
আলোচিত বিচারপতি নাইমা হায়দারের বিরুদ্ধে দলীয় আনুগত্য, ঘুষ, দুর্নীতি, অনৈতিকতা ও ফরমায়েশি রায়ের অভিযোগের তদন্ত করছে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল। সরকারি সম্পত্তি হাতবদল থেকে শুরু করে তার বিদেশে সম্পদ গড়া নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। আইনজীবীদের দাবি, এসব অভিযোগে দ্রুত তদন্ত করে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি।
বিচারপতি নাইমা হায়দার ১৯৯১ খ্রিষ্টাব্দে আওয়ামী লীগ দলীয় প্রেসিডেন্টপ্রার্থী বিচারপতি বদরুল হায়দার চৌধুরীর মেয়ে। জুলাই-আগস্ট বিপ্লবে ফ্যাসিস্ট হাসিনার পতন-পরবর্তী যে কয়জন বিচারপতিকে বিচারকার্য থেকে বিরত রাখা হয়েছে, তার মধ্যে অন্যতম তিনি। তার বিতর্কিত কর্মকাণ্ড সংবাদমাধ্যমে উঠে এসেছে।
উল্লেখ্য, নাইমা হায়দার ২০০৯ খ্রিষ্টাব্দের ৩০ জুন হাইকোর্ট বিভাগের অতিরিক্ত বিচারক হিসেবে নিয়োগ পান এবং ২০১১ খ্রিষ্টাব্দের ৩০ জুন একই বিভাগের নিয়মিত বিচারক হন।
আওয়ামী কোটায় বিচারপতি
আওয়ামী লীগের অত্যন্ত বিশ্বস্ত হিসেবে পরিচিত ছিলেন নাইমা হায়দারের বাবা বদরুল হায়দার চৌধুরী। প্রধান বিচারপতি হিসেবে অবসরের পর তাকে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রেসিডেন্টপ্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন দেওয়া হয়। আওয়ামী কোটায় নাইমা হায়দারের বিচারপতি নিয়োগ পাওয়ার এটিই ছিল প্রধান কারণ।
নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থানে এরশাদের পতনের পর ১৯৯১ খ্রিষ্টাব্দের ৮ অক্টোবর বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। সংসদীয় ব্যবস্থায় ফেরার পর এটিই ছিল প্রথম নির্বাচন।
বিএনপি আবদুর রহমান বিশ্বাসকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে মনোনীত করেছিলো; আর বিচারপতি বদরুল হায়দার চৌধুরীকে মনোনীত করেছিলো আওয়ামী লীগ। ওই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী নাইমা হায়দারের বাবা বিচারপতি বদরুল হায়দার চৌধুরী বিএনপির প্রার্থী আব্দুর রহমান বিশ্বাসের কাছে বিপুল ভোটে পরাজিত হন। এটি ছিলো বাংলাদেশের সর্বশেষ প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক রাষ্ট্রপতি নির্বাচন।
ফরমায়েশি রায় দেওয়ার অভিযোগ
দলীয় কোটায় বিচারপতি নিয়োগ পেয়ে দলের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাতে ভুলে যাননি নাইমা হায়দার। জুলাই অভ্যুত্থানের কয়েক মাস আগেও ২৯ এপ্রিল তার বেঞ্চ শেখ মুজিবকে হত্যার পর বিদ্রোহীদের চিহ্নিত করে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দিতে আদেশ দেন। সারাদেশের যোদ্ধাদের তালিকা করে ৪ আগস্টের মধ্যে আদালতে দাখিল করতে আদেশ দেন তিনি। নাইমা হায়দার আওয়ামী লীগের কতটা দলীয় আনুগত্যের বিচারপতি ছিলেন তা উপলব্ধি করা যায় সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হক ও শেখ হাসিনার বেসরকারি বিনিয়োগবিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের ফাঁস হওয়া এক টেলিফোন সংলাপে। সেখানে সালমান এফ রহমান আশঙ্কা প্রকাশ করে আইনমন্ত্রী আনিসুল হককে বলেন, বিচারপতি নাইমা হায়দার ছুটিতে থাকায় তার একটি গুরুত্বপূর্ণ মামলা অন্য কোর্টে গেলে নিজের ইচ্ছেমতো রায় না-ও পেতে পারেন।
হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতিদের মধ্যে আওয়ামী লীগের ফরমায়েশি রায়ের জন্য কুখ্যাত ছিলেন নাইমা। প্রখ্যাত আলেমে দ্বীন আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের মামলার সাক্ষী সুখরঞ্জন বালীকে আদালত চত্বর থেকে অপহরণের সন্ধান চেয়ে করা ‘হেবিয়াস কর্পাস’ আবেদন এড়িয়ে যায় তার বেঞ্চ। সুখরঞ্জন বালীকে ভারতের যোগসাজশে গুম করা হয় বলে পরে খবর বেরিয়ে আসে।
সুখরঞ্জন বালী ২০১২ খ্রিষ্টাব্দের ৫ ডিসেম্বর ট্রাইব্যুনালের গেট থেকে গুম হলেও নাইমা হায়দারের বেঞ্চে কোনো আদেশ পাননি সাঈদির আইনজীবীরা। সে সময় ন্যায়বিচারের পক্ষে আদেশ না দিয়ে প্রকৃতপক্ষে সুখরঞ্জনের গুমের পক্ষেই অবস্থান নিয়েছিলেন নাইমা। এ ছাড়া গুরুত্বপূর্ণ আরো অনেক রাজনীতি-সংশ্লিষ্ট মামলায় শেখ হাসিনাকে খুশি রাখতে ফরমায়েশি রায় দিতে তৎপর ছিলেন তিনি। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো বয়স শেষ হওয়ার পরও মাহবুবে আলমের তৎকালীন অ্যাটর্নি জেনারেল পদে থাকার বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে করা রিট সরাসরি খারিজ করে দেওয়া।
ব্যাপক দুর্নীতির অভিযোগ
আওয়ামী দলীয় কোটায় নিয়োগ পাওয়ার পর বিচারপতি নাইমা হায়দার ধরাকে সরাজ্ঞান করতেন। তার কোর্টটি ছিল চিহ্নিত আইনজীবী সিন্ডিকেট, মুখচেনা দলীয় লোকদের যে কোনো মামলায় সুবিধা নেওয়ার জায়গা। একই বিষয়ে দুই রকম রায় দেওয়ারও অভিযোগ রয়েছে। নাইমার সিন্ডিকেটের মাধ্যমে মামলা উপস্থাপন করা হলে পছন্দমতো রায় পাওয়া যেতো। তার দুর্নীতি ছিলো ‘ওপেন সিক্রেট’। সবাই জানলেও পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের খাস লোক হওয়ায় কেউই তার বিরুদ্ধে ‘টুঁ’ শব্দটিও করার সাহস পেতো না।
তার দুর্নীতির বিষয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে হাইকোর্টের প্রতিবাদী আইনজীবী ব্যারিস্টার আশরাফুল ইসলাম সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বক্তব্য দিলে তাকে আদালত অবমাননায় দোষী সাব্যস্ত করে আজীবনের জন্য আইন পেশায় নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়। নাইমার সিন্ডিকেট সদস্যদের সঙ্গে সমঝোতায় রাজি না হওয়ায় আইন পেশায় ফিরতে তাকে মুচলেকা দিতে বাধ্য করা হয়।
অভিযোগ রয়েছে, যোগসাজশে ব্যাপক ঘুষ লেনদেনের মাধ্যমে বিভিন্ন সরকারি সেটেলমেন্ট সম্পত্তির মামলায় সরকারপক্ষকে সময় না দিয়ে দ্রুত রায় দিতেন। এতে সরকারের কোটি কোটি টাকার সম্পত্তি বেহাত হয়। নাইমা হায়দারের এসব অপরিণামদর্শী কাজে অবাক হয়ে পরে তার কিছু কিছু রায়ে বিস্ময় প্রকাশ করে আপিল বিভাগ। পানির দামে তিনি ঢাকার সেগুনবাগিচা, মোহাম্মদপুর, মিরপুর, গুলশানে কয়েকশ’ কোটি টাকার সরকারি সম্পত্তি কতিপয় ব্যক্তির হাতে তুলে দেন।
