শিক্ষার ক্রমবিকাশের মাধ্যমে বিশ্বসমাজ ব্যবস্থা উন্নতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে এবং শিক্ষা হচ্ছে সব উন্নতির চাবিকাঠি। এই জন্য শিক্ষা বর্তমানে শুধু সুযোগ নয়, অধিকারও বটে। শিক্ষায় বিনিয়োগকে সবচেয়ে টেকসই বিনিয়োগ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে দক্ষ জনশক্তি হিসেবে গড়ে তুলতে হলে তাদের মানসম্মত শিক্ষায় শিক্ষিত করার কোনো বিকল্প নেই। কিন্তু দেশের জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় অধিভুক্ত কলেজগুলোতে উচ্চশিক্ষার নামে যে ‘নামমাত্র শিক্ষা’ চলছে, সেটিকে শুধু প্রহসন বললে কম বলা হবে, বরং হাতে ধরে সংখ্যাগরিষ্ঠ তরুণ-তরুণীর ভবিষ্যৎ জলাঞ্জলি দেয়ার কর্মকাণ্ড চলছে।
১৯৯২ খ্রিষ্টাব্দে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর কলেজের উচ্চশিক্ষা এ বিশ্ববিদ্যালয়ের আওতাভুক্ত করা হয়। নামে বিশ্ববিদ্যালয় হলেও কার্যক্রমের দিক থেকে এটি মূলত পরীক্ষা বোর্ড। স্নাতক পাস কোর্স দিয়ে শুরু হলেও এখন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক (সম্মান) ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি দেয়া হয়, এ ছাড়া পেশাগত কোর্সও আছে।
কিন্তু প্রয়োজন ও চাহিদার কথা না ভেবে শুধু রাজনৈতিক ও ব্যবসায়িক স্বার্থ বিবেচনায় ঢালাওভাবে কলেজগুলোতে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি খোলা হয়েছে। ভর্তি করা হয়েছে বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থী। অথচ সেখানে না আছে পর্যাপ্ত শিক্ষক, না আছে শ্রেণিকক্ষ, গ্রন্থাগার, গবেষণাগার কিংবা অন্য কোনো শিক্ষা অবকাঠামো। ফলে পাঠদানও নিয়মিত করা সম্ভব হয় না। এতো অপ্রতুলতার মধ্যে নামমাত্র শিক্ষা ছাড়া আর কোনো কিছু দেয়া সম্ভব হচ্ছে না।
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সূত্র মতে, সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন ৮৮০টি কলেজে স্নাতক চালু আছে। সব মিলিয়ে এসব কলেজে ২৯ লাখের বেশি শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করছেন। দেশে যতো শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষা নেন, তার ৬৬ শতাংশই পড়েন সেখানে। এদের একটা বড় অংশ অসচ্ছল ও নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান। নানা কারণে নিরুপায় হয়ে এসব কলেজে উচ্চশিক্ষা নিতে ভর্তি হলেও তারা বৈষম্যমূলক আচরণের শিকার হচ্ছেন।
অন্যান্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনায় জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী প্রতি সরকারি ব্যয় নামমাত্র। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষার্থীর পেছনে বছরে যেখানে ১ লাখ ৮৫ হাজার টাকা ব্যয় করা হয়, সেখানে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষার্থীর পেছনে বরাদ্দ মাত্র ৭৪৩ টাকা। শিক্ষার্থীর বিপরীতে শিক্ষকের সংখ্যাও অনেক কম। গবেষণার ক্ষেত্রেও অসম আচরণের শিকার হয় জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়। এ ছাড়া ভয়াবহ সেশনজট তো আছেই। একই সেশনে ভর্তি হয়ে অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের থেকে অনেক পিছিয়ে পড়ছে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা।
উচ্চশিক্ষা শেষে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা যে তেমন কিছুই শিখতে পারছেন না, তার প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে ২০২১ খ্রিষ্টাব্দে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) জরিপ থেকে। সংস্থাটির জরিপে বেরিয়ে আসে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত কলেজগুলো থেকে পাস করা শিক্ষার্থীদের ৬৬ শতাংশই বেকার থাকছেন।
