যুগের পালে হাওয়া লেগেছে, জ্ঞান-সমুদ্রের গতিপথও পালটে যাচ্ছে নিয়তই, তবুও তরতর বেগে ছুটে চলেছে মানবের উন্নয়নের নেশায় সম্মুখে বেগবান বিজ্ঞান নামক তরীটি যার কাণ্ডারি বর্তমান বিশ্বের উন্নত দেশগুলো। তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলো সেই তরীর সহযাত্রী মাত্র। প্রতিটি দশকেই বিশ্ব বদলে যাচ্ছে, ধারণ করছে নতুন রূপ, পালটে যাচ্ছে নাগরিক জীবনধারা। আধুনিক প্রজন্মকে সাক্ষী রেখে বিশ্ব গড়তে চলেছে নতুন এক ইতিহাস যার, নির্মাতা হিসেবে কেন্দ্রে রয়েছে ‘বায়োটেক, ন্যানোটেক ও ইনফোটেক’ প্রযুক্তি।
বায়োটেক বা জৈবপ্রযুক্তি হলো মানব-স্বাস্থ্য ও সমাজ উন্নয়নে নতুন কোনো পদ্ধতি ও জিন বিকাশে জীববিজ্ঞানের ব্যবহার যা মানব-সভ্যতার উষালগ্ন থেকেই ব্যবহৃত হয়ে আসছে। রোগের ডায়াগনোসিস, ইনসুলিন, ভ্যাকসিন, হরমোন, জিন-থেরাপি এসবই জৈবপ্রযুক্তির অবদান। ন্যানোটেকনোলজি হলো পদার্থকে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্ররূপে বা আণবিক পর্যায়ে পরিবর্তন ও নিয়ন্ত্রণ করার বিদ্যা। এর ব্যবহার বহুমাত্রিক-এর বিস্তৃতি সাধারণ পদার্থবিদ্যা থেকে অত্যাধুনিক আণবিক স্বয়ং-সংশ্লেষণ প্রযুক্তি পর্যন্ত।
কম্পিউটরের যন্ত্রাংশ তৈরি, খাদ্য শিল্প, চিকিৎসা, যোগাযোগ প্রযুক্তি, জ্বালানি, রাসায়নিক শিল্প এবং ইলেকট্রনিক্স পণ্য প্রস্তুত শিল্পে ন্যানোটেকনোলজির ব্যবহার ইতোমধ্যেই অভূতপূর্ব সাফল্য এনে দিয়েছে। ন্যানোটেকনোলজি ব্যবহারে উৎপাদিত পণ্য আকারে ছোট, হাল্কা অধিক মজবুত ও টেকসই হয় কিন্তু এর অপব্যবহারে মারাত্মক ঝুঁকিও তৈরি হতে পারে। এই প্রযুক্তি পূর্ণমাত্রায় বিকশিত হলে মারাত্মক যুদ্ধাস্ত্র তৈরি হতে পারে, এটির সংস্পর্শে মারাত্মক স্বাস্থ্য ঝুঁকি তৈরি হতে পারে এবং পানি ও বায়ূর দূষণ ঘটিয়ে মানুষ ও অন্যান্য প্রাণীর জীবনে বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে। ইনফোটেক আমাদেরকে পরিচিত করিয়েছে এক নুতন যুগের সঙ্গে যার নাম ইনফরমেশন সুপার হাইওয়ে. কম্পিউটর, মোবাইল ফোন, ইন্টারনেট, যতো রকম সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম, রোবট-এ সবই ইনফরমেশন টেকনোলজির অবদান।
সর্বশেষ যে প্রযুক্তি নিয়ে সর্বাধিক আলোচনা ও সমালোচনা হচ্ছে সেটির নাম এআই বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। উন্নত দেশগুলোতে এটির ব্যবহার শুরু হয়েছে বেশ কয়েক বছর আগেই। যদিও আমাদের দেশে এ সম্পর্কে অনেকেরই তেমন কোনো ধারণা নেই। আধুনিক বিশ্বের অন্যান্য দেশের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার জন্য এ বিষয়ে আমাদের একটি স্বচ্ছ ধারণা থাকা আবশ্যক এবং আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায়ও এর অন্তর্ভুক্তি জরুরি। বিষয়টির আলোচনা দীর্ঘ, কিন্তু সংগত কারণেই এখানে আলোচনার কলেবর বৃদ্ধি করা থেকে বিরত থাকতে হচ্ছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহারে যেমন অনেক সুবিধা রয়েছে তেমনই কিছু মারাত্মক ঝুঁকিও রয়েছে বলে বিজ্ঞানীরা জানাচ্ছেন এবং ইতোমধ্যেই এ বিষয়ে সতর্কবাণীও উচ্চারিত হয়েছে একাধিক জনের পক্ষ হতে।
