দুর্নীতির অভিযোগ উঠলে বিভাগীয় মামলা হয়। পরে স্বেচ্ছায় অবসরে যাওয়ার আবেদন করলে প্রথমে নামঞ্জুর হলেও পরে মঞ্জুর হয়। কিন্তু স্বাভাবিকভাবে অবসরের জন্য তিন বছর বাকি ছিল সে সময়। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর সম্প্রতি অবসরের বাকি থাকা তিন বছরের আর্থিক সুবিধা চেয়ে আবেদন করেছেন সাবেক বিচারক আবুল হোসেন খান।
মন্ত্রণালয় থেকে এই বিষয়ে প্রস্তাব পাঠালে তা নাকচ করে দিয়েছেন সুপ্রিম কোর্ট।
জানতে চাইলে সুপ্রিম কোর্টের স্পেশাল অফিসারের দায়িত্বে থাকা ডেপুটি রেজিস্ট্রার ড. আতিকুস সামাদ বলেন, এ রকম কোনো নজির নেই। এ কারণে সুপ্রিম কোর্ট আবুল হোসেন খানের আবেদন নাকচ করে দিয়েছেন।
আবুল হোসেন খান মুন্সেফ (বর্তমানে সহকারী জজ) হিসেবে ১৯৮৩ খ্রিষ্টাব্দের ১৭ জুলাই যোগদান করেন। ২০০৪ খ্রিষ্টাব্দের ১৮ সেপ্টেম্বর জেলা ও দায়রা জজ হন। নরসিংদীর জেলা ও দায়রা জজ হিসেবে কর্মরত থাকা অবস্থায় তাঁর বিরুদ্ধে নরসিংদীর চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট কার্যালয়ে বিভিন্ন পদে লোক নিয়োগে অনিয়ম, দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতি, বিচারকাজ চলাকালে আইনজীবীদের সঙ্গে অসদাচরণ, কিছু আইনজীবীকে বিশেষ সুবিধা দিয়ে আইনজীবীদের মধ্যে বিভাজন সৃষ্টি, পূর্ববর্তী জেলা ও দায়রা জজদের দেওয়া আদেশের বিষয়ে কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য, একজন সহকারী জজের বিরুদ্ধে তাঁর তালাকপ্রাপ্ত স্বামীকে দিয়ে মামলা করানোরও অভিযোগ ওঠে।
এসব অভিযোগ ওঠার পর আবুল হোসেন খানকে বদলি করা হয় সাতক্ষীরা আদালতে। সেখানে জেলা ও দায়রা জজ হিসেবে কর্মরত থাকা অবস্থায় মৃত্যুদণ্ডাদেশপ্রাপ্ত দুই আসামিকে আইনবহির্ভূতভবে ছেড়ে দেয়ার অভিযোগ ওঠে তাঁর বিরুদ্ধে। এরপর তাঁকে বদলি করা হয় নীলফামারীর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে।
বিচারক আবুল হোসেন খানের বিরুদ্ধে পূর্ত মন্ত্রণালয়ের আইন উপদেষ্টা হিসেবে কর্মরত থাকা অবস্থায় দুর্নীতির মধ্যমে মিরপুরের একটি শহীদ পরিবারকে সরকারি বরাদ্দকৃত বাড়ি থেকে উচ্ছেদ করে আরেকজনকে ওই বাড়ি দেয়ার পক্ষে লিখিত মতামত দেওয়ার অভিযাগও রয়েছে।
এ ছাড়া দুর্নীতির মাধ্যমে সরকারের অনুমোদন ছাড়া ঢাকায় ফ্ল্যাট ও গাড়ি কিনেছেন বলেও তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠে। এসব অভিযোগ প্রাথমিক তদন্তের জন্য সে সময় জাতীয় আইনগত সহায়তা প্রদান সংস্থার পরিচালক হিসেবে কর্মরত (জেলা জজ) সৈয়দ আমিনুল ইসলামকে তদন্তকারী কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ করা হয়। প্রাথমিক তদন্তে সব অভিযোগের প্রমাণ পাওয়া যায়। এরপরই আবুল হোসেন খানকে আইন মন্ত্রণালয়ে সংযুক্ত করা হয়।
মন্ত্রণালয়ে সংযুক্ত করার পর বিচারক আবুল হোসেনের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা ও সাময়িক বরখাস্ত করতে প্রস্তাব পাঠানো হয় সুপ্রিম কোর্টে। ঠিক ওই সময় ২০১১ খ্রিষ্টাব্দের ৩০ মে স্বেচ্ছায় অবসরে যেতে আবেদন করেন তিনি। ওই বছরের ২০ জুলাই সুপ্রিম কোর্টের জিএ কমিটি মন্ত্রণালয়ের প্রস্তাবের সঙ্গে একমত পোষণ করে, তবে স্বেচ্ছায় অবসরে যাওয়ার আবেদন নাকচ করে দেয়। সুপ্রিম কোর্টের ফুলকোর্ট সভায়ও জিএ কমিটির সিদ্ধান্ত বহাল থাকে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র বলেছে, আইন মন্ত্রণালয় বিচারক আবুল হোসেনকে ২০১১খ্রিষ্টাব্দের ৮ সেপ্টেম্বর সাময়িক বরখাস্ত করে তাঁর বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা করে। পরবর্তী সময়ে স্বেচ্ছায় অবসরে যেতে করা আবেদন পুনর্বিবেচনার জন্য আবারও সুপ্রিম কোর্টে পাঠানো হয়। অবশেষে সুপ্রিম কোর্ট সাময়িক বরখাস্তের আদেশ প্রত্যাহার করে স্বেচ্ছায় অবসরের আবেদন মঞ্জুর করেন এবং বিধি অনুযায়ী প্রাপ্য পরিশোধ করতে বলা হয়। ২০১২ খ্রিষ্টাব্দের ১০ জুলাই বিভাগীয় মামলার কার্যক্রম এবং সাময়িক বরখাস্তের আদেশ প্রত্যাহার করে অবসরে পাঠানো হয় আবুল হোসেনকে। তবে চাকরির বয়স অনুযায়ী ২০১৫ খ্রিষ্টাব্দের ২৪ ডিসেম্বর অবসরে যাওয়ার কথা ছিল তাঁর।
ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর গত ১৮ আগস্ট আইন মন্ত্রণালয়ের সচিব বরাবর তিন বছরের বেতন-ভাতাসহ অন্যান্য সুবিধা পেতে আবেদন করেন আবুল হোসেন খান। মন্ত্রণালয় থেকে বিষয়টি বিবেচনার জন্য ১১ সেপ্টেম্বর পাঠানো হয় সুপ্রিম কোর্টে। তবে সুপ্রিম কোর্ট গত ২৪ অক্টোবর তা নাকচ করেন।
আবুল হোসেন আইনসচিব বরাবর করা আবেদনে বলেন, ২০১১খ্রিষ্টাব্দের ৭ আগস্ট তাঁর স্বেচ্ছায় অবসরের আবেদনটি নামঞ্জুর হয়েছিল। এরপর তিনি দায়িত্ব পালনরত অবস্থায় তাঁর পক্ষ থেকে পুনরায় আবেদন না করার পরও হঠাৎ অবসরে পাঠানো হয়। অথচ তিনি ২০১৫ খ্রিষ্টাব্দের ২৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত নিয়মিত চাকরি করে অবসর গ্রহণ করার অধিকারী ছিলেন। তাই উল্লেখিত সময়কে চাকরিকাল গণ্য করে বকেয়া বেতন-ভাতা প্রদান করার আবেদন করেন তিনি।