‘মানুষ মরে গেলে পচে যায়, বেঁচে থাকলে বদলায়, কারণে-অকারণে বদলায়’ বিখ্যাত এই উক্তির সঙ্গে পরিচিত নন এমন বাঙালি খুঁজে পাওয়া কষ্টই বটে! ভাষা আন্দোলনের পটভূমিতে তৈরি মুনীর চৌধুরীর ‘কবর’ নাটকের বিখ্যাত সংলাপ এটি। কেবল এই এক বাক্যেই লেখক চিরাচরিত মানুষের এক বাস্তবতা তুলে ধরেছিলেন। বাক্যটি তাই সবসময় সব মানুষের বেলাতেই প্রাসঙ্গিক।
প্রাসঙ্গিক জনপ্রিয় অভিনেত্রী মেহজাবীন চৌধুরীর সময়ের সঙ্গে বদলে যাওয়ার বেলাতেও। এই বদলের বাঁকে বাঁকে মেহজাবীনের হয়েছে দারুণ সব শিক্ষা আর অভিজ্ঞতা। সেই শিক্ষা আর অভিজ্ঞতার সমষ্টিগত রূপ নিয়েই আজকের মেহজাবীন। দেশের টিভি ও ওটিটির শীর্ষ অভিনেত্রী। অথচ তাঁর শুরুর যাত্রাটা বেশ চমকপ্রদ ও অবাক হওয়ার মতো। বলা যায় শূন্য থেকেই শুরু যা অভিনেত্রী ভোলেননি। মাঝেমধ্যেই গণমাধ্যমের সামনে সেটি তুলে ধরেন তিনি।
অভিনেত্রীর বয়ানেই শুনি সেটি, ‘শৈশব-কৈশোর কেটেছে দেশের বাইরে। তাই বাংলায় ছিলাম দুর্বল। ক্যারিয়ারের শুরুর দিকে উচ্চারণগত সমস্যার কারণে অভিনয়ে অনেক বেগ পেতে হয়েছে। ঠিকমতো স্ক্রিপ্ট পড়তে পারতাম না। আমি চাইতাম কেউ আমাকে পড়ে শোনাক। সেটিই আমার জন্য সহজ হবে। উচ্চারণ সমস্যা ঠিক করার চেষ্টা করেছি। অভিনয়কে পেশা হিসেবে নেওয়ার ইচ্ছা ছিল না। যখন ঠিক করলাম অভিনয়ে নিয়মিত হব তখন আর থেমে থাকিনি।’
এরপরের ইতিহাস তো সবারই জানা। সেই বাংলা কম জানা, আর বাংলা ভাষা উচ্চারণ সঠিকভাবে না জানা মেয়েটিই আজ বাংলা ভাষার, বাংলা ছবি নিয়ে বিশ্ব চষে বেড়াচ্ছে। এটিই নিয়তি, ভাগ্যকে পরিশ্রম দিয়ে নিজের করে নেওয়া।
নাটকে অভিনয় কমিয়ে মেহজাবীন বেশ ক’বছর ধরে ওটিটিতে ব্যস্ত ছিলেন। গত বছরের শুরুর দিকটায় হুট করে জানিয়ে দেন তিনি এবার বড়পর্দার জন্য প্রস্তুত। ভালো গল্পও পেয়েছেন। তাই দেরি নয়, এবার বড়পর্দায় নিজের ক্যারিশমা দেখানোর পালা। সিনেমাটির নাম ‘সাবা’। মাকসুদুর রহমান পরিচালিত ছবিটির শুটিং শেষ করতে না করতেই খবর আসে আরও একটি নতুন ছবির। নাম ‘প্রিয় মালতী’। নির্মাণ করলেন শঙ্খ দাশগুপ্ত। এই দুই ছবি নিয়ে আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবগুলোয় চষে বেড়ানো শুরু করলেন। আজ সাবা নিয়ে ‘টরন্টো’ তো কাল ‘প্রিয় মালতী’ নিয়ে কায়রো। সাবা যেমন টরন্টো ও বুসানে উপস্থিত দর্শক ও ক্রিটিসদের কাছে দারুণ প্রশংসা পেয়েছে তেমনই প্রিয় মালতী কায়রো ও ভারতের ইফিতে কুড়িয়েছে প্রশংসা।
সব মিলিয়ে চলতি বছরের শেষটা দুই সিনেমা নিয়ে আন্তর্জাতিক উৎসবগুলোতে দারুণ সরব থাকলেন মেহজাবীন। সর্বশেষ সৌদি আরবের জেদ্দায় অনুষ্ঠিত রেড সি ফিল্ম ফেস্টিভ্যালের সাবা নিয়ে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করলেন এই অভিনেত্রী। সেখানে লাল শাড়িতে লালগালিচায় হেঁটে তাক লাগিয়ে দিলেন ভক্তদের প্রিয় মেহু। শুধু হেঁটেই তাক লাগাননি। তাঁর ছবি সাবা দেখে করতালিতে মুখরিত হয়ে উঠেছিল পুরো হলরুম। হাততালি দিচ্ছিলেন বিশ্ববরেণ্য অস্কারজয়ী নির্মাতা স্পাইক লি।