এআই এর বর্তমান সফল ব্যবহার এবং ভবিষ্যৎ ঝুঁকি নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে Hebrew University of Jerusalem এর বিশ্ব-ইতিহাস বিশেষজ্ঞ প্রফেসর Yuval Noah Harari তার 21 lessons for the 21st Century বইতে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছেন, When you grow up, you might not have a job. তিনি আরো বলেছেন, ২০৫০ খ্রিষ্টাব্দে বিশ্বের চাকরি-বাজার কেমন হবে তা আমরা কেউ কল্পনা করতে পারি না। ধারণা করা হয় AI, machine learning এবং রোবোটিকস বর্তমান মানবের সমস্ত কাজের ধারায় এক বিশাল পরিবর্তন সূচনা করবে এবং আগামী দুই দশকের মধ্যে কয়েক বিলিয়ন চাকরিজীবী তাদের চাকরি হারিয়ে বেকার হয়ে পড়বেন অথবা তাদের অনেকেই জীবন বাঁচানোর তাগিদে অতিমানবীয় গুণাবলী অর্জন করবে এবং খুব দ্রুতই উদ্ভাবিত নুতন প্রযুক্তি সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করে ভিন্ন ধারায় কর্মজীবন শুরু করতে বাধ্য হবেন।
তবে কারো কারো ধারণা, কম্পিউটারাইজড অটোমেশনের কারণে নতুন নতুন কাজের উদ্ভব হবে এবং চাকরির সুযোগ হবে যেখানে কাজের ধরন হবে বর্তমানের চেয়ে সম্পূর্ণ আলাদা। আশাবাদীরা বলেন, ইউরোপের শিল্প বিপ্লবের সময় আবিষ্কৃত বাষ্পীয়-শকট, মোটরযান ও অন্যান্য যন্ত্রপাতির ব্যবহার বিপুল সংখ্যক মানুষকে কর্মহীন ও বেকার করবে বলে ধারণা করা হলে তা ঘটেনি, বরং বিভিন্ন কলকারখানা ও ফ্যাক্টরিতে কর্মসংস্থানের সুযোগ করে দিয়ে মানুষের জীবনযাত্রাকে সহজ ও আরামদায়ক করে তুলেছিলো। কিন্তু সময় বদলে গেছে। সে সময়ের শিল্প-বিপ্লবের প্রেক্ষাপট এবং বর্তমান প্রেক্ষাপট এক নয়। সামনে আসছে এক অন্য সময় যা এখনো আমাদের কল্পনার বাইরে। সময়ই বলে দেবে উল্লিখিত প্রযুক্তি মানুষের ওপর কেমন প্রভাব বিস্তার করবে।
মানুষ সাধারণত দু’ধরণের শক্তিতে বলীয়ান-শারিরীক এবং জ্ঞানভিত্তিক। মানুষের শারিরীক শক্তির বিকল্প হিসেবে আবিষ্কৃত হয়েছে যান্ত্রিক শক্তি। এক্ষেত্রে মানুষ তার জ্ঞানভিত্তিক ক্ষমতাকে ব্যবহার করে ইচ্ছা ও প্রয়োজন অনুসারে আবিষ্কৃত যন্ত্রকে কাজে লাগিয়েছে। কিন্তু বর্তমানে বহুল আলোচিত এআই মানুষের জ্ঞানের এবং আবেগের জায়গাটিও প্রায় দখল করতে চলেছে। এমনকি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার কাছে মানুষের স্বাভাবিক বুদ্ধিমত্তা পরাভূত হবার উপক্রম হয়েছে। বৃটিশ গোয়েন্দা বিভাগে এখন আর স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের পুলিশ, শারলক হোমস অথবা ডাক্তার ওয়াটসনের তেমন কোনো গুরুত্ব নেই, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা পরিচালিত কম্পিউটারাইজড সিস্টেমই এখন দুষ্কৃতকারীকে চিহ্নিত করে তার অবস্থান বলে দিতে পারে। মানুষ যেখানে তার ইনটিউশন ব্যবহার করতো সেখানেও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সফলভাবে কাজ উদ্ধারে সক্ষম।
প্রথমে ধারণা করা হয়েছিলো এআই শুধু কম্পিউটারকেই দ্রুতগতি দান করবে কিন্তু বাস্তবে এটি মানুষের কর্ম ও সমাজ জীবনকেও প্রভাবিত করেছে সাংঘাতিকভাবে।
