সংবিধান, আইন ও সংসদ বিষয়ে বিশেষজ্ঞ সাংবাদিক প্রয়াত মিজানুর রহমান খান বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে অনেক দুর্লভ নথি প্রকাশ করেছিলেন। এসব নিয়ে তার লেখা উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলোর অন্যতম হলো- ‘১৯৭১: আমেরিকার গোপন দলিল’। এছাড়াও বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন পত্রপত্রিকাতে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে অনেক অজানা তথ্যের সম্ভার সাজিয়েছেন তিনি। নিয়েছেন অনেক এক্সক্লুসিভ সাক্ষাৎকার। প্রকাশ করেছেন অনেক অনুসন্ধানী প্রতিবেদন। সেগুলোর কোনো কোনোটিতে অবধারিতভাবেই উঠে এসেছে মুক্তিযুদ্ধে জামায়াতের ভূমিকা, গণহত্যা, আলবদর-আলশামস বাহিনীর অপতৎপরতা, বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড এবং মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তীকালে ওই সব অপকর্মের পক্ষে নির্লজ্জভাবে জামায়াত নেতাদের সাফাই গাওয়ার গল্প। তেমনই কিছু নির্বাচিত লেখা ঈষৎ সংক্ষেপিত আকারে উপস্থাপনার অভিপ্রায়ে এই ধারাবাহিক আয়োজন।
স্বাধীন বাংলাদেশের বিরুদ্ধে জামায়াতের বিরোধিতার অভিযোগ এবং সে বিষয়ে বিএনপি ও আওয়ামী লীগের মধ্যে ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরও তারা এর বিচার করেনি। বিএনপি স্বাধীন বাংলাদেশের বিরুদ্ধে জামায়াতের অপতৎপরতার তথ্য সুপ্রিম কোর্টে পেশ করেছে। এ-সংক্রান্ত নথিপত্র নিশ্চয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে বেগম খালেদা জিয়ার প্রথম সরকার রেখে গিয়েছিল। ১৯৯৩ সালে সংসদে জামায়াত নিষিদ্ধে বিএনপি ও আওয়ামী লীগ অভিন্ন সুরে শোরগোল তুলেছিল। কিন্তু শেখ হাসিনা ক্ষমতায় এসে গোলাম আযমের রাষ্ট্রদ্রোহিতার বিচার করেননি। সুতরাং উভয় দল জামায়াতকে নিয়ে রাজনীতি করেছে।
জামায়াত স্বীকার করে, অবিভক্ত পাকিস্তানের পক্ষে তাদের রাজনৈতিক অবস্থান ছিল। এই একটি স্বীকৃতিই দণ্ড প্রদানের জন্য যথেষ্ট। কারণ, বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের বিরুদ্ধে এমনকি আকারে-ইঙ্গিতেও বিরুদ্ধাচরণ করা রাষ্ট্রদ্রোহ। এ জন্য যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের বিধান রয়েছে। জামায়াত তাহলে বলুক, তারা বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ১৬ ডিসেম্বর ’৭১-পরবর্তী অপতৎপরতার জন্য শাস্তি মাথা পেতে নেবে কি না।