নিজের সিনেমা নিয়ে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে ঘুরলেও দেশে কবে মুক্তি পাচ্ছে? বিষয়টি নিয়ে যেমন মেহজাবীন ভক্তরা উৎকণ্ঠায় ছিলেন তেমনি যাতনায় ছিলেন অভিনেত্রী নিজেও। এবার সবার উৎকণ্ঠা আর যাতনা কাটছে। দেশের প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পাচ্ছে মেহজাবীনের সিনেমা। তবে সেটি তাঁর অভিনীত প্রথম সিনেমা ‘সাবা’ নয় ‘প্রিয় মালতী’। মুক্তি পাচ্ছে আগামীকাল। মেহজাবীন জানালেন, সিনেমাটি যাপিত জীবনের গল্প। এতে নিম্ন-মধ্যবিত্ত লড়াকু নারীর চরিত্রে অভিনয় করেছেন তিনি। সিনেমায় তাঁর নাম মালতী রানী দাশ। গল্পে দেখা যাবে পলাশ কুমার দাশের সঙ্গে জীবনের নতুন অধ্যায় শুরু করেছিলেন তিনি।
দশটা নিম্নমধ্যবিত্ত দম্পতির মতো সংসার জীবনের ছোট ছোট স্বপ্ন বুনছিলেন তারা। বিয়েবার্ষিকী উপলক্ষে নৌকাতে ভাসতে ভাসতে কেক কাটা, সন্ধ্যায় একটু ঘোরাঘুরি, মালতীকে অবাক করে দিয়ে পলাশের উপহার দেওয়া, স্বামীস্ত্রীর খুনসুটি– সবকিছুই চলছিল সুন্দর ছন্দে। হঠাৎ একটি মার্কেটে আগুন লাগার ঘটনায় সেই ছন্দ কেটে যায়। সিনেমাটি নিয়ে মেহজাবীনের ভাষ্য, যারা সিনেমাটি দেখবেন, তারা হল থেকে একটা অনুভূতি নিয়ে বের হবেন। যারা গল্পের সিনেমা পছন্দ করেন, তাদের সিনেমাটি ভালো লাগবে বলে আমার বিশ্বাস।
সিনেমাটি সমাজের প্রতিটি সংগ্রামী নারীর গল্প বলে ইঙ্গিত দিলেন পরিচালক শঙ্খ দাশগুপ্ত। তাঁর কথায়, সিনেমায় মালতী চরিত্রটি সংগ্রামের। চরিত্রটিকে সামাজিক, অর্থনৈতিক ও মানসিক সংগ্রামের মধ্য দিয়ে যেতে হয়। দেশের অনেক নারীর জীবনেই এমন ঘটনা আছে। জীবনসংগ্রামের পাশাপাশি প্রচলিত কিছু নিয়মকেও প্রশ্ন করেছে সে। জানা গেছে সিনেমার এই গল্পটি সত্য ঘটনা থেকে অনুপ্রাণিত। মেহজাবীনের দ্বিতীয় হলেও পরিচালকের প্রথম সিনেমা এটি। তবে মুক্তির দিক থেকে এটি মেহজাবীনেরও প্রথম। ১৫ বছরের অভিনয় ক্যারিয়ারে প্রথমবারের মতো দেশের সিনেমা হলে আসছেন তিনি। এবার দেখার পালা। বড়পর্দায় কতটা ক্যারিশমা দেখাতে পারেন মেহজাবীন।
মেহজাবীন ও প্রিয় মালতী
শঙ্খ দাশগুপ্ত
সিনেমা বানানোটা আমার কাছে সব সময় কষ্টের কাজ মনে হয়। তবে ‘প্রিয় মালতী’ কাজটা আমার জন্য একদম সহজ করে দিয়েছে দুই প্রযোজক। আমি শুধু নির্মাণ ও গল্প নিয়েই ভেবেছি। সেই সঙ্গে যাদের কাস্ট হিসেবে চিন্তা করেছি, তাদের সঙ্গে পেয়েছি। এই সিনেমার ক্যামেরার সামনে-পেছনে যারাই কাজ করেছেন, তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা। পাশাপাশি মেহজাবীনের মতো অভিনেত্রীকে নিয়ে কাজ করতে পারাটাও আনন্দের। মেহজাবীন অভিনয়ে নিজেকে যেভাবে গড়েছেন, সেটা সত্যিই প্রশংসার দাবি রাখে। মেহজাবীন তাঁর কাজ দিয়ে মানুষের মনে ধীরে ধীরে নিজের স্থান যে পোক্ত করেছেন, তা তাঁর বর্তমান পরিস্থিতি দেখলেই আন্দাজ করা যায়।