শেখ হাসিনার শাসনামলে ২০০৯ থেকে ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত স্বাক্ষরিত বড় বিদ্যুৎ উৎপাদন চুক্তি পর্যালোচনায় সহায়তার জন্য একটি লিগ্যাল ও তদন্তকারী সংস্থাকে দায়িত্ব দেয়ার সুপারিশ করেছে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত জাতীয় পর্যালোচনা কমিটি। বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন পর্যালোচনা কমিটির এক প্রস্তাবে গতকাল অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে এ সুপারিশ করা হয়। সেই সঙ্গে আরো জানানো হয়েছে, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের অন্য চুক্তিগুলো বিশ্লেষণ করতে কমিটির আরো সময় প্রয়োজন।
পর্যালোচনা কমিটি এমন সব তথ্যপ্রমাণ সংগ্রহ করছে, যা আন্তর্জাতিক সালিশি আইন ও কার্যধারার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে চুক্তি পুনর্বিবেচনা বা বাতিল করতে পারে। এক্ষেত্রে তাদেরকে সহায়তায় শীর্ষমানের এক বা একাধিক আন্তর্জাতিক আইন এবং তদন্তকারী সংস্থাকে অবিলম্বে যুক্ত করার সুপারিশ করা হয়েছে। কমিটি অন্তর্বর্তী সরকারকে আরো জানিয়েছে, তারা নিশ্চিত করতে চায় যে তদন্তগুলো আন্তর্জাতিক মান নিশ্চিতের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক আলোচনা ও সালিশে গ্রহণযোগ্য হবে।
দেশে বিদ্যুৎ চাহিদা পূরণের লক্ষ্যে ২০১০ খ্রিষ্টাব্দে ‘বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) আইন’ করে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার। দুই বছরের জন্য করা এ আইনের মেয়াদ পরে তিন দফা বাড়ানো হয়। এতে আইনটি ১৪ বছর ধরে স্থায়ী হয়। এ আইনের অধীনে বাস্তবায়ন হয় দেশের বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের বহু প্রকল্প। এ আইনের আওতায় প্রতিযোগিতা ছাড়াই বিদ্যুৎ, জ্বালানি কেনা ও অবকাঠামো নির্মাণের সুযোগ রাখা হয়। এমনকি এর বিরুদ্ধে আদালতে যাওয়ারও কোনো সুযোগ ছিল না। তাই এটি দায়মুক্তি আইন হিসেবেও পরিচিতি পায়।
বিতর্কিত এ আইন কার্যকর করে দেশের বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে আওয়ামী লীগ সরকার বিপুল অনিয়ম ও দুর্নীতি করেছে বলে অভিযোগ রয়েছে। এমনকি একচেটিয়া বেশ কয়েকটি কোম্পানিকে কাজ দিয়ে বিপুল পরিমাণ অর্থ পাচার করার অভিযোগও রয়েছে।
বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (বিপিডিবি) তথ্য অনুযায়ী, আইনটি কার্যকর হওয়ার পর বিভিন্ন সময়ে প্রায় ৯১টি বেসরকারি ও ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মিত হয়েছে, যার বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা প্রায় ১১ হাজার ৭০০ মেগাওয়াট। এর মধ্যে অনেকগুলো কেন্দ্রকে বসিয়ে রেখেই বিগত সরকার বছরের পর বছর বিপুল পরিমাণ ক্যাপাসিটি চার্জ দিয়েছে, যা নিয়ে বেশ সমালোচনাও হয়।
অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় এসে দেশে বিদ্যুৎ ও জ্বালানির বিশেষ আইন স্থগিত করে। ফলে দেশের বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের বহু প্রকল্প অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ে যায়। এমনকি বেশ কয়েকটি চুক্তি এরই মধ্যে সরকার বাতিলও করেছে।
বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি আইনের অধীনে করা চুক্তিগুলো পর্যালোচনা করতে গত ৫ সেপ্টেম্বর হাইকোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি মঈনুল ইসলাম চৌধুরীর নেতৃত্বে কমিটি গঠন করে সরকার।
কমিটির কার্যপরিধিতে বলা হয়, কমিটি তাদের কাজের জন্য যেকোনো সূত্র থেকে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ ও প্রয়োজনীয় যেকোনো নথি নিরীক্ষা করতে পারবে। সংশ্লিষ্ট যেকোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে শুনানিতে আহ্বান করতে পারবে কমিটি। এছাড়া কমিটি ‘বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) আইন, ২০১০’-এর আওতায় সম্পাদিত চুক্তিগুলোয় সরকারের স্বার্থ সংরক্ষিত হয়েছে কিনা, তা নিরীক্ষা করবে। নিরীক্ষার ভিত্তিতে পরবর্তী কার্যক্রম বিষয়ে সুপারিশ প্রণয়ন করবে এবং বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় কমিটিকে সাচিবিক ও আনুষঙ্গিক সহায়তা দেবে।
জাতীয় পর্যালোচনা কমিটি গত ৩ অক্টোবর আদানি, সামিট ও বেক্সিমকোসহ মোট ১১টি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের চুক্তি পর্যালোচনার জন্য প্রয়োজনীয় তথ্য চায় বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের কাছে। এর মধ্যে ভারতের ঝাড়খণ্ড জেলার গড্ডায় স্থাপিত ১ হাজার ৬০০ মেগাওয়াট সক্ষমতার বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি নির্মাণে ২০১৭ খ্রিষ্টাব্দের ৫ নভেম্বর আদানি পাওয়ারের সঙ্গে চুক্তি সই করে বিপিডিবি। অভিযোগ রয়েছে, আদানির কাছ থেকে বিদ্যুৎ কেনার ওই চুক্তি সইয়ে গোপনীয়তা অনুসরণ করা হয়। কেন্দ্রটি থেকে বিদ্যুৎ কিনতে বিপিডিবির সঙ্গে চুক্তি রয়েছে ২৫ বছর মেয়াদি। শর্ত অনুযায়ী, চাহিদা না থাকলেও বিপিডিবিকে ৩৪ শতাংশ বিদ্যুৎ কিনতে হবে। পাশাপাশি এ বিদ্যুৎ কেন্দ্রে যে কয়লা ব্যবহার হয় সেখানেও নেয়া হচ্ছে বেশি দাম।
দেশের প্রথম আল্ট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল প্রযুক্তির বিদ্যুৎ কেন্দ্র পায়রা ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট থার্মাল পাওয়ার প্লান্ট (প্রথম পর্যায়)। প্রকল্পটি সমান মালিকানায় যৌথ কোম্পানি বাংলাদেশ-চায়না পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেড (বিসিপিসিএল)। রাষ্ট্রায়ত্ত মালিকানাধীন নর্থ-ওয়েস্ট পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি লিমিটেড (এনডব্লিউপিজিসিএল) এবং চায়না ন্যাশনাল মেশিনারিজ ইমপোর্ট অ্যান্ড এক্সপোর্ট করপোরেশন (সিএমসি) যৌথভাবে এটি পরিচালনা করছে। প্রকল্পটিতে ব্যয় হয়েছে ১৯ হাজার ৫৫০ কোটি টাকা।