং বাকি তিন ভাগ আসন প্রত্যন্ত অনুন্নত অঞ্চলের মেধাবী অথচ দরিদ্র শিক্ষার্থীদের ভর্তির জন্য সংরক্ষণ করে এই সব শিক্ষার্থীকে টিউশন ফি ও অন্যান্য ফি ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নের সুযোগ দিতে হবে এবং এসব শিক্ষার্থীর তালিকা বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনে দাখিল করতে হবে ৫. ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীদের চলাফেরা, শিক্ষা অর্জন ও জীবনের নিরাপত্তা বিধানের ব্যবস্থা করতে হবে ৬. বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বার্ষিক বাজেটের ব্যয় খাতে কমিশন কর্তৃক নির্ধারিত একটি অংশ গবেষণার জন্য বরাদ্দপূর্বক ব্যয় করতে হবে এবং ৭. সাময়িক অনুমতিপ্রাপ্ত প্রত্যেক বিশ্ববিদ্যালয়কে সনদপত্র প্রাপ্তির জন্য আবেদনের আগে এই আইনের অধীন প্রযোজ্য সব শর্ত প্রতিপালন করতে হবে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ১১৩টি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে অন্তত ৫৪টি ১৩ থেকে ৩১ বছর আগে অনুমোদন পেয়েছে। এগুলোর মধ্যে প্রায় অর্ধশত বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে রাজধানীতে। এসব প্রতিষ্ঠানের অধিকাংশের বিরুদ্ধে বছরের পর বছর ধরে ভাড়া বাড়িতে শিক্ষা কার্যক্রম চালানোর অভিযোগ রয়েছে। শিক্ষার্থী কমে যাওয়ার আশঙ্কায় প্রতিষ্ঠানগুলো রাজধানী ত্যাগ করতে চাইছে না। বর্তমানে উচ্চশিক্ষায় দেশের প্রায় ৩২ লাখ শিক্ষার্থীর মধ্যে লাখ চারেক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত।
প্রসঙ্গত, ২০১০ খ্রিষ্টাব্দে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন পাস হওয়ার পর ওই বছর আলটিমেটাম দিয়ে ২০১১ খ্রিষ্টাব্দের সেপ্টেম্বরের মধ্যে সব বিশ্ববিদ্যালয়কে স্থায়ী ক্যাম্পাসে যাওয়ার সময় বেঁধে দেয়া হয়। তবে অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয় স্থায়ী ক্যাম্পাসে যাওয়ার তৎপরতা দেখায়নি। দ্বিতীয় দফায় ২০১২ খ্রিষ্টাব্দে , তৃতীয় দফায় ২০১৩ খ্রিষ্টাব্দে, চতুর্থ দফায় ২০১৫ খ্রিষ্টাব্দের জুন, পঞ্চম দফায় ২০১৭ খ্রিষ্টাব্দের ৩১ জানুয়ারি এবং ষষ্ঠ দফায় ২০১৭ খ্রিষ্টাব্দের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত আলটিমেটাম দেয়া হয়। ৬ বার সময় বেঁধে দেয়ার পরও স্থায়ী ক্যাম্পাসে যেতে খুব একটা আগ্রহ দেখায়নি অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়। পরবর্তীতে ২০১৭ খ্রিষ্টাব্দের মাঝামাঝি সময়ে ৩৯টি বিশ্ববিদ্যালয়কে এ সময়সীমা বেঁধে দেয়া হলে সাতটি প্রতিষ্ঠান স্থায়ী ক্যাম্পাসে কম-বেশি কার্যক্রম শুরু করার কথা শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে অবহিত করে। শিক্ষা মন্ত্রণালয় ২০১৭ খ্রিষ্টাব্দের ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে সব ধরনের শিক্ষা ও প্রশাসনিক কার্যক্রম স্থায়ী ক্যাম্পাসে স্থানান্তরের নির্দেশ দেয়। অন্যথায় ২০১৮ খ্রিষ্টাব্দের ১ জানুয়ারি থেকে এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে নতুন শিক্ষার্থী ভর্তি বন্ধ রাখার সতর্কতা দেয়া হয়। ওই নির্দেশনাও আমলে নেয়নি অধিকাংশ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়।