জামায়াত ১৯৬৪ সালে পাকিস্তান সুপ্রিম কোর্টে হলফনামা দিয়ে বলেছিল, ‘সরকারি দাবিমতে জামায়াতের ছাত্র সংগঠন ইসলামি তালাবার সঙ্গে তাদের কোনো সম্পর্ক নেই।’ গোলাম আযমের নাগরিকত্ব মামলায় জামায়াত বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টে হলফনামা দিয়ে বলেছে, বাংলাদেশবিরোধিতার তথ্য মিথ্যা। একাত্তরের পরে তালাবার সঙ্গে বাংলাদেশ জামায়াতের কী সম্পর্ক ছিল, সেটা পাকিস্তান জামায়াত ও তালাবার ওয়েবসাইট সাক্ষ্য দেবে। আমাদের রাজনীতিকেরা তা আমলে নেবেন কি না, সেটাই প্রশ্ন।
পাকিস্তান জামায়াত বাংলাদেশে তাদের সতীর্থদের রক্ষায় বিরাট তৎপরতা শুরু করেছে। এর মধ্যে আমরা একটা অভিনব ঘটনারও সাক্ষী হলাম। ১২ মার্চ (২০১৩) পাকিস্তান জামায়াতের ওয়েবসাইটে দেওয়া একটি খবরের প্রিন্ট নিই। কদিন পরে দেখি, সেটা সরিয়ে ফেলা হয়েছে। কোনো ঘোষণা চোখে পড়ল না। ওই খবরের শিরোনাম: ‘বাংলাদেশে সরকার ও আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। জামায়াতের আমির সৈয়দ মুনওয়ার হাসান পাকিস্তানের সশস্ত্র বাহিনীকে তাগিদ এবং পিপিপি সরকারকে সতর্ক করে দিতে করাচিতে সমাবেশ করেছেন। মিথ্যা মামলা তুলে না নিলে বিশ্বের দেশে দেশে “বাংলাদেশের দূতাবাস” অবরোধ করার হুমকি দিয়েছে জামায়াত। আমিরের দাবি, তুরস্ক, মিসর, তিউনিস ও অন্যান্য দেশের সরকার শেখ হাসিনা সরকারের “বর্বরতা” বিবেচনায় নিয়েছে।’
নওয়াজ শরিফের মুসলিম লীগ পাকিস্তানের প্রধান বিরোধী দল। তাদের নেতা সালিম জিয়া এর প্রতিবাদ হিসেবে ঢাকার পাকিস্তান হাইকমিশনারকে প্রত্যাহারই কেবল নয়, তিনি বাংলাদেশের ঘটনায় ‘পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীকে হস্তক্ষেপ’ করতে আহ্বান জানান। জামায়াতের ওয়েবসাইটে এই খবরটি এখন দেখা যাচ্ছে না। সেখানে আরও দুটি খবর আছে। লাহোরের জামায়াত জাতিসংঘের হস্তক্ষেপ চেয়েছে। তারা সেখানে আইনজীবীদের নিয়ে একটি সেমিনারও করেছে। পাকিস্তানের সুপ্রিম কোর্ট বারের সম্পাদক রাজা জাভেদ ইকবাল বেগম খালেদা জিয়ার সুরেই ‘গণহত্যা’ বন্ধে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানান। এতে পিপিপির এক নেতাও বক্তব্য দেন।
মতিউর রহমান নিজামী যেভাবে তালাবার প্রধান থেকে জামায়াতের আমির হয়েছেন, সেভাবে তালাবার প্রধান থেকে সৈয়দ মুনওয়ারও পাকিস্তান জামায়াতের আমির হয়েছেন।
ইসলামি জমিয়ত-ই-তালাবা পাকিস্তানের ওয়েবসাইটে গিয়ে আমরা বিস্মিত। আশা করব, জামায়াত-শিবিরের নিরীহ দেশভক্ত নতুন প্রজন্ম পাকিস্তানি তালাবা ও তার সঙ্গে জামায়াত-শিবিরের সম্পর্কের বাস্তব ইতিহাসকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নেবে। তাদের অভিযুক্ত ও সন্দেহভাজন নেতাদের কাছে ব্যাখ্যা চাইবে।
২৫ মার্চ গণহত্যা চালিয়ে বাঙালির আকাঙ্ক্ষা চিরতরে স্তব্ধ করে দেওয়ার জন্য বেসামরিক ফ্রন্ট গঠনের প্রস্তুতির অংশ হিসেবেই কি একাত্তরের জানুয়ারিতে ইডেন হোটেলে মতিউর রহমান নিজামী নেতা নির্বাচিত হয়েছিলেন?
