ঢাকা রোববার, ০৯ মার্চ ২০২৫ , ২৪ ফাল্গুন ১৪৩১ আর্কাইভস ই পেপার

bkash
bkash
udvash
udvash
uttoron
uttoron
Rocket
Rocket
bkash
bkash
udvash
udvash

‘মেরুদণ্ডহীন পেশা’ সমাচার

লাইফস্টাইল

সাধন সরকার, আমাদের বার্তা

প্রকাশিত: ১৯:৪৩, ৪ মার্চ ২০২৫

সর্বশেষ

‘মেরুদণ্ডহীন পেশা’ সমাচার

যে জাতি যতো বেশি শিক্ষিত সে জাতি ততো বেশি উন্নত। সঠিক শিক্ষা ছাড়া জাতির সুষম উন্নয়ন সম্ভব নয়। শিক্ষাকে জাতির মেরুদণ্ড বলা হয়।

মেরুদণ্ড ছাড়া যেমন মানুষ সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারে না, তেমনি সুশিক্ষা ছাড়া জাতির উন্নতি ও সমৃদ্ধি অধরাই থেকে যায়। আর জাতির মেরুদণ্ড সোজা রাখা বা মানুষ গড়ার কাজটি করেন মহান শিক্ষকরা। সুশিক্ষা বিলিয়ে শিক্ষার্থীদের মানুষের মতো মানুষ করে তোলেন।

শিক্ষার ভিত্তি প্রাথমিক শিক্ষা আর মাধ্যমিক শিক্ষা হলো শিক্ষার মেরুদণ্ড। দুঃখজনক বিষয় হলো, মাধ্যমিকের এমপিওভুক্ত শিক্ষকরা দীর্ঘদিন ধরে অর্থকষ্টে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। ‘আর্থিক মেরুদণ্ড’ নেই এদেশের বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে চাকরি করা এমপিও শিক্ষকদের।

চাকরির শুরুতে একজন এমপিওভুক্ত (বিএডবিহীন) সহকারী শিক্ষক সর্বসাকুল্যে  বেতন পান ১২ হাজার ৭৫০ টাকা (১০ শতাংশ ভবিষ্যৎ তহবিলে কাটার পর)। শিক্ষা উপদেষ্টা ও দেশের শিক্ষা বিশেষজ্ঞদের কাছে প্রশ্ন, এই ‘নুন আনতে পান্তা ফুরায়’ বেতনে একজন এমপিওভুক্ত শিক্ষক কীভাবে চলবেন।

একজন নতুন শিক্ষকের পক্ষে এই বেতনে আদৌ জীবনধারণ সম্ভব কি না? আর যদি মনে হয় চলা সম্ভব না হয় তাহলে শিক্ষকরা কীভাবে বেঁচে আছেন, নাকি মরে গেছেন সেটাও খোঁজ নেয়া ন্যূনতম মানবিক দায়িত্ব বলে মনে করি। বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষের (এনটিআরসিএ) মাধ্যমে সুপারিশপ্রাপ্ত শিক্ষকের আবার কোনো বদলি নেই। ফলে নিজ জেলার বাইরে এই যৎসামান্য বেতনে মানবেতর জীবনযাপন করতে হচ্ছে।

সবচেয়ে বড় কষ্ট লাগে তখন যখন সুপারিশপ্রাপ্ত হয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যোগদান করার পর এমপিও ফাইল ছাড় করতে ঘাটে ঘাটে ‘কর্মকর্তাদের সন্তুষ্টি’ করা লাগে। চাকরি জীবনের শুরুতে বেতন পাওয়ার আগে পদে পদে ঘুষ দেয়ার এই গোপন কুপ্রথা কেনো বাতিল হয় না তা বোধগম্য নয়।

যে শিক্ষকরা মেরুদণ্ড গড়ার কারিগর তারাই যদি আর্থিক কষ্টে ভোগেন, তাদের যদি হাড়িতে ভাত না থাকে তাহলে তারা কীভাবে শিক্ষার্থীদের মেরুদণ্ড সোজা রাখার কাজটি করবেন? যে শিক্ষকের নিজের কোনো আর্থিক ভবিষ্যৎ নেই, যে শিক্ষকের নিজের কোনো স্বপ্ন নেই সেই শিক্ষক কী করে শিক্ষার্থীদের স্বপ্ন দেখাবেন।

আমাদের দেশের শিক্ষা দপ্তরের আমলারা শিক্ষাটা চান বিশ্বমানের কিন্তু শিক্ষকদের বেতনটা দিতে চান নিম্নমানের। বারবার দেশের শিক্ষাব্যবস্থা ও কারিকুলাম নিয়ে গবেষণা হয়েছে এবং হচ্ছে কিন্তু শিক্ষকদের মানসম্মত বেতন নিয়ে আলোচনা হলেও বাস্তবায়ন হয় না। মূলত সমস্যাটা রয়ে গেছে এখানেই।

