শিরোনাম থেকে বোঝা যায় শিক্ষা ও ভাবনা এই দুইটি সমন্বয় করা হয়েছে। শিক্ষা কী এ বিষয়ে এখন নাইবা বললাম। প্রাচীনকাল থেকে মানুষ শেখার কাজে ব্যস্ত। আধুনিক যুগে পৃথিবীর একটা বিরাট অংশ এ শিক্ষার সঙ্গে জড়িত। মূলত শিক্ষা হলো প্রত্যেক ব্যক্তির মূল হাতিয়ার। কৃষক, নৌকার মাঝি, গাড়ির ড্রাইভার, শ্রমিক, কামার-কুমার এমন কোনো ব্যক্তি নেই যে এই শিক্ষার সঙ্গে জড়িত নেই। চিন্তা-ভাবনা করলেই বুঝতে পারবেন জন্ম থেকে শুরু করে কবর পর্যন্ত শিক্ষার কোনো শেষ নেই।
প্রত্যেক ব্যক্তি শিখতে চান, জানতে চান। যাই হোক লেখা ও জানা ক্ষেত্রে কেউ শিক্ষক কেউ ছাত্র। এমনো হতে পারে মানুষ পরিবেশ থেকেই তাদের এই শিক্ষা সূচনা করেন। একটু গভীরভাবে চিন্তা করলেই বুঝতে পারবেন আজ থেকে দুইশত বছর বা তিনশত বছর পূর্বে আপনার আশেপাশে কোনো শিক্ষাঙ্গন ছিলো না। তখন মানুষ তাদের জাগতিক জ্ঞান দ্বারা জীবন অতিবাহিত করতেন। বিশাল জনগোষ্ঠী শিক্ষাদান এবং শিক্ষাগ্রহণ নিয়ে ব্যস্ত ছিলো না। মানুষ যখন থেকে আধুনিকতার ছোঁয়া পেয়েছেন তখন থেকে শিক্ষা প্রসার ও প্রচারণা শুরু করেছেন।
প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় শিল্প বিপ্লব পাড়ি দিয়ে আমাদের সামনের চতুর্থ শিল্প বিপ্লব হাতছানি দিচ্ছে। মানুষ একটু ভাবলেই বুঝতে পারবেন চতুর্থ শিল্প বিপ্লব কেমন হবে? মানুষ হয়ে যাবে যন্ত্র নির্ভর। যন্ত্রই মানুষের জীবনযাপনকে পরিচালিত করবে। যন্ত্রের দাসত্ব করা ছাড়া মানুষের অন্য কোনো উপায় থাকবে না। এটাকেই বলা হবে উন্নয়ন। কিন্তু আশরাফুল মাখলুকাতকে যন্ত্রের কথা মতো ওঠ-বস করতে হয়, তাহলে সৃষ্টির সেরা জীব হিসেবে মানুষের মান-মর্যাদা অনেকটাই কমে যাবে।
এসব এখনই বলতে গেলে অপ্রাসঙ্গিক মনে হবে। শিক্ষার কথায় আসা যাক। এই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মৌলিক উপাদান নিয়ে যারা কাজ করছেন তারা হলেন শিক্ষক। চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের ধাক্কায় অন্য বহু পেশার মতো বর্তমানে শিক্ষাগত পেশাও বিলুপ্ত হবে। এখন তাহলে বোঝা যায় যন্ত্র নির্ভর বিশ্বে শিক্ষকতা পেশাকে টিকিয়ে রাখতে হলে এমন একটা কিছু যোগ করতে হবে যার বিকল্প তৈরি করা প্রযুক্তির সাধ্যের বাইরে। অন্যান্য পেশার মতো শিক্ষকতা পেশাকে যেহেতু যন্ত্রের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে হবে, তাহলে এই পেশাটিকে টিকিয়ে রাখতে হলে শিক্ষকেরাই শিক্ষার্থীদেরকে যা যা শেখাচ্ছেন বা শিক্ষার্থীদেরকে যেসব বিষয়ে মূল্যায়ন করার চেষ্টা করেছেন, তার ভেতর এমন কী আছে যা যন্ত্র বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা তাদেরকে শেখাতে কিংবা মূল্যায়ন করতে পারবে না। চিন্তা বা ভাবনার বিষয় হলো বর্তমানে শিক্ষকেরা এমন কিছু শেখাচ্ছেন না যা শেখানের ক্ষমতার যন্ত্রের নেই।
বরং এখানে এমন অনেক কিছুই আছে যা যন্ত্র আরো ভালো করে শেখাতে পারে। এটাও ঠিক যে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সম্বলিত এসব যন্ত্র এখনো বহুল প্রচলিত বা সহজলভ্য নয়। তবে চতুর্থ শিল্প বিপ্লব যেহেতু দরজায় কড়া নাড়ছে সুতরাং এসব প্রযুক্তির শিখন-শেখানো পদ্ধতি অবিচ্ছিন্ন অংশে পরিণত হবে। তাই শিক্ষকদের এমনভাবে এগিয়ে আসতে হবে যাতে ভবিষ্যৎ পৃথিবীতে পরিবর্তিত পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে প্রতিযোগিতাময় বিশ্বে নিজেদের অবস্থান দৃঢ় করে তুলতে পারে।
এজন্যই ২০২১ খ্রিষ্টাব্দের নতুন শিক্ষাক্রম নিয়ে একটি রূপরেখা প্রণয়ন করে। ওই রূপরেখা আলোকে ২০২২ খ্রিষ্টাব্দে ৬২টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নতুন শিক্ষাক্রমের পাইলটিং কার্যক্রম হয়। এরই ধারাবাহিকতা ২০২৩ খ্রিষ্টাব্দে ষষ্ঠ এবং সপ্তম শ্রেণির নতুন শিক্ষাক্রমের পাঠদান কার্যক্রম পরিচালিত হয় এবং ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দে মাধ্যমিকের ষষ্ঠ থেকে নবম এবং প্রাথমিকে দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণিতে নতুন শিক্ষাক্রম অনুযায়ী পাঠদান কার্যক্রম পরিচালিত হয়। এ শিক্ষাক্রম শিখন-শেখানো কার্যক্রমে অনেক পরিবর্তন আনা হয়েছে, যা বাস্তবায়িত হলে গুণগত শিক্ষা অর্জনের পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের বৈশ্বিক নাগরিকত্ব হতে সহায়তা করবে।
যেমন-নতুন শিক্ষাক্রমে শিখন-শেখানো কার্যক্রম আর শ্রেণিকক্ষে সীমাবদ্ধ থাকবে না। তা ক্লাসরুমের বাইরে, স্কুল আঙ্গিনা, কিংবা আরো বহুদূর পর্যন্ত বিস্তৃত হবে। অর্থাৎ বাস্তব সমস্যার সমাধান সমাপ্ত সকল কার্যক্রম থাকবে এ কারিকুলামে। একইভাবে একজন শিক্ষক এখন তার শিক্ষার্থীদের শিখন প্রক্রিয়াকে আগের মতো নিয়ন্ত্রণ করবে না। তিনি মূলত শিক্ষার্থীকে সহায়তা করবেন। যাতে শিক্ষার্থী নিজে অনুসন্ধান করে তা অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে শেখেন। মূল্যায়নের ক্ষেত্রে একটা বড় পরিবর্তন আসছে। আগের মতো খাতা-কলমে পরীক্ষা যে থাকবে না তাও নয়। তবে মূল্যায়নের একটা বড় অংশ হলো ধারাবাহিক মূল্যায়ন। শিক্ষার্থীরা বাস্তব সমস্যার সমাধানের দক্ষ হয়ে গড়ে উঠবে। সৃজনশীলতা, সুক্ষ চিন্তন দক্ষতা, নৈতিকতা, খাপ খাইয়ে নেয়ার ক্ষমতা, সহযোগিতা, আত্মনিয়ন্ত্রণ ইত্যাদি থাকলে মানুষ আসন্ন চতুর্থ শিল্প বিপ্লব প্রবল জোয়ারে হারিয়ে যাবে না। অর্থাৎ যন্ত্রের দাসে পরিণত না হয়ে কিংবা নিজের অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যাবে না। নিজেদেরকে শ্রেষ্ঠ জীব হিসেবে পৃথিবীতে টিকিয়ে রাখতে সক্ষম হবে। এ সক্ষম জনগোষ্ঠী তৈরি করতে উপযুক্ত পরিবেশ দিতে হবে। এ পরিবেশ পরিস্থিতি তৈরি করতে নতুন শিক্ষাক্রম বদ্ব পরিকর। নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নের জন্য এনসিটিবি শিক্ষকদের জন্য তৈরি করেছে শিক্ষক সহায়ক বই বা টিচার্স গাইড।
রাষ্ট্রীয়ভাবে শিক্ষকদের জন্য প্রশিক্ষণের মাধ্যমে নতুন শিক্ষাক্রমের বাস্তবায়ন করার ব্যবস্থা করা হয়েছে। সচেতন নাগরিক, রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গ, অংশীজনসহ সকলে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি প্রদর্শন করে যন্ত্রনির্ভর এ পৃথিবীতে নিজেদেরকে সক্ষম করে গড়ে তুলতে ভূমিকা পালন করতে হবে।
লেখক: মাস্টার ট্রেইনার, নতুন শিক্ষাক্রম