ঢাকা মঙ্গলবার, ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪ , ১ আশ্বিন ১৪৩১ আর্কাইভস ই পেপার

nogod
nogod
bkash
bkash
uttoron
uttoron
Rocket
Rocket
nogod
nogod
bkash
bkash

দলদাস শিক্ষকের অপকর্মের ফল অন্যদেরও ভোগ করতে হচ্ছে

মতামত

আমাদের বার্তা ডেস্ক 

প্রকাশিত: ১০:৪১, ৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪

সর্বশেষ

দলদাস শিক্ষকের অপকর্মের ফল অন্যদেরও ভোগ করতে হচ্ছে

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-আন্দোলন সরকারি চাকরিতে কোটা ব্যবস্থার যৌক্তিক সংস্কারের দাবিতে আন্দোলন শুরু করলেও সরকারের একগুঁয়েমি, স্বৈরতান্ত্রিক মানসিকতা, দমননীতি এবং ছাত্র-জনতাকে নির্মমভাবে হত্যা দেশের জনগণ ছাত্রদের পাশে দাঁড়াতে প্রেরণা জুগিয়েছে। দমননীতি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আন্দোলনে জনগণের সম্পৃক্ততাও বৃদ্ধি পাচ্ছিল। বিশেষ করে রংপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবু সাঈদকে একেবারে কাছে থেকে পুলিশ গুলি করে হত্যা করলে কোটা আন্দোলন ভিন্নমাত্রা লাভ করে। ফলে একপর্যায়ে আন্দোলনটি সরকার পতনের একদফা আন্দোলনে রূপ লাভ করে। রোববার (৮ সেপ্টেম্বর) দৈনিক যুগান্তর পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়।

নিবন্ধে আরো জানা যায়, ছাত্র আন্দোলনে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ সম্পৃক্ত হলেও ছাত্ররাই ছিল এ আন্দোলনের মূল চালিকাশক্তি। শিক্ষক, আইনজীবী, চিকিৎসক, সংস্কৃতিকর্মী, বিরোধী রাজনৈতিক দলসহ সাধারণ মানুষ ছাত্র-জনতার হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে একপর্যায়ে রাস্তায় নেমে আসে। এ আন্দোলনে আহত-নিহতের তালিকায় সাধারণ মানুষের সংখ্যাও কম ছিল না। কিন্তু এরপরও ছাত্ররাই মূলত জীবনের ঝুঁকি নিয়েছিল, নির্যাতন সহ্য করেছে এবং রক্ত দিয়েছে। ছাত্রদের অহিংস আন্দোলন সরকারের দমননীতির কারণে গণঅভ্যুত্থানে পরিণত হয়। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের ফলে সরকারপ্রধান দেশ ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন। সরকারের মন্ত্রী-এমপি এবং সরকার সমর্থক নেতানেত্রীরা আত্মগোপনে চলে যান। নোবেলবিজয়ী অধ্যাপক ড. ইউনূসের নেতৃত্বে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হয়।

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মূল দার্শনিক ভিত্তি ছিল সমাজ থেকে সব ধরনের বৈষম্য দূর করা; গণতন্ত্র, মানবাধিকার, সামাজিক সাম্য এবং সামাজিক ন্যায়বিচার-এ মূলনীতির আলোকে একটি নতুন সমাজ প্রতিষ্ঠা করা। যেহেতু তরুণরা নেতৃত্বে ছিলেন, তাই তাদের কাছে জনগণের প্রত্যাশাও অনেক বেশি। সবাই আশা করছেন, একটি নতুন বাংলাদেশ বিনির্মিত হবে, যেখানে কেউ নিগৃহীত, লাঞ্ছিত, অপমানিত ও বৈষম্যের শিকার হবে না। বরং একটি স্বাধীন-সার্বভৌম দেশের নাগরিক হিসাবে যোগ্যতা অনুযায়ী সবাই ন্যায্য সুযোগ-সুবিধা পাবে।

