উচ্চ আদালতের বিচারক নিয়োগ হবে স্বতন্ত্র কাউন্সিলের মাধ্যমে। এমন বিধান রেখে গতকাল মঙ্গলবার সুপ্রিম কোর্টের বিচারক নিয়োগ অধ্যাদেশ জারি করা হয়েছে। এ ছাড়া সুপ্রিম কোর্টের পৃথক বিচার বিভাগীয় সচিবালয় এবং স্থায়ী অ্যাটর্নি সার্ভিস চালুর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
মঙ্গলবার বিকেলে সচিবালয়ে সংবাদ সম্মেলন করে এসব সিদ্ধান্ত ও উদ্যোগের কথা জানান আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুল।
সুপ্রিম কোর্টের বিচারক নিয়োগ অধ্যাদেশ, ২০২৫–এর গেজেট জারির কথা জানিয়ে আইন উপদেষ্টা বলেন, এতে উচ্চ আদালতে বিচারক নিয়োগে একটি কাউন্সিলের বিধান করা হয়েছে। প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে আপিল বিভাগের দুজন বিচারক (একজন অবসরপ্রাপ্ত ও একজন কর্মরত), হাইকোর্টের দুজন বিচারক এবং অ্যাটর্নি জেনারেল নিয়ে ছয় সদস্যের এই কাউন্সিল গঠন করা হবে।
এই কাউন্সিলের মাধ্যমে উচ্চ আদালতের বিচারক নিয়োগের প্রক্রিয়াও তুলে ধরেন আসিফ নজরুল। তিনি বলেন, এই কাউন্সিল নিজ উদ্যোগে সম্ভাব্য প্রার্থীদের নাম সংগ্রহ করবে। একই সঙ্গে যেকোনো মানুষ, যেকোনো আইনজীবী যাতে নিজের ইচ্ছায় আবেদন বা কারও নাম প্রস্তাব করতে পারেন, সেই ব্যবস্থা আছে। এই কাউন্সিল প্রাথমিক যাচাই-বাছাই করার পর সাক্ষাৎকার নেবে। এই কাউন্সিলের নাম হবে সুপ্রিম জুডিশিয়াল অ্যাপয়েন্টমেন্ট কাউন্সিল।
হাইকোর্টে বিচারক পদে পরবর্তী নিয়োগ এই প্রক্রিয়ায় দিতে পারবেন বলে আশা প্রকাশ করেন আইন উপদেষ্টা।
অধ্যাপক আসিফ নজরুল বলেন, বিগত সরকারের আমলে যে অনাচার হতো, চরম মানবাধিকার লঙ্ঘন হতো, মানুষকে যে দমন-নিপীড়ন করা হতো, তার একটি বড় প্ল্যাটফর্ম ছিল উচ্চ আদালত। সেখানে মানুষ প্রতিকার পেত না। এর কারণ ছিল রাজনৈতিক সরকারগুলো উচ্চ আদালতে সম্পূর্ণভাবে দলীয় বিবেচনায়, অনেক ক্ষেত্রে অদক্ষ লোকদের বিচারক নিয়োগ দিত। উচ্চ আদালতের নিয়োগ নিয়ে একজন সাবেক বিচারপতি ‘প্রলয় ঘটে গেছে’, এ ধরনের মন্তব্য করেছিলেন। উচ্চ আদালতে যদি স্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় যোগ্য ও নিরপেক্ষ ব্যক্তিরা বিচারক হিসেবে নিয়োগ না পান, তাহলে দেশের ১৭ কোটি মানুষের মানবাধিকারের প্রশ্নটি অমীমাংসিত ও ঝুঁকির মধ্যে থেকে যায়। উচ্চ আদালতে স্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় অভিজ্ঞ, দক্ষ ও দলনিরপেক্ষ এবং প্রকৃত যোগ্য ব্যক্তিরা বিচারক হিসেবে নিয়োগ হবে—এমন একটি চাহিদা সমাজে বহু বছর ধরে ছিল। এখন এ বিষয়ে আইন হয়েছে। একটি স্বচ্ছ ও জবাবদিহি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে উচ্চ আদালতে বিচারকেরা নিয়োগ পাবেন বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।
আইন উপদেষ্টা বলেন, সুপ্রিম কোর্টের পৃথক বিচার বিভাগীয় সচিবালয় প্রতিষ্ঠার দাবি সমাজে দীর্ঘদিন ধরে আছে। এটি একটি জাতীয় ঐকমত্যে পরিণত হয়েছে। এটির উদ্যোগ গ্রহণ করা হচ্ছে। একটু সময় লাগছে খুঁটিনাটি পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য।
এর আগে গত মাসে সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসনের এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছিল, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিতকল্পে মাসদার হোসেন মামলার রায়ের বাস্তবায়নে পৃথক বিচার বিভাগীয় সচিবালয় প্রতিষ্ঠায় প্রয়োজনীয় আইনি ও কাঠামোগত সংস্কার আনয়নে পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন প্রধান বিচারপতি।