সহজ সত্য হলো, শিক্ষকদের মানসম্মত বেতন ছাড়া মানসম্মত শিক্ষা বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয়। ঠিক এ কারণেই শিক্ষার মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য আলোর মুখ দেখছে না। এশিয়ার তো বটেই, এমনকি দক্ষিণ এশিয়ায় মাধ্যমিক শিক্ষকদের সবচেয়ে কম বেতন বাংলাদেশে।

                                    দক্ষিণ এশিয়ায় মাধ্যমিক শিক্ষকদের বেতন

দেশ

বেতন (ডলার)

মালদ্বীপ

১২৭৮

ভারত

৫১১

ভুটান

৩৫৯

নেপাল

৩৩০

পাকিস্তান

১৭৬

শ্রীলঙ্কা

১৩৯

আফগানিস্থান

১২৫

বাংলাদেশ

১২০

*ডলারের ওঠানামা বিবেচনায় হিসাব কিছুটা তারতম্য হতে পারে। সূত্র-ওয়ার্ল্ড পপুলেশন রিভিউ ও বিভিন্ন দেশের শিক্ষা মন্ত্রণালয়

দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশে মাধ্যমিক শিক্ষকদের বেতনের চিত্র দেখলেই বোঝা যায় কতোটা নিম্নমানের বেতনে চলছে এদেশের এমপিওভুক্ত শিক্ষকরা। সিঙ্গাপুরে একজন মাধ্যমিক শিক্ষকের মাসিক বেতন পাঁচ হাজার ডলারের উপরে। মুসলিম দেশ ওমান ও সৌদি আরবে মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষকের বেতন চার হাজার ডলারের উপরে। জার্মানি, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, ফিনল্যান্ড ও সুইডেনে শিক্ষকদের একমাসে যে বেতন দেয়া হয়, তা বাংলাদেশে টাকার হিসেবে একজন মাধ্যমিক শিক্ষকের পুরো বছরের বেতনের সমান।

শিক্ষকদের সামাজিক মর্যাদা নিয়ে গবেষণাকারী প্রতিষ্ঠান ‘ভার্কি ফাউন্ডেশন’ থেকে জানা যায়, শিক্ষকদের সামাজিক মর্যাদা বাড়লে শিক্ষায় তার ইতিবাচক প্রভাব পড়ে। একটা দেশের শিক্ষাব্যবস্থা বাস্তবায়নের মাধ্যমে ভবিষ্যৎ সুনাগরিক তৈরি করার মহান কাজটি করেন শিক্ষকরা। আর সেই মানুষ গড়ার কারিগররা যদি মানবেতর জীবনযাপন করেন তাহলে পুরো শিক্ষার যা হবার তা সহজেই অনুমেয়! শিক্ষাব্যবস্থা এখন অনেকটাই পরীক্ষা ও সনদনির্ভর হয়ে পড়েছে! ‘জিপিএ-৫’ প্রাপ্তির লোভ চারদিকে। যেকোনোভাবে জিপি-৫ পেতেই হবে! এই লোভ থাকাটা যদিও অস্বাভাবিক নয়! শিক্ষাকে ক্রমান্বয়ে পণ্য ও ব্যবসায় রূপ দেয়া হয়েছে। শিক্ষা ও শিক্ষকদের অবহেলিত করে রাখা হয়েছে।

একবিংশ শতাব্দীর আগেও শিক্ষকদের সম্মানী হয়তো কম ছিলো কিন্তু বুকভরা সম্মান ছিলো। আর এখন শিক্ষকের সম্মান ও সম্মানী দুটো নিয়েই টানাটানি চলছে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ এগিয়ে যাওয়ার মূলে রয়েছে মানসম্মত কারিকুলাম ও শিক্ষকদের মানসম্মত বেতন।

একবিংশ শতাব্দীতে অন্যান্য সব পেশায় কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন কয়েক দফায় বেড়েছে কিন্তু শিক্ষকদের সম্মানী বাড়ানো হয়নি। একটা সময় ছিল শিক্ষককে ভালো মানুষ ও বংশ মর্যাদা বিবেচনায় এগিয়ে রাখা হতো। কিন্তু অন্যান্য পেশার তুলনায় শিক্ষকতাকে ‘মেরুদণ্ডহীন পেশা’ করে রাখা হয়েছে। ১২ হাজার ৭৫০ টাকার শিক্ষকতার চাকরি এই বাজারে স্রেফ মেরুদণ্ডহীন পেশা ছাড়া আর কিছুই নয়।

