ঢাকা বুধবার, ০৩ জুলাই ২০২৪ , ১৮ আষাঢ় ১৪৩১ আর্কাইভস ই পেপার

nogod
nogod
bkash
bkash
uttoron
uttoron
Rocket
Rocket
nogod
nogod
bkash
bkash

খোলামেলা কথা 

সাবেক প্রধান বিচারপতির নতুন নিয়োগ প্রসঙ্গে

মতামত

একেএম আবদুল আউয়াল মজুমদার

প্রকাশিত: ০১:০০, ২৪ জুন ২০২৪

সর্বশেষ

সাবেক প্রধান বিচারপতির নতুন নিয়োগ প্রসঙ্গে

আমার নিজ জেলা কুমিল্লা। কুমিল্লার একটা প্রবাদ হলো, ‘সামনে দিয়ে একটা খড় গেলেও হুংকারের শেষ নেই, কিন্তু পেছন দিয়ে (গোপনে) যে হাতি চলে যাচ্ছে (বিশাল ক্ষতি হয়ে যাওয়া), সেদিকে খেয়াল নেই। সাম্প্রতিক পাওয়া দুর্নীতির চিত্র ও  বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকীকে নিয়ে আলোচনা সে রকমই মনে হচ্ছে। 

যুক্তরাষ্ট্রের সর্বোচ্চ ও সবচেয়ে প্রভাবশালী গোয়েন্দা ও জাতীয় নিরাপত্তা সংস্থার নাম Federal Bureau of Investigation (FBI). এর প্রধান নির্বাহীর পদ ‘পরিচালক’। এই FBI হলো বিচার মন্ত্রণালয়ের একটি সংস্থা। FBI-এর

পরিচালক, যুক্তরাষ্ট্রের অ্যাটর্নি জেনারেলের কাছে রিপোর্ট করেন। অ্যাটর্নি জেনারেল পদাধিকার বলে যুক্তরাষ্ট্রের আইন/ বিচার মন্ত্রীও।

ফেডারেল জেলা আদালতের প্রধান বিচারক (Chief Judge of the United States District for the
Western District of Texas) Bill Sessions ১৯৮৭ থেকে ১৯৯৩ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত FBI পরিচালক ছিলেন। 

যুক্তরাষ্ট্রের ২৭তম প্রেসিডেন্ট William Howard Taft ১৯০৯ থেকে ১৯১৩ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত দেশটির প্রেসিডেন্ট
ছিলেন। পরে ১৯২১ থেকে ১৯৩০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান বিচারপতি ছিলেন। 

যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রীয় মর্যাদাক্রমে প্রেসিডেন্ট এক নম্বরে এবং প্রধান বিচারপতি পাঁচ নম্বরে। এতে কোনো
অসুবিধা হয়নি। কেউ মর্ষাদাক্রম অথবা William Howard Taft এর নিয়োগ অথবা নিরপেক্ষতা নিয়ে
প্রশ্ন তোলেননি। 

অষ্ট্রেলিয়ার প্রথম প্রধানমন্ত্রী (সরকার প্রধান) Edmund Barton ১৯০১ থেকে ১৯০৩ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন।
তাঁকে অস্ট্রেলিয়ার Founding Fathers-দের একজন হিসেবে অত্যন্ত সম্মানের চোখে দেখা হয়। ১৯০৩ খ্রিষ্টাব্দে অস্ট্রেলিয়ার সর্বোচ্চ আদালত হাইকোর্ট প্রতিষ্ঠা করা হয়। উল্লেখ্য, অস্ট্রেলিয়া ফেডারেশনের সর্বোচ্চ আদালতের নাম
হাইকোর্ট এবং স্টেট বা অঙ্গরাজ্যসমূহের সর্বোচ্চ আদালতের নাম সুপ্রিম কোর্ট। 

Edmund Barton ১৯০৩ খ্রিষ্টাব্দে স্বেচ্ছায় রাষ্ট্রের প্রধান নির্বাহী তথা প্রধানমন্ত্রীর পদ ছেড়ে দেন এবং সানন্দে 
হাইকোর্টের একজন বিচারপতি (প্রধান বিচারপতি নয়) হিসেবে যোগদান করেন। তিনি ১৯০৩ থেকে ১৯২০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত  অস্ট্রেলিয়ার ফেডারেল হাইকোর্টের বিচারপতি ছিলেন। 

অস্ট্রেলিয়ার রাষ্ট্রীয় মর্যাদাক্রমে প্রধানমন্ত্রীর অবস্থান চার নম্বরে। হাইকোর্টের একজন বিচারপতির অবস্থান ১৩ নম্বরে। কিন্তু  কেউ Edmund Baton এর মর্যাদাক্রম বা নিরপেক্ষতা নিয়ে কোনো প্রশ্ন তোলেননি অথবা রাষ্ট্রের স্থপতিদের একজন হিসেবে তাঁর সম্মানও কমেনি।

