সচিবালয়ে অগ্নিকাণ্ডে কয়েকটি মন্ত্রণালয়ের নথি নষ্ট হয়ে যাওয়ার ঘটনা এখন অন্যতম আলোচনার বিষয়। সরকারের দায়িত্বশীল ব্যক্তিদেরই অভিযোগ, দুর্নীতির নথি পুড়িয়ে দিতে পরিকল্পিতভাবে ওই আগুনের নাশকতা ঘটানো হয়। গত বুধবার দিবাগত রাতের ওই অগ্নিকাণ্ডে পর নথি চুরি হওয়া ঠেকাতে সতর্ক হয়ে উঠেছেন বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্তাব্যক্তিরা। এরই মধ্যে সবিবালয়ে প্রবেশাধিকার নিয়ন্ত্রিত করার যে ঘোষণা দেয়া হয়েছে সেটাও সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিতের পাশাপাশি নাশকতায় নথি নষ্ট ও চুরি ঠেকাতে সহায়ক হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
অতীতের ঘটনাপ্রবাহ বিশ্লেষণ করে দৈনিক আমাদের বার্তা দেখেছে, প্রশাসনের প্রাণকেন্দ্র সচিবালয় থেকে নথি চুরির ঘটনা নতুন নয়। রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত বদলে দিতে বা তথ্য পাচারের উদ্দেশে সচিবালয় থেকে ফাইল খোয়া যাওয়া বা চুরির ঘটনা অনেক। কখনো আমলারাই ফাইল সরিয়ে ফেলেছেন, কখনো রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাচারের উদ্দেশে সচিবালয়ে সঙ্ঘবদ্ধ চুরিও সংঘটিত হয়েছে। এ নিয়ে দফায় দফায় জিডি ও মামলা হলেও সেগুলোর নিষ্পত্তি হয়নি। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অভিযোগের তীর ছিলো সচিবালয়ের আমলা ও কর্মচারীদের দিকে। এসব ক্ষেত্রে অভিযুক্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের রক্ষা করতে আমলাদের তৎপরতার ঘটনাও আছে ভুরি ভুরি।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ১৯৮১ এর জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত রাজধানীর রমনা থানায় সর্বমোট ১৬১টি এজাহার দায়ের করা হয়। এসব মামলায় মন্ত্রণালয়ের গার্ড, পিয়নসহ ৪র্থ শ্রেণির প্রায় ১০ জনকে আটক এবং বেশ কিছু সংখ্যক কর্মচারীকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। এজাহারে, জরুরি ফাইল গায়েব, টাইপ রাইটিং মেশিনের যন্ত্রাংশসহ বিভিন্ন স্টেশনারি সামগ্রী চুরি যাওয়ার কথা উল্লেখ করা হয়। একই সংঘবদ্ধ দল এ চুরির সঙ্গে যুক্ত। চোরদের হাতে মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন অফিস কক্ষ ও আলমারির ডুপ্লিকেট চাবি থাকতো। ফাইল চুরির এসব ঘটনা তদন্ত করতে গেলে একজন অপরজনের ওপর দোষ চাপিয়ে দেয়। পুলিশ কাউকে গ্রেফতার করতে গেলে বিভাগীয় তদন্তের পর দোষীদের থানায় সোপর্দ করা হবে বলে আশ্বাস দিয়ে পুলিশকে বিদায় করা হয়। এভাবেই দোষী লোকজন ছাড়া পেয়েছে।
১৯৮৩ খ্রিষ্টাব্দের মে মাসে সচিবালয়ের প্রধান ভবনে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের ৬টি কক্ষের তালা ভেঙে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ ফাইল চুরি হয় মর্মে তৎকালীন গণমাধ্যমের খবরে উল্লেখ করা হয়। চোরেরা রুমের তালা ভেঙে ভেতরে প্রবেশ এবং লোহার আলমারী ও ড্রয়ারের তালাও ভেঙে সুরক্ষিত অবস্থায় রাখা সরকারের গুরুত্বপূর্ণ ফাইল নিয়ে পালিয়ে যায়। কেউ শাস্তি পেয়েছিলো কিনা তা অজানা।
এর একদশক পর ১৯৯৪ খ্রিষ্টাব্দের জুনে প্রকাশিত খবরে, ১৯৯১ থেকে ১৯৯৪ খ্রিষ্টাব্দ এ তিন বছরে সচিবালয়ে ১৬৩টির চুরির ঘটনার কথা উল্লেখ করা হয়। বলা হয়, মন্ত্রী-সচিব, যুগ্নসচিব, প্রধান তথ্যকর্মকর্তাসহ শীর্ষ কর্মকর্তাদের কক্ষে চুরির ঘটনা বেশি ঘটেছে। এ রকম ১৭টি চুরির ঘটনায় গঠিত তদন্ত রিপোর্ট প্রকাশিত হয়নি। এতে চুরির ঘটনাও উদঘাটন হয়নি। ফলে রাতের আঁধারে সচিবালয় অপরাধীদের আস্তানায় পরিণত হয়। বহিরাগত চোর ও সচিবালয়ের কর্মচারীদের যোগসাজশে এসব চুরি হয়। চুরির তালিকায় রয়েছে টিভি, ক্যাসেট, আসবাবপত্র থেকে শুরু করে গুরুত্বপূর্ণ ফাইল। গুরুত্বপূর্ণ ফাইলগুলো অনেক সময় চুরি করে ধ্বংস করে দেয়া হয়।