শিক্ষকদের এই নিম্নমানের বেতন দিয়ে আধুনিক কালের ‘দাস মানসিকতার’ পরিচয় দেয়া হচ্ছে কি না সেটাও বিবেচনার দাবি রাখে। এমপিওভুক্ত বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা মূল বেতনের ‘সিকি’ বা এক চতুর্থাংশ উৎসব ভাতা পান। এটা একটা জঘন্য নিয়ম। সিকি উৎসব ভাতা বাংলাদেশের আর কোনো চাকরিতে নেই। এমনকি পৃথিবীর আর কোনো দেশে শিক্ষকদের সিকি উৎসব ভাতা দেয়া হয় না। শিক্ষকতা পেশাকে দেশের নীতিনির্ধারক পর্যায় থেকে খাটো করে দেখা হয়। আর খাটো করে দেখা হয় বলেই সিকি উৎসব ভাতার মতো বাজে প্রথা শুধু শিক্ষকদের জন্য চালু রাখা হয়েছে।

সিকি উৎসব ভাতার কথা শুনে মেধাবীরা নাক সিটকান! বর্তমান ‘নুন আনতে পান্তা ফুরানো’ বেতন কাঠামো মেধাবীদের শিক্ষকতা পেশায় টানতে অক্ষম। আর বেতন কম থাকার কারণে যে পেশায় মেধাবীরা আসে না সে পেশার মাধ্যমে মানসম্মত শিক্ষা অর্জন কীভাবে সম্ভব? শিক্ষা উপদেষ্টা প্রফেসর ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ সম্প্রতি দুঃখ প্রকাশ করে বলেছেন, এমপিওভুক্ত শিক্ষকরা সবচেয়ে বেশি অবহেলিত। তিনি বলেছেন, শিক্ষার প্রসার হয়েছে কিন্তু মানের উন্নতি হয়নি। এমন সত্য কথা গত দুই দশক ধরে আকাশে বাতাসে ঘুরপাক খাচ্ছে। কিন্তু কাজের কাজটি নীতিনির্ধারক পর্যায় থেকে কখনো কিছু করা হয় না। শিক্ষার মানের উন্নতি করবেন শিক্ষকরা। সেই শিক্ষকরাই তো অবহেলিত। তাহলে শিক্ষার মানের উন্নতি হবে কীভাবে?

মেধাবীরা শিক্ষকতা পেশাকে বিশেষ করে মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষকতা এখন পছন্দ করেন না। কেনোনা এ পেশায় সম্মান ও সম্মানী নেই। অন্য যেকোনো পেশায় শিক্ষকতার চেয়ে অনেক বেশি সম্মান ও সম্মানী পাওয়া যায়। শিক্ষকতা পেশা মেধাবীদের আকৃষ্ট করছে না, সে ব্যাপারে নীতিনির্ধারকরা কেনো ভাবছেন না তা বোধগম্য নয়।

মাধ্যমিক পর্যায়ের প্রায় ৯৫ ভাগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বেসরকারি (স্কুল, কলেজ, মাদরাসা, কারিগরি)। মাধ্যমিকের এই ৯৫ ভাগ শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের অবহেলিত করে রাখা মানেই পুরো মাধ্যমিক শিক্ষাকেই অবহেলিত করে রাখা।  শিক্ষাখাতে কোটি কোটি টাকা অপচয়ের প্রমাণ মেলে, শিক্ষায় দুর্নীতির হদিস পাওয়া যায়। কিন্তু যখন শিক্ষকদের বেতন বাড়ানোর প্রসঙ্গ আসে তখন শুধু আশ্বাসেই শেষ।

শিক্ষকরা তাদের পেট বাঁচানোর স্বার্থে দীর্ঘদিন থেকে মানসম্মত বেতনের দাবিতে লড়াই করছেন। নীতিনির্ধারক থেকে বছরের পর বছর ধরে মানসম্মত শিক্ষার কথা মুখে বলে গেলেই শিক্ষার মানের উন্নয়ন হবে না। যারা মানসম্মত শিক্ষা বাস্তবায়ন করবেন সেই শিক্ষকদের দিকে তাকাতে হবে।

তাদের জীবনমানের উন্নয়ন ঘটাতে হবে। শিক্ষকদের দীর্ঘদিনের দাবি বাস্তবায়ন ব্যতীত মানসম্মত শিক্ষা ও শিক্ষার উদ্দেশ্য অর্জন সম্ভব নয়। এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের যাতনার নাম ‘সিকি উৎসব ভাতা’ এখনই বাতিল করা উচিত। এ ছাড়া এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের চলমান আন্দোলনকে সম্মান জানিয়ে সরকারি শিক্ষকদের মতো বাড়িভাড়া, চিকিৎসা ভাতাসহ অন্যান্য সুযোগসুবিধার ন্যায়সঙ্গত সমাধান জরুরি। এক্ষেত্রে মাধ্যমিক শিক্ষা জাতীয়করণ যৌক্তিক সমাধান হতে পারে। দেশের শিক্ষার স্বার্থে আজ কিংবা কাল মাধ্যমিক শিক্ষা জাতীয়করণ করতেই হবে।

লেখক: শিক্ষক

জনপ্রিয়