আমরা তালাবার আত্মস্বীকৃত ইতিহাস শুনব। তারা তাদের ওয়েবসাইটে লিখেছে: ‘১৯৫০ সালে পূর্ব পাকিস্তানে তালাবার কার্যক্রম শুরু হয়। ১৯৭১ সালের ২৯-৩১ জানুয়ারি ঢাকার ইডেন হোটেলে বার্ষিক কনভেনশন অনুষ্ঠিত হয়। অংশগ্রহণকারীর সংখ্যা ছিল ১২১। এতে মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী নাজিম-ই-আলা পুনর্নির্বাচিত [’৬৯-এ প্রথমবার] হন। ১ থেকে ৩ অক্টোবর [বাংলাদেশে যখন মুক্তিযুদ্ধ চলছে] মুলতানে তালাবার ২০তম কনভেনশন হয়। এতে ২৫১ জন অংশ নেন। পূর্ব পাকিস্তানি সদস্য ছিল ১৩৪। সংগঠনের ১১টি ব্রাঞ্চ ও ৬৭১টি ইউনিট সক্রিয় ছিল পূর্ব পাকিস্তানে। ভারতীয় আক্রমণকারী শক্তির সহায়তায় পূর্ব পাকিস্তানি জাতীয়তাবাদীরা ‘‘বাংলাদেশ’’ নামে একটি নতুন দেশ পেয়েছে। পাকসেনারা ১৬ ডিসেম্বর আত্মসমর্পণ করে। কর্মীরা সংকটাপন্ন হয়ে পড়ে। কারণ জাতীয়তাবাদীরা সপরিবারে তাদের হত্যা করে এবং তাদের বাড়িতে আগুন দেয়। অনেককে নির্মম নির্যাতন সইতে হয়।’
জামায়াত আমাদের বলতে চায়, তারা রাজনৈতিকভাবে পাকিস্তান ভাঙার বিরোধিতা করেছে। এটা তাদের গণতান্ত্রিক অধিকার। কিন্তু তালাবা কী সাক্ষ্য দিচ্ছে?
পাকিস্তানে তালাবা আজও বাংলাদেশ মানেনি। তারা তাদের ওয়েবসাইটে বলছে, ‘১৯৭২ সালে তারা “বাংলাদেশ গ্রহণযোগ্য নয়” আন্দোলন শুরু করে। ১৯৮৩, ’৮৫, ’৮৭, ’৯০ ও ’৯৪তে তালাবার সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক ঢাকায় ছাত্রশিবিরের কনভেনশনে যোগ দিয়েছেন।’ শিবির ও তালাবার লোগোর মিলও দেখার মতো। হালকা নীলের ওপর সাদা চাঁদ ও লালের ব্যবহার। এই মিল কি কাকতালীয়?
তিয়াত্তরের জুলাইয়ে লাহোরে জামায়াত ১৪৪ ধারা ভেঙে বাংলাদেশকে স্বীকৃতির বিরুদ্ধে বিক্ষোভ দেখায়। ১৯৭৩ সালের ২২ জুন লাহোর থেকে ওয়াশিংটনে পাঠানো এক তারবার্তায় মার্কিন দূতাবাস বলেছে, বাংলাদেশকে স্বীকৃতির বিরোধিতায় সবচেয়ে এগিয়ে জামায়াত। ১৯৭৩ সালের ১০ ডিসেম্বর পাঠানো অপর এক তারবার্তায় মার্কিন কূটনীতিক জর্জ গ্রিফিন বলেন, বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম দেশকে বাদ দিয়ে ইসলামি শীর্ষ সম্মেলন করতে ভুট্টো বিপাকে পড়েন। তিনি প্রথমে চেয়েছিলেন ‘পূর্ব পাকিস্তানের নেতৃবৃন্দ’ হিসেবে মুজিবকে আমন্ত্রণ জানাতে। পরে ভাবেন, এটা মুজিবকে আহত করবে। তাই তিনি বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতে উদ্যোগী হন। কিন্তু মুজিবকে আমন্ত্রণ ও স্বীকৃতি প্রদান- দুটিরই চরম বিরোধিতার সিদ্ধান্ত নেয় জামায়াত।’
উল্লেখ্য, চুয়াত্তরের এপ্রিলে পাকিস্তান সংবিধান থেকে ‘পূর্ব পাকিস্তান’ বিলোপের দুই মাস পর বাংলাদেশে গোলাম আযমসহ ৩৮ জনের নাগরিকত্ব বাতিল হয়।
১৯৯৩ সালের জুনে গোলাম আযম সুপ্রিম কোর্টে নাগরিকত্ব মামলায় জিতেছিলেন। পরদিন তিনি স্বাধীন বাংলাদেশে তাঁর প্রথম জনসভায় বলেন, ‘অতীতে আমার কোনো ভুল হয়ে থাকলে সে জন্য আমি দুঃখিত।’ শুরুতে উল্লিখিত বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টে বেগম খালেদা জিয়া সরকারের দেওয়া হলফনামায় বলা আছে, গোলাম আযম ১৯৭২ সালে লাহোরে ‘পূর্ব পাকিস্তান পুনরুদ্ধার কমিটি’ সংগঠিত করেন। একই বছর রিয়াদে ইসলামি যুব সম্মেলনে পূর্ব পাকিস্তান মুক্তি সংগ্রামের ডাক দেন এবং ১৯৭৩ সালে বেনগাজিতে ওআইসি পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের সম্মেলনে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি না দেওয়ার অনুরোধ জানান। একই অনুরোধ নিয়ে সৌদি বাদশার কাছে তিনি ১৯৭৩ থেকে ৭৬ সালের মধ্যে সাতবার সাক্ষাৎ দেন।’
বেগম খালেদা জিয়া সরকারের তথ্য এবং তালাবার তথ্য কিন্তু মিলে যাচ্ছে। গোলাম আযমের আইনজীবীদের দাবি ছিল, একাত্তরের ডিসেম্বর থেকে বাহাত্তরের ডিসেম্বর পর্যন্ত পাকিস্তানে তিনি তাঁর ইচ্ছার বিরুদ্ধে অবস্থান করেছিলেন। তাঁর বিরুদ্ধে বিএনপি সরকারের আনা বাংলাদেশবিরোধী অপতৎপরতার সব বিবরণই মিথ্যা!