স্থায়ী অ্যাটর্নি সার্ভিস চালুর উদ্যোগের কথা জানান আসিফ নজরুল। তিনি বলেন, কিছু অভিযোগ আছে, সরকারি কৌঁসুলিরা যেহেতু দলীয়ভাবে নিয়োগ পান সে জন্য তাঁরা অনেক সময় নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করতে পারেন না। রাষ্ট্রের পক্ষে ভূমিকা পালন না করে ক্ষমতাসীন দলের পক্ষে ভূমিকা পালন করেন। এর সমাধান হচ্ছে স্থায়ী অ্যাটর্নি সার্ভিস প্রতিষ্ঠা করা। সেই লক্ষ্যে আইন তৈরির কাজ শুরু করা হয়েছে। এক মাসের মধ্যে এটি করতে পারবেন বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।
উপদেষ্টা আসিফ নজরুল জানান, ৩৬ ধরনের কাগজপত্র আইন মন্ত্রণালয় সত্যায়ন করে। গত ১৩ ডিসেম্বর থেকে এগুলো অনলাইনে করা হচ্ছে।
দুই সপ্তাহের মধ্যে সাইবার আইনের, ফেব্রুয়ারির মধ্যে সব গায়েবি মামলা প্রত্যাহার
আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে সাইবার নিরাপত্তা আইনে হওয়া সব মামলা আগামী দুই সপ্তাহের মধ্যে প্রত্যাহার করা হবে বলে জানিয়েছেন আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল।
গতকাল মঙ্গলবার আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয় আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ কথা বলেন।
আইন উপদেষ্টা বলেন, মামলা প্রত্যাহারের পাশাপাশি সাইবার নিরাপত্তা আইন সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তথ্য প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় এ নিয়ে কাজ করছে।
তিনি বলেন, দেশের ২৫ জেলায় আড়াই হাজার রাজনৈতিক হয়রানিমূলক বা গায়েবি মামলা চিহ্নিত করা হয়েছে। এসব মামলায় লাখ লাখ মানুষ আসামি। আগামী ৭ দিনের মধ্যে প্রায় আড়াই হাজার রাজনৈতিক হয়রানিমূলক মামলা প্রত্যাহারের উদ্যোগ নেওয়া হবে।
বিচারক নিয়োগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, উচ্চ আদালতে এর আগে রাজনৈতিক বিবেচনায় বিচারক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এখন থেকে বিচারক নিয়োগ হবে দক্ষতার ভিত্তিতে এবং দল নিরপেক্ষতার ভিত্তিতে। বিচারক নিয়োগের জন্য সুপ্রিম কোর্টের বিচারক নিয়োগ অধ্যাদেশ করা হচ্ছে।
সংবাদ সম্মেলনে সুপ্রিম কোর্টের বিচারক নিয়োগ অধ্যাদেশ, আইন মন্ত্রণালয়ের সত্যায়ন প্রক্রিয়া, শেখ হাসিনাকে ভারতের ফেরত দেওয়াসহ বিভিন্ন সমসাময়িক বিষয় নিয়ে কথা বলেন তিনি। এ সময় আরো জানান, আগামী ফেব্রুয়ারির মধ্যে সব গায়েবি মামলা প্রত্যাহার করা হবে।
এছাড়া ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ভারত ফেরত না দিলে সেটি প্রত্যর্পণ চুক্তির লঙ্ঘন হবে বলে মন্তব্য আইন উপদেষ্টা বলেন, আমরা প্রত্যর্পণের জন্য চিঠি লিখেছি। চিঠি লেখার পর ভারত যদি শেখ হাসিনাকে প্রত্যর্পণ না করে তাহলে এটি বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের যে প্রত্যর্পণ চুক্তি, সেটির সুস্পষ্ট লঙ্ঘন হবে। সে ব্যাপারে আমরা বিশ্বসমাজে কী পদক্ষেপ নেব, সেটি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে ঠিক করা হবে।
শেখ হাসিনাকে গ্রেপ্তারে এরই মধ্যে ইন্টারপোলের মাধ্যমে রেড অ্যালার্ট জারি করা হয়েছে উল্লেখ করে আইন উপদেষ্টা বলেন, ইন্টারপোলের মাধ্যমে রেড অ্যালার্ট জারি করা হয়েছে। যা যা করণীয় তা তাঁরা করে যাচ্ছেন। আরও কিছু করণীয় থাকলে ক্ষেত্রবিশেষে চিন্তা করে তা অবশ্যই করা হবে।