
বিমা খাতে কোনো ধরনের দুর্নীতি সহ্য করা হবে না। নিজে দুর্নীতি করব না, অন্যকেও দুর্নীতি করতে দেব না বলে অঙ্গীকার জানিয়েছেন বাংলাদেশ ইন্স্যুরেন্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিআইএ) সভাপতি সাঈদ আহমেদ।
তিনি বলেন, বিমা আহরণের ক্ষেত্রে দেশের বিমা কোম্পানিগুলোর মধ্যে একটা অসম প্রতিযোগিতা চলছে। এটাকে আমরা বন্ধের জন্য নীতি-নির্ধারকদের সঙ্গে কথা বলব। এই অসম প্রতিযোগিতা দেশের বিমা খাতকে আরও সমস্যায় ফেলবে।
মঙ্গলবার (১১ মার্চ) রাজধানীর পল্টনস্থ ক্যাপিটাল মার্কেট জার্নালিস্টস ফোরাম (সিএমজেএফ) আয়োজিত সিএমজেএফ টক-এ এই অঙ্গীকার করেন তিনি। সিএমজেএফ সভাপতি গোলাম সামদানি ভূইয়ার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক আবু আলী।
সাঈদ আহমদ বলেন, দেশের অর্থনীতি দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। কিন্তু আমাদের দেশের বিমা খাত বৃদ্ধি পাচ্ছে না। দেশের অর্থনীতির আকারের তুলনায় ৮০টি বিমা কোম্পানির সংখ্যা আমার মতে কম। অনেক চ্যালেঞ্জের মুখে। নিয়ন্ত্রক সংস্থার আরও সমন্বয় করা প্রয়োজন।
তিনি বলেন, বাংলাদেশে বিমা খাতের এক অসাধারণ পরিবর্তনের সাক্ষী আমরা। ১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দে জাতীয়করণ, ১৯৭৩ খ্রিষ্টাব্দে বিমা করপোরেশন আইন অনুযায়ী পুনর্গঠন, ১৯৮৪ খ্রিষ্টাব্দে বেসরকারি ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিগুলোকে অন্তর্ভুক্তিকরণ। প্রতিটি ধাপ এই খাতকে বর্তমান অবস্থানে পৌঁছে দিয়েছে। আমাদের দেশে ৮০টি বিমা কোম্পানি রয়েছে। ৩৫টি জীবন বিমা এবং ৪৫টি সাধারণ বিমা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। যারা সম্মিলিতভাবে প্রায় ১ দশমিক ৮৯ কোটি ব্যক্তিকে বিমার আওতায় এসেছে। কিন্তু এত অগ্রগতির পরেও বাংলাদেশে ইন্সুরেন্স’র অবদান জিডিপির দশমিক ৫ শতাংশ। তিনি বলেন, যা আন্তর্জাতিক মানের তুলনায় অনেক কম। যেখানে প্রতিবেশী দেশ ভারতে ৪ শতাংশ, শ্রীলঙ্কায় ১ দশমিক ২ শতাংশ, পাকিস্তানে দশমিক ৮ শতাংশ।
বিআইএ সভাপতি বলেন, আমাদের বিমা খাতে বর্তমানে বিভিন্ন চ্যালেঞ্জের মুখে। যেমন কোভিড-১৯ পরবর্তী পরিস্থিতি, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, গাজা-ইসরায়েল যুদ্ধ, ডলারের অস্বাভাবিক মূল্য বৃদ্ধি, মুদ্রাষ্ফীতি বিশ্বব্যাপী, দেশের অর্থনীতির অস্থিরতা, বৈদেশিক মুদ্রার নেতিবাচক রিজার্ভ ইত্যাদির কারণে বিমা খাতের কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন সম্ভব হয়নি।
বিমা খাতের তথ্য তুলে ধরে তিনি বলেন, বিভিন্ন প্রতিকূল অবস্থার মধ্য থেকেও বাংলাদেশের বিমা কোম্পানিগুলো জীবন বিমা খাতে প্রাইভেট বিমা কোম্পানিগুলির উপার্জিত প্রিমিয়াম আয়ের পরিমাণ ছিল ২০২৩ খ্রিষ্টাব্দে ১১ হাজার ৪৮৩ কোটি ৫০ লাখ টাকা। বেসরকারি জীবন বিমা খাতের লাইফ ফান্ড ২০২৩ খ্রিষ্টাব্দে ৩২ হাজার ১৫৩ কোটি টাকা। বেসরকারি জীবন বিমা খাতে ২০২৩ খ্রিষ্টাব্দের বিনিয়োগ ৩৬ হাজার ৮৫৩ কোটি টাকা। বেসরকারি খাতে জীবন বিমা কোম্পানির মোট সম্পদ ২০২৩ খ্রিষ্টাব্দে ৪৪ হাজার ২২০ কোটি ৩০ লাখ টাকা। নন-লাইফ বিমা খাতে মোট প্রিমিয়াম আয়ের পরিমাণ ২০২৩ খ্রিষ্টাব্দে ছিল চার হাজার ২৩৫ কোটি ১০ লাখ টাকা। নন-লাইফ বিমা কোম্পানির ২০২৩ খ্রিষ্টাব্দে সম্পদের পরিমাণ ১১ হাজার ৬৪৭ কোটি ৪০ লাখ টাকা। নন-লাইফ বিমা খাতে ২০২৩ খ্রিষ্টাব্দের বিনিয়োগ ৫ হাজার ৭৭২ কোটি টাকা।