এখন আমরা পাকিস্তানি তালাবা ও শিবিরের রাষ্ট্রদ্রোহমূলক যোগসাজশের আমলযোগ্য দালিলিক প্রমাণ পাচ্ছি। বিএনপি সরকারের অ্যাটর্নি জেনারেল আামিনুল হক শেখ মুজিব সরকারের দ্বারা গোলাম আযমের নাগরিকত্ব বাতিলকে সমর্থন করেছিলেন। সেই অবস্থানের সঙ্গে বেগম খালেদা জিয়ার অবস্থান মেলে না। বেগম জিয়ার সরকার সুপ্রিম কোর্টে সাক্ষ্য দিয়েছে, ‘বাংলাদেশবিরোধী অপতৎপরতার কারণেই ১৯৭৩ সালের ১৮ এপ্রিল গোলাম আযমের নাগরিকত্ব বাতিল করা হয়। ১৯৭৭ সালের ১১ জানুয়ারি গোলাম আযম পাকিস্তানি পাসপোর্ট নিয়ে বাংলাদেশে ঢুকেছিলেন।’ রাজনৈতিক খেলার কারণে আজ দুই বড় দলের পাল্টাপাল্টি অবস্থান হতে পারে, কিন্তু তাই বলে সাক্ষ্য-প্রমাণ তো উল্টে যেতে পারে না।
বিএনপি রাষ্ট্রদ্রোহের অপরাধে জামায়াতের বিচার করেনি। আওয়ামী লীগও করেনি। অথচ সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়েই এর আগের সরকারেই তারা তা করতে পারত। বিএনপি পারলে ঘোষণা দিক, তারা সরকারে গেলে তাদের নিজেদের জবানবন্দির ভিত্তিতেই জামায়াতের প্রমাণিত রাষ্ট্রদ্রোহের বিচার করবে। জামায়াতের বিরুদ্ধে তারা মিথ্যা অভিযোগ আনলে তারও ব্যাখ্যা দিক।
আমরা স্মরণ করব যে, জিয়াউর রহমান গোলাম আযমকে বাংলাদেশে ঢুকতে দিয়েছেন। কিন্তু তিনি তাঁকে নাগরিকত্ব দেননি। খেলেছেন। এই সিদ্ধান্ত ১৪ বছর ধরে ঝুলেছে। জিয়া নন, এরশাদ নন, এমনকি বেগম জিয়াও দেননি। মানি লোকদের মান বজায় থেকেছে। শেষ পর্যন্ত সুপ্রিম কোর্ট আমাদের পলায়নপর রাজনীতিকদের বাঁচিয়ে দিয়েছেন। কাউকে বদনাম নিতে হয়নি। ‘ন্যায়বিচার’ সুরাহা দিয়েছে। রাজনীতির বন্দুক আদালতের কাঁধে রেখে গুলি ছুড়েছে এবং তা ছিল লক্ষ্যভেদী। এই তো আমাদের ইতিহাস। (প্রথম প্রকাশ: ২২ মার্চ, ২০১৩)