শিক্ষকতা, দূতিয়ালি ও বিচারকের চাকরির রাষ্ট্রীয় মর্যাদাক্রম গৌন। এখানে ব্যক্তির ইমেজ ও অবদানই মুখ্য। প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টার প্রেসিডেন্ট ক্লিনটনের চেয়ে অনেক সিনিয়র ছিলেন। কিন্তু তিনি ক্লিনটনের দূত হিসেবে নানা দেশে গেছেন। একইভাবে ক্লিনটনও ওবামার দূতিগিরি করেছেন। তবে হুসাইন মোহাম্মদ এরশাদের দূতিগিরি এ তালিকায় আসবে না। সেখানে প্রেক্ষিত ভিন্ন ছিলো। 

পৃথিবীর নামি-দামি রাষ্ট্র নায়করা অবসর জীবনেশিক্ষকতা করেছেন। বাংলাদেশের সাবেক প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ  সিদ্দিকী অবসর গ্রহণের পর Judicial Training Institute (JTI) এর মহাপরিচালক হিসেবে যোগদান  করেছেন। এটি  শিক্ষকতার পদ।  শিক্ষকতা পেশার রাষ্ট্রীয় মর্যাদা গৌন। এ পেশায় সামাজিক  মর্যাদাই মুখ্য।  একজন শিক্ষক  ছাত্র -ছাত্রীদের কাছে যে ভালোবাসা ও সম্মান পান, সেটা যে কোনো মর্যাদাক্রমের অনেক ওপরে। প্রশিক্ষণার্থী/শিক্ষার্থীরা একজন ভালো শিক্ষকের কাছে যা শেখেন সেটা মহামূল্যবান। 

আমি বাংলাদেশের ষোলোতম প্রধান বিচারপতি এম এম রুহুল আমিনের শিক্ষানবিস। তবে তিনি তখন প্রধান বিচারপতি ছিলেন না। তিনি তখন কিশোরগঞ্জ জেলার জেলা ও দায়রা জজ। আমি তখন শিক্ষানবিস ম্যাজিস্ট্রেট। আমি এজলাসে তাঁর পাশে বসে মামলার কার্যক্রম শিখেছি। তখন তাঁর মতো একজন উঁচুমানের সৎ, সজ্জন ও জ্ঞানী মানুষের সাহচর্য পেয়ে  উজ্জীবিত হয়েছি। পরে তিনি প্রধান বিচারপতি হন। তাঁর এ পদে আসীন হবার পর অতীতের স্মৃতি স্মরণ করে নিজেকে সম্মানিত বোধ করি ও নতুন করে অনুপ্রাণিত হই। উল্লেখ্য, তিনি একমাত্র ব্যক্তি, যিনি মুন্সেফ হিসেবে ক্যারিয়ার শুরু করে প্রধান বিচারপতি পর্যন্ত দায়িত্ব পালনে সক্ষম হন।

আমি তো মনে করি, বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী জেটিআই এর মহাপরিচালক-এর পদ গ্রহণে সম্মত হয়ে দেশবাসীকে ঋণী করেছেন। সরকারও তাঁকে নিয়োগ দিয়ে ভালো কাজ করেছে। সরকার দেশের নবীন বিচারকদেরকে এক বটবৃক্ষের (অভিজ্ঞতা ও সাবেক পদবির বিবেচনায়) ছায়ায় পেশাদারিত্বের শিক্ষা ও দীক্ষা নেয়ার সুযোগ করে দিয়েছে। এতে নবীন অফিসাররা অনেক উজ্জীবিত ও উপকৃত হবেন।

প্রশিক্ষণে অ্যাকাডেমিক জ্ঞানের চেয়ে মিথষ্ক্রিয়া ও অভিজ্ঞতা বিনিময় ও অর্জনের বিষয়টি অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কাজেই এ কাজে একজন সাবেক প্রধান বিচারপতি অপেক্ষা অধিক যোগ্য কাউকে পাওয়া কী সম্ভব! আর জেটিআই-এর মহাপরিচালক–এর পদটি লাভজনক পদ নয়। এটি অবদান রাখার, আলো ছড়ানোর পদ। এখানে তিনি যে কয় টাকা বেতন-ভাতা নেবেন, সেটা নগণ্য। তিনি ভবিষ্যতের বড় বড় বিচারকদের সঙ্গ ও দীক্ষা দেবেন, তৈরি করবেন, এটা মহামূল্যবান। এটাকে সুযোগ হিসেবে, আশার আলো হিসেবে দেখাই বাঞ্ছনীয়। কোনো উচ্চ পদধারীর এমন পদ গ্রহণকে তাঁর উদারতা ও ত্যাগ হিসেবে দেখাই অধিকতর যুক্তিসঙ্গত। 

