সরকারি দপ্তরে 'জাতির পিতার প্রতিকৃতি' সংরক্ষণ ও প্রদর্শনের বিধান বাতিল হচ্ছে। সংবিধানের তফসিলে থাকছে না শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ভাষণ। থাকছে না তার স্বাধীনতার ঘোষণা। বাদ যাচ্ছে ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের ১০ এপ্রিল মুজিবনগর সরকারের ঘোষণাপত্রও।
অধ্যাপক ড. আলী রীয়াজের নেতৃত্বাধীন সংবিধান সংস্কার কমিশনের সুপারিশের সারসংক্ষেপ পর্যালোচনা এবং কমিটি- সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলাপে এসব তথ্য জানা গেছে।
গত ৩ অক্টেবর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সংবিধান সংস্কার কমিশন গঠন করে। এই কমিশন গত ১৫ জানুয়ারি তাদের প্রতিবেদন প্রধান উপদেষ্টার হাতে হস্তান্তর করেছে। পরে তারা সুপারিশের সারসংক্ষেপ ওয়েবসাইটে প্রকাশ করেছে। আগামী ৩১ জানুয়ারি কমিশনের পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন প্রকাশ করা হবে বলে প্রধান উপদেষ্টার দপ্তর থেকে জানানো হয়েছে।
সংবিধানের বিদ্যমান বিধান অনুযায়ী, রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, স্পিকার ও প্রধান বিচারপতির কার্যালয় এবং সব সরকারি ও আধাসরকারি কার্যালয়, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান, সংবিধিবদ্ধ সরকারি প্রতিষ্ঠান, সব ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, বিদেশে অবস্থিত বাংলাদেশের দূতাবাস ও মিশনগুলোতে শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতি সংরক্ষণ ও প্রদর্শন করার বিধান রয়েছে। ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকার বিতর্কিত ও সমালোচিত পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানে নতুন অনুচ্ছেদ '৪ক জাতির পিতার প্রতিকৃতি' যুক্ত করে শেখ মুজিবের প্রতিকৃতি (ছবি) সব প্রতিষ্ঠানে প্রদর্শন বাধ্যতামূলক করেছিল। সংবিধান সংস্কার কমিশন তাদের সুপারিশের প্রকাশ করা অংশে এ অনুচ্ছেদের বিষয়ে কিছু উল্লেখ না করলেও জানা গেছে, তাদের চূড়ান্ত সুপারিশে বিদ্যমান সংবিধানের এ বিধানটি বাদ পড়ছে।
এ বিষয়ে সংস্কার কমিশনের প্রধান অধ্যাপক ড. আলী রীয়াজ বলেন, আমাদের সুপারিশের সারসংক্ষেপে বিষয়টি স্পষ্ট করা হয়েছে কি না, এ মুহূর্তে বলতে পারছি না। তবে আমাদের সিদ্ধান্ত হলো এ বিধানটি সংবিধান থেকে বাদ দেওয়া। এ ধরনের কোনো বিধান সংবিধানে রাখার দরকার আছে বলে আমরা মনে করি না। কেউ চাইলে আইন করে এ ধরনের (রাষ্ট্রপতি বা অন্য কারো ছবি টাঙানো) বিধান করতে পারে।
সংবিধান সংস্কার কমিশন তার সুপারিশে শেখ হাসিনার আমলে অসংশোধনযোগ্য হিসেবে প্রণীত সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১৫০(২) বিলুপ্তি এবং এ-সংশ্লিষ্ট পঞ্চম, ষষ্ঠ ও সপ্তম তফসিল সংবিধান থেকে ছাঁটাই করার কথা বলেছে।
সংবিধানের ক্রান্তিকালীন ও অস্থায়ী বিধানাবলি অংশের এই অনুচ্ছেদ ১৫০ (১), (২) ও সংশ্লিষ্ট তফসিল ২০১১ খ্রিষ্টাব্দে আওয়ামী লীগ সরকার সংবিধানে সন্নিবেশ করেছিল এবং বিধানটি 'সংশোধন করা যাবে না' বলে সংবিধানের ৭খ অনুচ্ছেদে উল্লেখ করা হয়েছে।
উল্লেখ্য, ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনার আমলে যুক্ত করা এক ধারায় শক্তি প্রদর্শন বা শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে বা অন্য কোনো অসাংবিধানিক' পন্থায় সংবিধান বা এর কোনো রদ, রহিত বা বাতিল বা স্থগিত করলে বা করার উদ্যোগ/ ষড়যন্ত্র করলে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অপরাধে দোষী হবে এবং দেশের প্রচলিত আইনে সর্বোচ্চ দণ্ডে দণ্ডিত হবে। ৭খ অনুচ্ছেদে সংবিধানের প্রস্তাবনা, প্রথম ও দ্বিতীয় ভাগের সব অনুচ্ছেদ, নবম 'ক' ভাগে বর্ণিত অনুচ্ছেদগুলোর বিধানাবলিসাপেক্ষে তৃতীয় ভাগের সব অনুচ্ছেদ ও একাদশ ভাগের ১৫০ অনুচ্ছেদসহ সংবিধানের অন্যান্য মৌলিক কাঠামো-সংক্রান্ত অনুচ্ছেদগুলোর বিধানাবলি সংযোজন, পরিবর্তন, প্রতিস্থাপন, রহিতকরণ কিংবা অন্য কোনো পন্থায় সংশোধন করা যাবে না বলে বিধান করা হয়েছে।
সংবিধান সংস্কার কমিশন তার সুপারিশের সারসংক্ষেপে জরুরি অবস্থার বিধানাবলি সম্পর্কিত অনুচ্ছেদ ১৪১খ ও অনুচ্ছেদ ১৪১গ বাতিলের সুপারিশ করছে। পরিবর্তে কমিশন 'কেবল এনসিসির (জাতীয় সংবিধান কাউন্সিল) সিদ্ধান্তে রাষ্ট্রপতি জরুরি অবস্থা ঘোষণা করতে পারবেন' বলে সুপারিশ করেছে। কমিশন মনে করে, জরুরি অবস্থার সময় নাগরিকদের কোনো অধিকার রদ বা স্থগিত করা যাবে না এবং আদালতে যাওয়ার অধিকার বন্ধ বা স্থগিত করা যাবে না।
সংবিধানের বিদ্যমান বিধান অনুযায়ী, আন্তর্জাতিক চুক্তির ক্ষেত্রে চুক্তি স্বাক্ষর হওয়ার পর তা রাষ্ট্রপতির কাছে পেশ করতে হবে। এবং রাষ্ট্রপতি সেটা সংসদে পেশ করার ব্যবস্থা করবেন। এ ক্ষেত্রে জাতীয় নিরাপত্তা-সংশ্লিষ্ট কোনো চুক্তি হলে তা সংসদের গোপন বৈঠকে পেশ করা হবে বলে বিধান রয়েছে। সংস্কার কমিশন এই বিধান বিলুপ্ত করে 'জাতীয় স্বার্থ বা রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা প্রভাবিত করে- এমন কোনো আন্তর্জাতিক চুক্তি সম্পাদনের পূর্বে আইনসভার উভয় কক্ষের সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে অনুমোদন নিতে হবে বলে সুপারিশ করেছে।
সংবিধান সংস্কার কমিশন সংবিধানের বিদ্যমান সাংবিধান প্রতিষ্ঠানগুলোতে কিছু, সংশোধনীর সুপারিশ করেছে। এ ক্ষেত্রে নতুন। একটি ভাগ তৈরি করে পাঁচটি সাংবিধানিক কমিশন (সিআরসি) গঠনের কথা বলেছে।