বিচার বিভাগ স্বতন্ত্রীকরণের প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ ও উচ্চ আদালতের বিচারক নিয়োগে স্বতন্ত্র কাউন্সিল গঠনের চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে বিচার বিভাগ।
প্রধান বিচারপতির সভাপতিত্বে কাউন্সিলের মোট সদস্য সংখ্যা হবে ১০ জন। তিনি নিজেই কাউন্সিলের চেয়ারম্যান হবেন। এ ছাড়া, উক্ত কাউন্সিলের সদস্য হবেন, যথাক্রমে আপিল বিভাগের প্রবীণতম জ্যেষ্ঠ বিচারক, আপিল বিভাগের দ্বিতীয় প্রবীণতম জ্যেষ্ঠ বিচারক, হাইকোর্ট বিভাগের প্রবীণতম জ্যেষ্ঠ বিচারক, অধস্তন আদালতের বিচারক থেকে হাইকোর্ট বিভাগের বিচারক হিসেবে নিযুক্ত হয়েছেন এমন বিচারকদের থেকে প্রবীণতম জ্যেষ্ঠ বিচারক, অ্যাটর্নি জেনারেল, সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের মনোনীত বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন আইনের অধ্যাপক এবং দুইজন নাগরিক প্রতিনিধি।
প্রস্তাবটিতে নাগরিক প্রতিনিধি নিযুক্ত করার নিয়ামাবলী সম্পর্কে বলা হয়েছে, কাউন্সিলের শিক্ষক সদস্য ব্যতিরেকে অন্যান্য সদস্যদের সংখ্যাগরিষ্ঠ সিদ্ধান্ত অনুসারে প্রণীত বিধি মোতাবেক, কিংবা এমন বিধি প্রণীত না হওয়া পর্যন্ত কাউন্সিলের চেয়ারম্যানের লিখিত আদেশ অনুসারে দুই বছরের জন্য নাগরিক সদস্যরা নিযুক্ত হবেন। মঙ্গলবার এ সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়।
বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদ গত ১১ আগস্ট বাংলাদেশের ২৫তম প্রধান বিচারপতি হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন। প্রধান বিচারপতির দায়িত্বভার গ্রহণ করার পর গত ১২ আগস্ট তিনি সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবীদের উদ্দেশে প্রদত্ত অভিষেক বক্তব্যে এবং গত ২১ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের ইনার কোর্ট ইয়ার্ডে সুপ্রিম কোর্টের উভয় বিভাগের বিচারপতিরা ও ডিস্ট্রিক্ট জুডিসিয়ারির বিচারকদের সম্মুখে উপস্থাপনকৃত বিচার বিভাগ সংস্কারের রোডম্যাপ-এ রাষ্ট্রের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ হিসেবে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, স্বতন্ত্রীকরণ ও প্রাতিষ্ঠানিক পৃথকীকরণের ওপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেন।
এ প্রেক্ষাপটে, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিতকল্পে মাসদার হোসেন মামলার রায়ের বাস্তবায়নে পৃথক বিচার বিভাগীয় সচিবালয় প্রতিষ্ঠায় প্রয়োজনীয় আইনি ও কাঠামোগত সংস্কার আনয়ন, বিচার বিভাগের জন্য স্বতন্ত্র ও পর্যাপ্ত বাজেট বরাদ্দকরণ, অধস্তন আদালতের বিচারকদের বদলি ও পদায়নে স্বচ্ছতা নিশ্চিতকরণসহ বিচার বিভাগে মেধার চর্চার উন্মেষের লক্ষ্যে উচ্চ আদালতের বিচারক নিয়োগে উন্নত দেশগুলোর মতো সুনির্দিষ্ট আইন প্রণয়নের লক্ষ্যে প্রধান বিচারপতি বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেন।
জানা গেছে, এরই অংশ হিসেবে গত ২৭ অক্টোবর সুপ্রিম কোর্ট থেকে পৃথক বিচার বিভাগীয় সচিবালয় গঠন সংক্রান্ত প্রস্তাব আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। উক্ত প্রস্তাবে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ১০৯ অনুচ্ছেদের উদ্দেশ্য পূরণে হাইকোর্ট বিভাগ অধস্তন আদালত ও ট্রাইব্যুনালের তত্ত্বাবধান ও নিয়ন্ত্রণ যথাযথভাবে পালনের উদ্দেশে একটি স্বতন্ত্র সচিবালয় প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে একটি অধ্যাদেশের খসড়া, প্রস্তাবিত সচিবালয়ের অর্গানোগ্রাম এবং Rules of Business ও Allocation of Business এর সম্ভাব্য সংস্কার সম্পর্কে পরিপূর্ণ প্রস্তাবও পাঠানো হয়।