উচ্চশিক্ষার মধ্য দিয়ে দক্ষ, প্রশিক্ষিত ও যুগোপযোগী মানবসম্পদ হিসেবে গড়ে না তুলে তরুণ জনগোষ্ঠীর সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশকে এভাবে অদক্ষ করে রাখার জবাব কী? জনমিতিক হিস্যা দেশে ৩০ বছরের নিচের জনগোষ্ঠী এখন সবচেয়ে বড় অংশ। একটা জাতির সামনে এ ধরনের অনন্য সুযোগ বারবার আসে না। অথচ কতো হেলায় সেই সুযোগকে নষ্ট করা হচ্ছে।
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য বলেছেন, এ পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসতে এবং শিক্ষার্থীদের দক্ষ করে গড়ে তুলতে তারা একাডেমিক মহাপরিকল্পনা করেছেন। কিন্তু অবকাঠামো উন্নয়ন, শিক্ষক নিয়োগ ও বিনিয়োগের ক্ষমতা যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের হাতে নেই, তখন সেই মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন কি আদৌ সম্ভব? জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চশিক্ষার এই শোচনীয় পরিস্থিতির দায় সরকার কোনোভাবেই এড়াতে পারে না। সংখ্যাগরিষ্ঠ তরুণদের এভাবে নামমাত্র উচ্চশিক্ষা দিয়ে কাঙ্ক্ষিত অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ গড়ে তোলা সম্ভব নয়। বিভিন্ন কলেজে শিক্ষক সংকটের কারণে ও কর্তৃপক্ষের উদাসীনতায় শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থীদের শতভাগ উপস্থিতি নিশ্চিত করা সম্ভব হচ্ছে না। ফলে মেধা বিকাশের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের সর্বজনীন ও ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির উন্নয়ন হচ্ছে না। শিক্ষার্থীরা ক্লাসমুখি না হয়ে গাইড নির্ভর হয়ে গেছে। গাইড নির্ভর শিক্ষা দিয়ে শিক্ষার্থীরা কখনো নিজেদেরকে যুগের উপযোগী করে গড়ে তোলা সম্ভব না। একজন অনার্স শিক্ষার্থী হিসেবে সিলেবাসভূক্ত মেইন বই না পড়ে, লাইব্রেরিমুখী এবং সংশ্লিষ্ট বিভাগের সেমিনারমুখী না হয়ে শুধু গাইড নির্ভর শিক্ষায় নিজেকে আসক্ত করে রাখে, তাহলে কখনো তাদের মধ্যে সৃজনশীল নেতৃত্বের ও মেধার বিকাশ ঘটবে না। সরকারি ও বেসরকারি বাস্তব কর্মক্ষেত্রে জ্ঞান, দক্ষতা ও দৃষ্টিভঙ্গির ক্ষেত্রে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত কলেজের শিক্ষার্থীদের মধ্যে রাত আর দিনের তফাৎ লক্ষ্য করা যায়। এর অন্যতম কারণ শিক্ষার্থীরা গবেষণাধর্মী বই গভীরভাবে অধ্যয়ন না করে শুধু পরীক্ষায় পাস করার জন্য গাইড বই পড়ছে। বিভিন্ন কম্পিউটারের দোকান এবং বিভিন্ন লাইব্রেরি থেকে টার্ম পেপার ও গবেষণা প্রতিবেদন ক্রয় করে সংশ্লিষ্ট বিভাগের কাছে জমা দিয়ে শিক্ষার্থীরা তাদের অ্যাসাইনমেন্টের কাজ সম্পন্ন করে থাকেন।
তা ছাড়া, বেসরকারি কলেজ ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে ব্যবস্থাপনা কমিটির একাডেমিক বিষয়ে অনৈতিক হস্তক্ষেপের কারণে শিক্ষকরা অনেক ক্ষেত্রে স্বাধীনভাবে পাঠদান কার্যক্রম সুসম্পন্ন করতে পারেন না। যা মানসম্মত শিক্ষা বাস্তবায়নের পথে বড় বাধা। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ বন্ধ করে, এ বিশ্ববিদ্যালয়কে প্রকৃত উচ্চশিক্ষার কেন্দ্রে পরিণত করা সময়ের দাবি। জাতিসংঘ কর্তৃক দোলন কমিশনের মাধ্যমে একবিংশ শতাব্দীর শিক্ষা ব্যবস্থার স্তম্ভ চারটি নির্ধারণ করা হয়েছে। যথা-জানতে শেখা, করতে শেখা, মিলেমিশে বাস করেত শেখা এবং বিকশিত হওয়ার জন্য শেখা। এই বিষয়সমূহ সম্পর্কে সরকারের বাস্তব সম্মত কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া আবশ্যক।
লেখক: অধ্যক্ষ