স্বাধীনতার অর্ধশতাব্দীরও বেশি সময় পর মানুষ স্বাধীনতার স্বাদ পেয়েছে বলে উল্লসিত হয়েছে। বিশেষ করে বিগত ১৫ বছর গণতান্ত্রিক সংস্কৃতিকে অবদমিত করা, আইনের শাসন না থাকা, নিজের ইচ্ছামতো আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে ব্যবহার করা এবং শক্তি প্রয়োগ করে ভিন্নমতকে অবদমিত করার প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকায় বিভিন্ন সেক্টরে অনিয়ম, দুর্নীতি, লুটতরাজ প্রভৃতি মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। অনিয়মই যেন নিয়মে পরিণত হয়। রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের ফলে রাজনৈতিক নেতা আর প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের মধ্যে পার্থক্য নিরূপণ করা অনেক ক্ষেত্রেই কষ্টকর ছিল। সংসদ সদস্যরা নিজ নিজ নির্বাচনি এলাকায় ত্রাসের রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নিয়োগ বাণিজ্য একটি স্বাভাবিক বিষয়ে পরিণত হয়েছিল। দলীয় আনুগত্যের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে না পারলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধান হিসাবে নিয়োগ পাওয়া কঠিন ছিল। আমার নিজ এলাকায় দেখেছি একটি প্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষ পদে নিয়োগ লাভের জন্য জামায়াতের একজন রুকন আওয়ামী এমপির হাতে ফুল দিয়ে আওয়ামী লীগে যোগ দিয়েছিলেন। প্রতিষ্ঠানটির গভর্নিংবডির সদ্য আওয়ামী লীগে যোগ দেওয়া সাবেক জামায়াত নেতাকে অধ্যক্ষ পদে নিয়োগ দিয়েছিল। যদিও তিনি ওই পদের জন্য অযোগ্য ছিলেন না এবং নিয়োগ লাভের পর দক্ষতার সঙ্গেই দায়িত্ব পালন করেছিলেন। আওয়ামী রাজনীতিতে সক্রিয় না হলে এমপিওভুক্ত স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসায় প্রধান হিসাবে নিয়োগ পাওয়া দুরূহ ছিল। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পরিচালনা পরিষদে স্থানীয় সংসদ-সদস্য ও রাজনৈতিক চাটুকারদের অন্তর্ভুক্তির সুযোগ সৃষ্টি করায় অনেক শিক্ষককে রাজনীতির নোংরা ক্রীড়নকে পরিণত হতে হয়েছিল।

বিগত সরকারের সময় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে নৈরাজ্য ছিল, এটি অস্বীকার করা যাবে না। এছাড়া নিয়োগ বাণিজ্য, লুটপাট, অনিয়মও হয়েছে। অনেক প্রতিষ্ঠানের প্রধান শিক্ষক এবং তাদের সহযোগী দু-একজন শিক্ষক, কমিটির সদস্য এবং রাজনৈতিক নেতৃত্ব মিলে একটা সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছিল। এছাড়া অনেক শিক্ষকের বিরুদ্ধে কোচিং বাণিজ্য, যৌন হয়রানি, ক্লাস ফাঁকি দেওয়াসহ নানাবিধ অপকর্মে জড়িত থাকার অভিযোগও আছে। প্রাইভেট না পড়লে পরীক্ষায় নম্বর কমিয়ে দেওয়া, এমনকি ব্যবহারিক পরীক্ষায় ফেল করিয়ে দেওয়ার হুমকিও কেউ কেউ দিয়েছেন। অনেক শিক্ষক আওয়ামী সংসদ-সদস্যের সঙ্গে বিশেষ সম্পর্কের সুবাদে রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে এসব অপকর্ম করেছেন। এমনকি একইসঙ্গে একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক, যুবলীগের উপজেলা আহ্বায়ক এবং ইউপির নির্বাচিত চেয়ারম্যান হিসাবে দায়িত্ব পালনের নজিরও আছে।

শিক্ষক হলেই অপরাধ করে পার পেয়ে যাবেন, এটি কখনো হওয়া উচিত নয়। বরং শিক্ষকতা পেশায় থেকে যারা বিভিন্ন অনিয়ম-অপকর্মে জড়িত হবেন, তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তিই হওয়া উচিত। এখন প্রশ্ন হলো, এ বিচারটা কে করবেন? সারা দেশে শিক্ষার্থীরা যেভাবে প্রতিষ্ঠানপ্রধানদের পদত্যাগের জন্য আন্দোলনে নেমেছেন, অপমানিত ও লাঞ্ছিত করছেন, পদত্যাগে বাধ্য করছেন, এটি কোনো সভ্য সমাজে প্রত্যাশিত নয়। একজন বয়স্ক শিক্ষককে স্কুলের শিক্ষার্থীরা যেভাবে টেনেহিঁচড়ে চেয়ার থেকে নামতে বাধ্য করেছেন, তা সবার জন্যই লজ্জাজনক। একটি অন্যায় দিয়ে আরেকটি অন্যায়ের বিচার করা যায় না। কাউকে অপমানিত করা আর অপরাধের বিচার করা এক বিষয় নয়। কেউ অপরাধ করে থাকলে যথাযথ আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তার বিচার করতে হবে। যেসব শিক্ষকের বিরুদ্ধে আন্দোলন করা হচ্ছে, তারা সত্যিকার অর্থেই অপরাধী কিনা, সেটাও আগে তদন্ত করা উচিত। বিদ্যমান অস্থিরতার সুযোগে কেউ যাতে ব্যক্তিগত শত্রুতার প্রতিশোধ নিতে না পারেন, সেটা কীভাবে নিশ্চিত করবেন? বরং নিরপেক্ষভাবে অনুসন্ধান করলে দেখা যাবে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অন্য কোনো শিক্ষক ব্যক্তিস্বার্থ হাসিলের জন্য বিদ্যমান সুযোগকে কাজে লাগাচ্ছেন। শুধু দুর্নীতিবাজ ও দলীয় লেজুড়বৃত্তিতে জড়িত শিক্ষকরাই লাঞ্ছিত হচ্ছেন, কোনো আদর্শ শিক্ষক লাঞ্ছিত হচ্ছেন না-এ ধরনের বয়ান যারা দিচ্ছেন, তারা বাস্তব অবস্থা সম্পর্কে না জেনেই এসব বলছেন। আদর্শ ও নীতিবান শিক্ষকও অনেক জায়গায় স্বার্থান্বেষীদের ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে অপদস্থ হবেন না এ নিশ্চয়তা কে দেবে? তাছাড়া অনিয়ম-দুর্নীতিতে জড়িত শিক্ষককে ছাত্ররাই যদি বিচারের আগে শাস্তি দেয়, তাহলে দেশে আইন-আদালত থাকার প্রয়োজনীয়তা কতটুক? স্বৈরাচারী ও ফ্যাসিবাদী শাসনের সঙ্গে নতুন বাংলাদেশের পার্থক্য কীভাবে নির্ণীত হবে?

মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের যেসব অনিয়ম ও অপকর্মের জন্য লাঞ্ছিত ও অপমানিত করা হচ্ছে, এর চেয়ে হাজারগুণ বেশি অনিয়ম দেশের অন্য সেক্টরে হয়েছে। এমপিওভুক্ত শিক্ষকরা তো প্রচলিত আইন অনুযায়ী রাজনীতি করতে পারেন। কিন্তু সরকারি কর্মচারীদের রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতার সুযোগ না থাকলেও বিগত বছরগুলোতে অনেককেই রাজনৈতিক কর্মীর ভূমিকায় দেখা গেছে। দু-একজন ডিসি এবং কতিপয় পুলিশ কর্মকর্তার রাজনৈতিক প্রচারণার সংবাদ তো পত্রিকাগুলোতে এসেছিল। এছাড়া রাতের ভোটের আয়োজনে যেসব জেলা প্রশাসক ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রিটার্নিং অফিসারের দায়িত্ব পালন করেছিলেন, তারা কি স্বৈরাচারের সহযোগী ছিলেন না? এখন ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনের সময় ১২৮ জন ডিসি এবং সহস্রাধিক উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার পদত্যাগ নিয়ে তো কথা বলা সম্ভব হচ্ছে না। পরিবর্তিত রাজনৈতিক বাস্তবতায় নতুন বাংলাদেশ গড়ার অদম্য ইচ্ছা তরুণদের সমাজের দুর্বলতম পেশায় নিয়োজিত শিক্ষকদের ব্যাপারে উৎসাহিত করেছে। এমপিওভুক্ত স্কুল-কলেজের কতিপয় স্বার্থান্বেষী ও দলদাস শিক্ষকের অপকর্মের ফলাফল অন্যদেরও ভোগ করতে হচ্ছে।

শিক্ষক হোন বা অন্য যে কোনো পেশার লোকই হোন না কেন, অপরাধ করলে তার শাস্তি অবশ্যই নিশ্চিত করা জরুরি। আগে শাস্তি হয়নি বলে এখন শাস্তি দেওয়া যাবে না, এ যুক্তিও গ্রহণযোগ্য নয়। অতীতে বাংলাদেশে আইনের শাসন না থাকায় অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড জ্যামিতিক হারে বৃদ্ধি পাওয়ার প্রবণতা আমরা দেখেছি। আইনের যথাযথ বাস্তবায়ন হলে সমাজ থেকে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড কমে আসতে বাধ্য। তাই আমরা মনে করি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের মাধ্যমে শিক্ষকদের অপদস্থ করার প্রবণতা অবিলম্বে বন্ধ করতে হবে। শিক্ষার্থীদের যৌক্তিক দাবি শুনুন। অভিযোগগুলো আমলে নিন। নিরপেক্ষভাবে তদন্ত করুন। তদন্তে যেসব শিক্ষক দোষী সাব্যস্ত হবেন, তাদের প্রচলিত আইনে কঠোর শাস্তি দিন। কিন্তু এখন যেভাবে বিচারের আগেই শাস্তি দেওয়া হচ্ছে, সেটা বন্ধ করুন।

লেখক: ড. মো. আবদুল জলিল, অধ্যাপক, সমাজকর্ম বিভাগ, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট

জনপ্রিয়