জানা গেছে, সরকারি নথি চুরির সূত্র ধরেই ২০০৪ খ্রিষ্টাব্দে টিউলিপ কম্পিউটার আমদানির বিষয়টি সামনে আসে। ১৯৯৬ খ্রিষ্টাব্দে সরকার গঠনের পর মেয়াদের শেষ দিকে আওয়ামী লীগ নেদারল্যান্ড থেকে ১০ হাজার কম্পিউটার আনার একটি চুক্তি করেছিলো। পরে বিএনপির নেতৃত্বে গঠিত জোট সরকার ওই প্রকল্প বাতিল করে দেয়।
সচিবালয়ের নথি চুরির এমন আরো অনেক ঘটনা প্রকাশিত হলেও চাপা পড়তে সময় লাগেনি। গত চার দশকের ধারাবাহিকতা টানলে দেখা যায়, সচিবালয়ে যেকোনো চুরির ঘটনার পর বড়জোর থানায় সাধারণ ডায়েরি এবং দু-একজনকে জিজ্ঞাসাবাদ, তদন্ত কমিটি গঠন-এরকম দায়সারা তৎপরতার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিলো। অব্যাহতভাবে নথি চুরির ঘটনা ঘটে চললেও তা প্রতিরোধ বা প্রতিকারে তেমন কোনো উদ্যোগ দেখা যায়নি।
এ বিষয়ে দৈনিক আমাদের বার্তার পক্ষ থেকে বেশ কয়েকজন কর্মকর্তার মতামত জানার চেষ্টা করা হয়। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জন প্রশাসন মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা বলেন, বিষয়টি সেনসিটিভ, তদন্তাধীন তাই এখনই কোনো মন্তব্য করা যাবে না। অপর এক কর্মকর্তা বলেন, সচিবালয় থেকে কোনো কিছু চুরি যাওয়া দুঃখজনক। চুরি ঠেকাতে না পারা প্রশাসনিক অদক্ষতা। চুরি ঠেকাতে ডিজিটাল পদ্ধতি ভালো কাজ দেবে।
সচিবালয় বিটের এক সিনিয়র সাংবাদিক বলেন, আসলে বরবারই এসব চুরির ঘটনা সরকার চেপে যায়, জানাজানি হয় না। চুরির সঙ্গে জড়িতরা রাঘববোয়াল, তাই তদন্ত-জিডিতেই আটকে থাকে।
এভাবে গত ৪০ বছরে সচিবালয়ে নথি চুরির ঘটনায় সরকারি কোনো কর্মকর্তা ও কর্মচারী কারাভোগ, চাকরি হারিয়েছেন বা দৃষ্টান্তমূলক কোনো শাস্তিভোগ করেছেন এমন নজির নেই। তবে নথি চুরির অভিযোগে সাংবাদিককে লাঞ্ছিত ও আটক করার নজির আছে। এমনকি কাউকে কাউকে কারাভোগও করতে হয়েছে।
২০২১ খ্রিষ্টাব্দের মে মাসে একটি মন্ত্রণালয়ের নথি চুরির চেষ্টার অভিযোগে এক সাংবাদিককে গ্রেফতার করে কারাগারে পাঠানো হয়। পাঁচ মাসের মাথায় সেই মন্ত্রণালয়েরই ১৭টি নথি গায়েব হয়ে যায়। আর বরাবরের মতোই মন্ত্রণালয়ের তরফে নথি চুরির বিষয়টি জিডিতেই সীমাবদ্ধ থাকে। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সচিব বলেন, নথিগুলো তেমন গুরুত্বপূর্ণ নয়।
তাই সিআইডি ওই ঘটনায় কয়েকজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে মাত্র। অতীতের ধারাবাহিকতায় ওই ঘটনাও সময়ের চাকায় চাপা পড়ে যায়। আর ঘটনায় জড়িতরা আড়ালেই থেকে যান।
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, চুরির ঘটনায় যথোপযুক্ত বিচার হলে, জড়িতরা শাস্তি পেলে অবশ্যই এটা বন্ধ হতো। কিন্তু এ যাবৎ এমন কিছু না হওয়ায় ঘটনা কেবল বাড়ছেই।
শিক্ষাসহ সব খবর সবার আগে জানতে দৈনিক আমাদের বার্তার ইউটিউব চ্যানেলের সঙ্গেই থাকুন। ভিডিওগুলো মিস করতে না চাইলে এখনই দৈনিক আমাদের বার্তার ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন এবং বেল বাটন ক্লিক করুন। বেল বাটন ক্লিক করার ফলে আপনার স্মার্ট ফোন বা কম্পিউটারে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ভিডিওগুলোর নোটিফিকেশন পৌঁছে যাবে।
দৈনিক আমাদের বার্তার ইউটিউব চ্যানেল SUBSCRIBE করতে ক্লিক করুন।