২০২৩ খ্রিষ্টাব্দের হাইকোর্টের ১৫৯৮৮ নম্বর রিট পিটিশনে দেখা যায়, নাইমা হায়দারের রায়ে সরকারি সম্পত্তিগুলো কুমিল্লার আইন উদ্দিন অ্যান্ড ফাইজুন্নেসা ওয়াক্ফ স্টেটকে দিতে বলা হয়। এতে তার সিন্ডিকেট সদস্যকে মোতাওয়াল্লি বানানো হয় এবং পরবর্তী সময়ে এগুলো কোটি কোটি টাকায় বিক্রি করে তারা ভাগাভাগি করেন।
এভাবে ঢাকার মোহাম্মদপুরের হুমায়ুন রোড এবং তোপখানা রোডের সেগুনবাগিচায় কোটি কোটি টাকা মূল্যের সরকারি সম্পত্তি একই কায়দায় বেহাত হয়। এ ছাড়া তার স্টাফদের বিরুদ্ধে মামলা তালিকাভুক্ত করে, ফাইল আটকে এবং অর্থের বিনিময়ে ফাইল ছেড়ে প্রচুর অবৈধ টাকা উপার্জনের অভিযোগও আছে।
রায় লিখে দিতো সিন্ডিকেট।
নাইমা হায়দার সম্পর্কে চাঞ্চল্যকর আরেকটি অভিযোগ হলো তিনি নিজে কোনো রায় লিখতেন না। তার মামলার রায়গুলো সিন্ডিকেট সদস্যরাই লিখে দিতেন। তিনি শুধু স্বাক্ষর করতেন। অভিযোগ রয়েছে, তিনি কখনোই পূর্ণ সময় আদালতে বসতেন না। সিন্ডিকেট আইনজীবীরা অধিকাংশ সময় তার খাসকামরায় আড্ডা এবং খানাপিনা করতেন, যা বিচারপতি আচরণবিধির চরম লঙ্ঘন। তার কোর্টে নিয়মিত মামলা পরিচালনা করা অনেকেই বিষয়টি জানতেন। এ নিয়ে বিভিন্ন সময় সমালোচনা হলেও আওয়ামী লীগের স্বার্থ-সংশ্লিষ্টদের সুবিধা হওয়ায় কেউ মুখ খুলতেন না। ব্যাপক তদন্ত করলে এমন ঘটনা আরো বেরিয়ে আসবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
কানাডায় বাড়ি-গাড়ি
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, নাইমা হায়দারের অবৈধ আয়ের বেশিরভাগই তিনি পাচার করে কানাডায় বাড়ি-গাড়ি করেছেন। কানাডার বেগমপাড়াসহ বিভিন্ন জায়গায় তার বেশ কয়েকটি বাড়ি রয়েছে। ছুটিতে থাকার সময় তিনি কানাডায় পাড়ি জমান।
যা বলছেন বিশেষজ্ঞরা
সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি ব্যারিস্টার এএম মাহবুব উদ্দিন খোকন বলেন, যেসব বিচারপতি বিতর্কিত, যারা শপথ লঙ্ঘন করে বিচারকাজ পরিচালনা করেছেন এবং যারা দলীয় মানসিকতা নিয়ে বিচারকের দায়িত্ব পালন করেছেন, তাদের অনতিবিলম্বে অপসারণ করতে হবে। সরকারের কাছে আহ্বান জানাই, অনতিবিলম্বে বিতর্কিত বিচারপতি যারা দলীয় দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে বিচারকার্য পরিচালনা করেছেন, শপথ ভঙ্গ করেছেন, তাদের পদত্যাগ করতে হবে অথবা সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের মাধ্যমে তদন্ত করে তাদের অপসারণের ব্যবস্থা করতে হবে।
বিচারকদের উদ্দেশে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি বলেন, ‘আপনার রাজনৈতিক চিন্তা, বিশ্বাস ও মানসিকতা থাকতে পারে। কিন্তু যে মুহূর্তে বিচারকের আসনের শপথ নেবেন, সে মুহূর্ত থেকে বিচারকের দায়িত্ব পালন করবেন। আপনি দায়িত্বশীল হবেন। কারণ আপনি তো সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি।’
তিনি আরো বলেন, বিগত ১৫-১৬ বছর আওয়ামী লীগ সরকার সুপ্রিম কোর্টের যে ইজ্জত ও মর্যাদা নষ্ট করেছে, তা কাভার করতে অনেক সময় লাগবে।বিতর্কিত বিচারপতিদের বিরুদ্ধে এত দেরিতে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে কেন, সরকারের প্রতি এমন প্রশ্ন রাখেন ব্যারিস্টার খোকন। সেই সঙ্গে যারা তাদের পুনর্বাসিত করতে চেষ্টা করছে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানান।