
নদী না থাকলে বাংলাদেশ থাকবে না বলে মন্তব্য করেছেন অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ।
তিনি বলেন, নদীর বিপদ মানে বাংলাদেশের বিপদ। নদীর বিপন্নতার তিনটি মূল কারণের প্রথমটি হলো উজানের দেশ ভারত। তাদের সিদ্ধান্তের কারণে বাংলাদেশের নদীগুলো মরে যাচ্ছে। জাতিসংঘের পানি কনভেশনে বাংলাদেশ অনুস্বাক্ষর করেনি এই ভারতকে খুশি রাখতে।
বৃহস্পতিবার (১৩ মার্চ) সকাল ১১টায় রাজধানীর জাতীয় প্রেসক্লাবের তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া হলে ‘বাংলাদেশের নদ-নদীর বর্তমান ও ভবিষ্যত’ শীর্ষক এক আলোচনা সভায় প্রধান অতিথির ব্ক্তব্যে তিনি এ সব কথা বলেন বলে এক বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ১৪ মার্চ (শুক্রবার) ‘আন্তর্জাতিক নদীকৃত্য দিবস’-২০২৫ পালন উপলক্ষে ধরিত্রী রক্ষায় আমরা (ধরা)’র উদ্যোগে এ আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়।
আনু মুহাম্মদ বলেন, নদী না থাকলে বাংলাদেশ থাকবে না এর দ্বিতীয় কারণ হলো- সরকার নিজেই। সরকারের প্রতিষ্ঠান এবং উন্নয়ন প্রকল্পগুলো নদীর বিনাশ করছে আর তৃতীয় কারণ হলো- ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান ও সমাজের প্রভাবশালী গোষ্ঠী।
নদী বাঁচাতে তিনি জাতীয় ঐক্যমতের আহ্বান জানিয়ে বলেন, এই নদীকৃত্য দিবসেই সরকারকে জাতিসংঘের ১৯৯৭-এর পানি কনভেনশনে অনুস্বাক্ষর করতে হবে।
সরকারের নদীবিনাশী সব সিদ্ধান্ত ও প্রকল্পগুলো বাতিল করে নদী কমিশন প্রণীত সুপারিশ অনুযায়ী দখল উচ্ছেদ করতে হবে এবং নদী রক্ষায় ডেল্টা প্ল্যান ২১০০ পুনর্বিশ্লেষণ করে নতুন করে প্রণয়ন করতে হবে।
ধরা’র সহআহ্বায়ক এম এস সিদ্দিকী-এর সভাপতিত্বে এবং ধরা’র সদস্য সচিব শরীফ জামিলের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠিত আলোচনা সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ ছাড়াও মূল বক্তব্য উপস্থাপন করেন- জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের (এনআরসিসি) সাবেক চেয়ারম্যান, ভূমি মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব ও ধরা’র উপদেষ্টা ড. মুজিবুর রহমান হাওলাদার।
সভায় আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন- বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্স-এর সভাপতি ড. আদিল মোহাম্মদ খান; ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক ড. মোশাহিদা সুলতানা; পশুর রিভার ওয়াটারকিপার মো. নূর আলম শেখ ও খোয়াই রিভার ওয়াটারকিপার তোফাজ্জল সোহেল।
এ ছাড়াও সভায় উপস্থিত নদীপাড়ের বিভিন্ন জনগোষ্ঠী ও সামাজিক সংগঠনের প্রতিনিধির মধ্যে বক্তব্য দেন- বুড়িগঙ্গা নদীমোর্চার সদস্য জাহাঙ্গীর আদেল, মো. সেলিম, মানিক বেপারি, ইশরাত জাহান লতা, বালু নদীমোর্চার জান্নাতী আক্তার রুমা, তুরাগ নদীমোর্চার আমজাদ আলী লাল, নদীকর্মী ইসমাইল গাজী, সাংবাদিক অনির্বান শাহরিয়ার প্রমুখ।
মূল বক্তব্যে ড. মুজিবুর রহমান হাওলাদার বলেন, সরকারে কে রয়েছেন, সেটার চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হলো- সরকার পাবলিক প্রপার্টি রক্ষা করতে পারছেন কি-না। নদী হলো, পাবলিক প্রপার্টি আর সেই নদীকে রক্ষা করা মানুষের দাবি।
তিনি বলেন, নদী ধ্বংস করা ফৌজদারি অপরাধ। জুলাই বিপ্লব পরবর্তী সময়ে এখনো অপ্রতিরোধ্য গতিতে নদী দখল চলছে। নদীর কোনো দল নেই! কোন ধর্ম নেই। নদী সবার জন্য।
এই নদী, পানি, পরিবেশ রক্ষা করতে হবে। নদী রক্ষা করা প্রত্যেক নাগরিকের দায়িত্ব। নদী একটি জীবন্ত সত্তা। একে গলা টিপে হত্যা করা যাবে না। নদীর জমি কখনো খাস হয় না। নদীর জমি নদীকে ফিরিয়ে দিতে হবে।
আগামী এক মাসের মধ্যে দখলদারদের তালিকা প্রকাশ করতে হবে। নদীভিত্তিক গবেষণা হতে হবে এবং নদী বাঁচাতে উচ্চ আদালতের নির্দেশনা মানতে হবে।
সভাপতির আলোচনায় এমএস সিদ্দিকী বলেন, নদী দখলের প্রক্রিয়া কী! নদীর রক্ষক সরকার। এটি লিজ দেন জেলা প্রশাসক। নদীর পাড়ে শিল্প-কারখানা তৈরি হয়। তার জন্য জেটি তৈরি করা হয়। জেটি তৈরি জন্য নদীর জমি লিজ দেওয়া হয়। এখানেই শুভঙ্করের ফাঁকি। আমাদের গোড়ার গলদ ঠিক করতে হবে নদীকে বাঁচাতে হলে।
ধরা’র সদস্য সচিব শরীফ জামিল বলেন, আমাদের দেশ, নদীমাতৃক দেশ। বাংলাদেশের নদীগুলো জালের মতো ছড়িয়ে আছে দেশব্যাপী। আমাদের সবকিছু নদীর স্বাস্থ্যের ওপর নির্ভরশীল।
ভারত একতরফাভাবে উজানের নদীগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করছে। নদীগুলোকে প্লাবন এলাকার দিকে যেতে দিতে হবে। উচ্ছেদ পরে করুন। আগে নদী দখল বন্ধ করুন দয়া করে। নদীকে বাঁচতে দিন। দেশের কোনো নদী ভালো নেই।
বিভাগ, জেলা, উপজেলা নদী রক্ষা কমিটিগুলোকে জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে। নদীর সীমানা চিহ্নিত করার সময় নদীর জায়গা পরিবর্তিত হলে পরিবর্তিত জায়গাগুলোকে নদীর সীমানার আওতায় আনতে হবে। দখল কীভাবে উচ্ছেদ হবে, তা আইনে বলা আছে। আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী, শক্তিশালী ও কার্যকর নদী কমিশন ও নদী কমিশন আইন প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করুন।
বিআইপি’র সভাপতি ড. আদিল মোহাম্মদ খান বলেন, সম্প্রতি যৌথ নদী কমিটির মিটিং হয়েছে ভারতে। সেখানে বাংলাদেশের প্রতিনিধিরা অংশগ্রহণ করেছেন।
উজান থেকে প্রয়োজনীয় পানি না এসে আসছে দূষণ। যৌথ নদীর পানির পূর্ণ হিস্যার জন্য কমিশনকে আরো সক্রিয় হতে হবে।
৬৬ হাজার দখলদারকে উচ্ছেদের কাজ হঠাৎ কেন বন্ধ হয়ে গেল! অনেক রাজনীতিক এবং ক্ষমতাবানেরা নদী দখলের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। রাষ্ট্রীয় আবরণে তারা নদীকে ধর্ষণ করেছে। জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পরও অবস্থার বদল হয়নি। দূষণকারীরা জীবন্ত সত্তাকে হত্যার সঙ্গে জড়িত। একমাত্র গণমানুষের বন্দোবস্তই পরিবর্তন আনতে পারে। নদী রক্ষা করতে আমাদের একত্রিত হতে হবে।
ড. মোশাহিদা সুলতানা বলেন, সরকার যেখানে ব্যর্থ হয়, সেখানে নিয়ন্ত্রণ বাজারের হাতে ছেড়ে দেয়। আমাদের নদীগুলো বাজারি প্রক্রিয়ায় পণ্যে পরিণত হয়েছে। নদী সম্পৃক্ত যেকোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণে স্থানীয় গণমানুষের সম্পৃক্ততা থাকতে হবে। দূষণের প্রক্রিয়ায় একই রকমভাবে শুধুমাত্র মুনাফার জন্য সুবিধা দিয়ে নদীর পাড়ে গড়ে উঠেছে শিল্পকারখানা।
মো. নূর আলম শেখ বলেন, জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের এক হাজার আটটি নদীর হিসাব পূর্ণাঙ্গ নয়। শুধু সুন্দরবনের ভেতরেই প্রায় চারশ খাল-নদী রয়েছে। সুন্দরবনে নদী-খালে বিষ দিয়ে মাছ ধরা হচ্ছে আর সেই সঙ্গে হত্যা করা হচ্ছে জলজপ্রাণীগুলোকেও।
তিনি বলেন, রামপাল তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র ক্ষতিগ্রস্ত করছে পশুর নদী আর সুন্দরবনকেও। সেখানকার কৃষক ও জেলেরা জেলা প্রশাসক বরাবর স্মারকলিপি দিয়েছেন রামপাল তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধের দাবিতে।
আমি তাদের পক্ষ থেকে পশুর নদী ও সুন্দরবন রক্ষায় রামপাল তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধের দাবি জানাই।
তোফাজ্জল সোহেল বলেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে নদীর ভূমিকা ছিল সবচেয়ে বেশি কিন্তু আজ আমাদের নদীর কোনো স্বাধীনতা নেই। হাওর এলাকার শিল্পের সব বর্জ্য নদীর পানিতে এসে পড়ছে।
পানি আর পানি নেই; হয়েছে ময়লার স্তর। নদী আর নদী নেই। কোনোটা মরে গেছে গেছে আর কোনোটা কোনোমতে বেঁচে রয়েছে মৃতপ্রায় খাল হয়ে।
এসময় আরো উপস্থিত ছিলেন উপকূল রক্ষায় আমরা’র সমন্বয়ক নিখিল চন্দ্র ভদ্র, রিভার বাংলা সম্পাদক ফয়সাল আহমেদ প্রমুখ।
এ ছাড়াও আন্তর্জাতিক নদীকৃত্য দিবস-২০২৫ পালন উপলক্ষে বৃহস্পতিবার ‘ধরা’, ‘আমরা কলাপড়াবাসী’ এবং ‘পরিবেশ বাঁচাও’ আন্দোলনের যৌথ উদ্যোগে আন্ধারমানিকসহ সব নদীর দখল-দূষণ বন্ধ এবং নদীর সীমানা নির্ধারণের দাবিতে পটুয়াখলীর কলাপাড়ায় মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হয়।
শুক্রবার (১৪ মার্চ) ও শনিবার (১৫ মার্চ) দেশের নানা জায়গায় ‘ধরা’র বিভিন্ন শাখার উদ্যোগে নদীকৃত্য দিবস পালিত হবে।