এই খাতের চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা তুলে ধরে সাঈদ আহমদ বলেন, বাংলাদেশের অর্থনীতি দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। শিল্পায়ন, মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি এবং গড় আয়ু বৃদ্ধির পরেও আমাদের ইন্স্যুরেন্স শিল্প এখনো তার পূর্ণ সম্ভাবনা অর্জন করতে পারেনি। বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ আমাদের সামনে রয়েছে। এর মধ্যে বিমা সচেতনতা ও সাধারণ মানুষ এবং ব্যবসায়ীরা এখনো বিমার গুরুত্ব ও ঝুঁকি ব্যবস্থাপনায় এর ভূমিকা পুরোপুরি বোঝে না। নিয়ন্ত্রক সংস্থা কর্তৃক নীতিমালার সংস্কার চলমান থাকলেও, কার্যকারিতা ও বিশ্বাসযোগ্যতা বাড়াতে আরও সমন্বয় প্রয়োজন। ডিজিটাল প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়িয়ে, গ্রাহকদের আরও সহজে বিমার আওতায় আনা প্রয়োজন। বিশ্বাসের অভাব ও দ্রুততম সময়ে দাবি নিষ্পত্তি, স্বচ্ছতা এবং উন্নত সেবার মাধ্যমে গ্রাহকদের আস্থা অর্জন করতে হবে।
বর্তমান বিমা খাতের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় করণীয় তুলে ধরে তিনি বলেন, বিমার প্রতি জনগণের আস্থা বৃদ্ধি, সময়মত সকল প্রকার দাবি পরিশোধ, এনজিও কর্তৃক বিমা করার অধিকার রহিতকরণ, ব্যাংকের ঋণগ্রহীতাদের জীবনবিমা পলিসি গ্রহণ বাধ্যতামূলক করার প্রস্তাব, বিমা শিল্পের জন্য প্রয়োজনীয় বিধি-বিধান প্রণয়ন, ভ্যাট/ট্যাক্সসংক্রান্ত সমস্যাবলীর সমাধান, মোটর ইন্স্যুরেন্স বাধ্যতামূলককরণ, বেসরকারি খাতে পুনঃবিমা কোম্পানি গঠন, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সাথে ভ্যাট, দ্বৈতকর ও করহার হ্রাসকরণের বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ, বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি স্থাবর ও অস্থাবর সম্পতির বিমা করা বাধ্যতামূলক করণ। তবে, প্রতিটি চ্যালেঞ্জের মধ্যেই সম্ভাবনা থাকে। নতুন উদ্ভাবন, নীতিমালা সংস্কার এবং কৌশলগত অংশীদারত্ব কাজে লাগিয়ে আমরা বাংলাদেশের ইন্স্যুরেন্স শিল্পের প্রকৃত সম্ভাবনাকে বাস্তবায়ন করতে পারব।
এক প্রশ্নের জবাবে সাঈদ আহমদ বলেন, বিমা কোম্পানি সেবামূলক কাজ করছে। সেখানে তারা সেবার নামে কেন টাকা নেবে, এটা হতে দিতে পারি না। সেবার নামে বাণিজ্য করবেন তা হতে দেব না।
অপর প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, জনগণের টাকা তছরুপ করবে ছিনিমিনি খেলবে বিআইএ তা হতে দেবে না। আমরা তা মানব না। আমরা এটা নিয়ে কাজ করব। কয়েকটি সংস্থার জন্য পুরো খাত প্রশ্নের মুখে পড়বে এটা হতে দেব না।
তিনি বলেন, এই খাতের উন্নয়নে সরকারের ভূমিকা বেশি। কারণ এই খাতের উন্নয়নে পলিসি করার দায়িত্ব সরকারের। সরকার যদি বাধ্যতামূলক করে দেয় তাহলে খাতটির বিকাশ ঘটবে এবং জিডিপিতে অবদান বাড়বে।