মানুষের দৈনন্দিন আচরণ বিশ্লেষণ, সিদ্ধান্ত গ্রহণ, গাড়ি চালনা, ড্রোন চালনা, হিসাব পরিচালনা ও অন্যান্য ক্ষেত্রে মানুষের চেয়ে অধিকতর নির্ভুল ও দক্ষভাবে কাজ সম্পন্ন করতে সক্ষম কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা চালিত রোবট। মাইক্রো-রোবট মানুষের শরীরে প্রবেশ করিয়ে টিউমার অথবা ক্যানসার সেল শনাক্তকরণ ও ধ্বংসকরণ এখন উন্নত দেশগুলোতে একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। বিজ্ঞানীরা বলছেন, এআই মানুষের ব্রেনকে পর্যন্ত হ্যাক করতে সক্ষম যদি সেটি সঠিকভাবে নিয়ন্ত্রিত না হয়। বিষয়টি খুবই উদ্বেগজনক। ১৯৯৭ খ্রিষ্টাব্দের কোনো একদিন চ্যাম্পিয়ন দাবাড়ু গ্যারি ক্যাসপারভ কম্পিটারে DEEP BLUE Program এর সঙ্গে দাবা প্রতিযোগিতায় নেমে শোচনীয়ভাবে পরাজয় বরণ করেছিলেন। এই প্রথম একজন দাবাড়ু হার মানলেন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার কাছে।
১৯৫০ এর দশকে নিউইয়র্ক টাইমস এ HYPE (a marketing platform) প্রকাশিত এক রিপোর্টে বলা হয়েছিলো যে, AI will be able to walk, talk, see, write, reproduce itself and be conscious of its existence. কিন্তু ‘WHAT YOU DO THAT ARTIFICIAL INTELLIGENCE NEVER WILL বইতে রবার্ট জে. মার্ক্স বলেন, ‘It’s a myth that artificial intelligence (AI) is bound to overtake human intelligence if it has not done already, achieving not only far faster computation than we’re capable of but the pinnacle of what it means to be human: consciousness, feeling, free will and creativity. অতি সাম্প্রতিককালে ইলন মাস্ক, স্টিফেন হকিং এবং বিল গেটস প্রমুখরাও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সম্পর্কে সতর্কবাণী উচ্চারণ করে বলেন, AI could plot to replace humans, or destroy us. মানুষের উন্নয়নের জন্য, মঙ্গলের জন্য প্রযুক্তির আবিষ্কার কিন্তু সেটি যদি পারমাণবিক বোমার মতো শুধু ধ্বংসের কাজে ব্যবহৃত হয় তবে সেটি হবে মানবতার চরম বিপর্যয়। এত কিছুর পরও মানুষ সব সময় ভালো কিছু শুনতে চায়, কাজেই একটি আশার বাণী উচ্চারিত হতে পারে এভাবে- দু’টি পরমাণু শক্তিধর দেশের মধ্যে ঘটে যাওয়া কয়েক সেকেন্ডের একটি পারমাণবিক যুদ্ধ পৃথিবী থেকে প্রাণের অস্তিত্ব সম্পূর্ণ মুছে দিতে পারে, পৃথিবী নামক গ্রহটিকে একেবারে ধ্বংস করে দিতে পারে কিন্তু তা কি ঘটেছে আজ পর্যন্ত? শক্তিকে নিয়ন্ত্রণ করবার ক্ষমতা এখনো মানুষের হাতে, তাই কেউ কখনো চাইবেনা তার নিজের অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যাক কোনো পদার্থ বা প্রযুক্তির কাছে।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার অপরিসীম শক্তিকে কীভাবে নিয়ন্ত্রণে রাখা যায় সে বিষয়ে ইতোমধ্যেই গবেষণা শুরু হয়েছে। বিশ্বব্যাপী এই শক্তির ব্যাপক ব্যবহার শুরুর আগেই একটি নীতিমালা প্রণীত হবে যার মাধ্যমে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে নিয়ন্ত্রণে রেখে শুধু কল্যাণকর কাজেই ব্যবহার করা যাবে।