আমাদের প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানগুলো অবহেলিত। এখন ওইসব জায়গায় যাওয়ার মতো নিবেদিত মানুষ তেমন একটা পাওয়া যায় না। নিবিড় প্রশিক্ষণ ছাড়া ভালো বিচারক অথবা অফিসার কোনটাই তৈরি করা সম্ভব নয়। নবীন বিচারকদের মধ্যে সদিচ্ছা, সততা ও সাহস সঞ্চার করা অপরিহার্য। প্রধান বিচারপতির অভিজ্ঞতা সম্পন্ন একজন মানুষ এ ক্ষেত্রে সহজেই ইতিবাচক অবদান রাখতে পারেন।

আইসিএসদের প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানের নাম ছিলো হেইলিবারি কলেজ। যুক্তরাজ্যের কেবিনেট সেক্রেটারি অনেক ক্ষমতাধর মানুষ। যদিও তাঁকে নিয়ে কমই আলোচনা করা হয়। কিন্তু সিভিল সার্ভিস বিষয়ক গবেষণা ও আলোচনায় হেইলিবারি কলেজের অধ্যক্ষদের এড়িয়ে যাওয়া যায় না।

খালেদ শামস ১৯৬৪ ব্যাচের সিএসপি অফিসার। তিনি তার ব্যাচে পুরো পাকিস্তানে প্রথম হন। তিনি বাংলাদেশ সিভিল অফিসারস একাডেমির (কোটার) প্রথম অধ্যক্ষ। তিনি কোটাকে এমন মানে পরিচালনা করেন যে, তাঁকে বাংলাদেশের  বুনিয়াদি প্রশিক্ষণের জনক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তাঁর ক্যারিয়ারের এ অংশটুকু সবচেয়ে দীপ্তিমান। তাঁর প্রশিক্ষণার্থীরা তাঁকে গুরু ডাকেন।

সাবেক প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী তাঁর মেধা ও প্রজ্ঞা দিয়ে জেটিআইকে Centre of Excellence হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা করতে পারেন। তবে এমনটি ঘটাতে হলে ন্যূনতম ৪/৫ বছর সময় দরকার। খালেদ শামস কোটায় ৫ বছর ছিলেন। তাই তিনি কোটাকে Centre of Excellence এর পর্যায়ে নিতে সক্ষম হন। লন্ডনের হেইলিবারি কলেজের অধ্যক্ষ ড. যোশেফ হ্যালেট ব্যাটেন ২৩ বছর এবং ড. হেনরি মেলভিল ১৫ বছর অধ্যক্ষ ছিলেন। তাই তাঁরা ভালো কিছু করতে পেরেছিলেন। শুধু নিয়োগ দিলেই হয় না, ইতিবাচক পরিবর্তনের জন্য যৌক্তিক সময়ও দিতে হয়। তাই সরকার বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকীর দায়িত্বকাল ন্যূনতম চার বছর করতে পার।

উগান্ডার প্রথম প্রধানমন্ত্রী ছিলেন Benedicto Kiwanuka। ১৯৬২ খিষ্টাব্দে Milton Obote তাঁকে ক্ষমতাচ্যূত করেন। ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে ইদি আমিন মিল্টন ওবোতোকে হটিয়ে ক্ষমতা দখল করেন। অতপর ইদি আমিন সাবেক প্রধানমন্ত্রী Benedicto Kiwanuka কে প্রধান বিচারপতি নিয়োগ করেন। নিয়োগ পাবার পর তিনি ইদি আমিনের নির্দেশ মতো
বিচার কাজ পরিচালনা করতে অস্বীকৃতি জানান। তাই ১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দে ২২ সেপ্টেম্বর ইদি আমিন তাঁকে গুলি করে হত্যা করে।

শুধু নিয়োগ দিলেই হয় না। নিয়োগ দিতে হয় সততা, সুনাম ও যোগ্যতার ভিত্তিতে। কাজ করতে দিতে হয়
স্বাধীনভাবে। যিনি নিয়োগ পান, তাঁর থাকতে হয়, সদিচ্ছা, সততা, সাহস, জ্ঞান ও কর্মযোগী মনোভাব। 
এগুলোর সমন্বয় ঘটলে যেকোনো প্রতিষ্ঠান Centre of Excellence হতে বাধ্য।

লেখক: সাবেক সচিব ও সাবেক রেক্টর, বিপিএটিসি

জনপ্রিয়