পরে গত ১০ ডিসেম্বর সুপ্রিম কোর্ট রেজিস্ট্রির তিনজন কর্মকর্তা আইন ও বিচার বিভাগের সচিবের কক্ষে আইন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতে প্রস্তাবিত বিচার বিভাগীয় সচিবালয়ের বিভিন্ন কৌশলগত বিষয় সম্পর্কে প্রেজেন্টেশন উপস্থাপন করেন। ফলে পৃথক বিচার বিভাগীয় সচিবালয় গঠনের বিষয়টি পুনরায় বেগবান হয়।
বর্তমানে বিচার বিভাগীয় সচিবালয় তৈরির বিষয়টি আইন মন্ত্রণালয়ে সক্রিয়ভাবে প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। আশা করা যায়, অচিরেই বিচার বিভাগের জন্য পৃথক সচিবালয় স্থাপনের বিষয়ে সুপ্রিম কোর্ট ও আইন মন্ত্রণালয়ে গৃহীত পদক্ষেপগুলো দৃশ্যমান হবে।
পৃথক বিচার বিভাগীয় সচিবালয় প্রতিষ্ঠিত হলে অধস্তন আদালতের বিচারকগণের পদায়ন, বদলি, পদোন্নতি, শৃঙ্খলা, ছুটি ইত্যাদি বিষয়ে প্রচলিত দ্বৈত শাসনের অবসান ঘটবে এবং বিচার বিভাগের প্রকৃত স্বাধীনতা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে বলেও জানা গেছে।
এ ছাড়া, গত ২১ সেপ্টেম্বর ঘোষিত রোডম্যাপের ধারাবাহিকতায় ইতোমধ্যে দেশের উচ্চ আদালতের বিচারক নিয়োগে সুনির্দিষ্ট আইন প্রণয়নের কাজ চলমান রয়েছে। প্রতিবেশী দেশগুলোর বিশ্বের উন্নত দেশগুলোতে উচ্চ আদালতের বিচারক নিয়োগে যেসব প্রক্রিয়া অনুসৃত হয় তা গভীরভাবে বিশ্লেষণ করে সংক্রান্ত একটি অধ্যাদেশ এর খসড়া প্রস্তুত করা হয়।
এ খসড়া সম্পর্কে সুপ্রিম কোর্টের উভয় বিভাগে কর্মরত বিচারপতিদের মতামতের জন্য গত ১৪ নভেম্বর বিচারপতিদের নিকট খসড়া প্রস্তাবটি পাঠানো হয়। তৎপ্রেক্ষিতে বিচারপতিদের নিকট হতে উচ্চ আদালতের বিচারক নিয়োগ সংক্রান্ত মোট ১৫টি মতামত পাওয়া যায়। এ মতামত নিরীক্ষা করে সুপ্রিম কোর্টের সুপারিশ গত ২৮ নভেম্বরে আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়।
সুপ্রিম কোর্টের প্রস্তাবে উচ্চ আদালতের বিচারক নিয়োগের জন্য একটি জুডিসিয়াল অ্যাপোয়েন্টমেন্ট কাউন্সিল গঠনের প্রস্তাব রাখা হয়।
উল্লেখ্য, বিশ্বের অন্যান্য দেশ, যেমন-ইংল্যান্ড, আয়ারল্যান্ড, কেনিয়া, মালয়েশিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা, ভারত ও পাকিস্তানে উচ্চ আদালতের বিচারক নিয়োগে স্বাধীন নিরপেক্ষ কমিশন বা অনুরূপ প্রতিষ্ঠান বিদ্যমান রয়েছে।
সুপ্রিম কোর্টের পাঠানো প্রস্তাবে সুপ্রিম কোর্টের বিচারক পদে নিয়োগের লক্ষ্যে উপযুক্ত ব্যক্তি বাছাইক্রমে রাষ্ট্রপতির নিকট সুপারিশ করার জন্য একটি ‘জুডিসিয়াল অ্যাপোয়েন্টমেন্ট কাউন্সিল’ গঠনের কথা বলা হয়েছে।
সুপ্রীম কোর্টের বিচারক পদে উপযুক্ত প্রার্থীকে সুপারিশ প্রদানসহ কাউন্সিলের যেকোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে সংখ্যাগরিষ্ঠ মতামতের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গৃহীত হবে মর্মে প্রস্তাবে উল্লেখ রয়েছে। সংবিধানের ৯৫ ও ৯৮ অনুচ্ছেদের অধীনে বিচারক নিয়োগের নিমিত্ত সুপারিশ প্রদান করার জন্য রাষ্ট্রপতি কর্তৃক অনুরোধ জ্ঞাপন করা হলে কাউন্সিল সম্ভাব্য প্রার্থীগণের নিকট হতে দরখাস্ত আহ্বান করে গণবিজ্ঞপ্তি জারি করবে মর্মে প্রস্তাবে সুপারিশ করা হয়েছে।
এছাড়া, কাউন্সিল প্রাথমিকভাবে বাছাইকৃত প্রার্থীদের বিষয়ে মতামত বা পরামর্শ গ্রহণের জন্য সংশ্লিষ্ট যে কোন ব্যক্তিকে কাউন্সিলের সভায় আহবান করতে পারবে বা যে কোন সরকারি বা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে কাউন্সিল কর্তৃক চাহিদাকৃত তথ্য উপস্থাপনের নির্দেশ প্রদান করতে পারবে মর্মে প্রস্তাবে উল্লেখ রয়েছে।
সুপ্রিম কোর্টের উক্ত প্রস্তাবে উচ্চ আদালতের বিচারক নিয়োগের জন্য একটি জুডিসিয়াল অ্যাপোয়েন্টমেন্ট কাউন্সিল গঠনের প্রস্তাব রাখা হয়েছে।
উল্লেখ্য, বিশ্বের অন্যান্য দেশ, যেমন- ইংল্যান্ড, আয়ারল্যান্ড, কেনিয়া, মালয়েশিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা, ভারত ও পাকিস্তানে উচ্চ আদালতের বিচারক নিয়োগে স্বাধীন নিরপেক্ষ কমিশন বা অনুরূপ প্রতিষ্ঠান বিদ্যমান রয়েছে।