Professor Harari তার উল্লিখিত গবেষণা গ্রন্থে বলেন, ‘With the rise of AI, robots and 3-D printers, cheap, unskilled labor would become far less important. Instead of manufacturing a shirt in Dhaka and shipping it to the USA you could buy the shirt’s code online from the Amazon and print it in New York. Instead of economic growth improving the condition all over the world, we might see immense new wealth created in hi-tech hubs such as Silicon Valley.’ বায়োমেট্রিক সেন্সর সম্পর্কে তিনি বলেন, By 2050, thanks to biometric sensors and Big Data algorithms, diseases may be diagnosed and treated long before they lead to pain or disabilities. Health algorithm will send periodic updates to our smart phones telling that ‘seventeen cancerous cells were detected and destroyed.’ শরীরে বায়োমেট্রিক সেন্সর লাগানো হলে সেটি বায়োলজিকাল প্রক্রিয়াকে ইলেকট্রনিক ইনফরমেশন রূপান্তরিত করতে সক্ষম, যা শরীরের অবস্থা বিশ্লেষণ করে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে তথ্য সরবরাহ করতে পারবে। তবে এটি প্রতি ক্ষণে ক্ষণে এতো বেশি তথ্য দিতে থাকবে যে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির সাধারণ অনুভূতি লোপ পেয়ে যাবে অর্থাৎ তার ব্রেন হ্যাকড হয়ে যাবে। সবকিছু নির্ভর করছে আমরা কতোটুকু প্রজ্ঞা ও দক্ষতার সঙ্গে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা চালিত রোবটকে ব্যবহার করবো তার ওপর। আর তাই প্রফেসর হারারি আবারো বলেন, The real problem with the robot is not their own artificial intelligence, but rather the natural stupidity and cruelty of their human masters.
অতি সংক্ষিপ্ত আকারে এই আলোচনা থেকে এটি স্পষ্ট যে এই মুহূর্তে সারা বিশ্বে প্রচলিত শিক্ষা ও কাজের ধরন সহসাই পরিবর্তিত হয়ে যাচ্ছে এবং খুব দ্রুতই পরিবর্তন আসছে মানুষের চাকরি এবং কাজের ধরনেও। একটি স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করলেই ব্যাংক বা অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানের হিসাবরক্ষক বা ক্যাশিয়ার হয়ে জীবন ধারণের মতো প্রয়োজনীয় আয়-রোজগারের ব্যবস্থা হয়ে যাবে-এমন ধারণা এখনই ত্যাগ করবার এবং নিজেকে সময়োপযোগী করে প্রস্তুত করবার সময় এসেছে। অচিরেই হয়তো ওই পদগুলোতে কাজ করবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন কোনো রোবট। আমাদের দেশের শিক্ষা-কারিকুলামেও পরিবর্তন এসেছে তবে সেখানে আধুনিক প্রযুক্তি শিক্ষার ওপর কতোটুকু গুরুত্ব দেয়া হয়েছে সেটি আরেকবার ভেবে দেখতে হবে। আমরা কি অদূর ভবিষ্যৎ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করার জন্য তৈরি? শিক্ষা কারিকুলামে ধর্মীয় বিষয় আবশ্যিক করতে হবে এমন দাবিতে অনেকেই সোচ্চার কিন্তু কম্পিউটার বিজ্ঞানসহ আধুনিক প্রযুক্তি বিদ্যাকে আবশ্যিক বিষয় করা হোক-এমন দাবি আজ পর্যন্ত কারো মুখে উচ্চারিত হয়েছে কি?
লেখক: যুগ্মপরিচালক, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়