ঢাকা রোববার, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪ , ৭ পৌষ ১৪৩১ আর্কাইভস ই পেপার

bkash
bkash
udvash
udvash
uttoron
uttoron
Rocket
Rocket
bkash
bkash
udvash
udvash

অগ্রসর সমাজ তৈরির লক্ষ্যই বাষট্টির শিক্ষা আন্দোলন

মতামত

মাছুম বিল্লাহ

প্রকাশিত: ০০:৫০, ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪

সর্বশেষ

অগ্রসর সমাজ তৈরির লক্ষ্যই বাষট্টির শিক্ষা আন্দোলন

‘মহান শিক্ষা দিবস’ ১৭ সেপ্টেম্বর। ১৯৬২ খ্রিষ্টাব্দে তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের গণবিরোধী, শিক্ষা সংকোচনমূলক শিক্ষানীতি চাপিয়ে দেয়ার প্রতিবাদ ও একটি গণমুখী শিক্ষানীতি প্রবর্তনের দাবিতে ছাত্র-জনতার ব্যাপক আন্দোলনের একটি রক্তাক্ত স্মৃতিবিজড়িত দিন ১৭ সেপ্টেম্বর। এর সূচনা হয়েছিলো অবৈতনিক প্রাথমিক শিক্ষা, গণমুখী শিক্ষা প্রসার, শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণ ও শিক্ষাক্ষেত্রে বৈষম্য বঞ্চনা নিরসন তথা সংখ্যাগরিষ্ট জনগনের স্বার্থ সংরক্ষনের লক্ষ্যে। বাষট্টির শিক্ষা আন্দোলনের এবার ৬২ বছর চলছে। স্বভাবতই মনে প্রশ্ন জাগে, স্বাধীন বাংলাদেশে উপরোক্ত বিষয়গুলোর কতোটা শান্তিপূর্ণ সমাধান হয়েছে অর্থাৎ শিক্ষা ক্ষেত্রে জনমানুষের দাবি ও অধিকার কতটা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণ, বৈষম্য ও মানের দিক থেকে আমরা কোথায় অবস্থান করছি। আজকের দিনটি কিন্তু সেই হিসাব-নিকাশ করার দিন।

আমরা জানি ১৯৫৮ খ্রিষ্টাব্দে আইয়ুব খান পাকিস্তানে সামরিক শাসন জারি করেন। সামরিক শাসন জারির দুই মাস পরেই ৩০ ডিসেম্বর একটি শিক্ষা কমিশন গঠন করেন যা শরীফ কমিশন নামে খ্যাত। এস এম শরীফের নেতৃত্বে গঠিত এই কমিশন ১৯৫৯ খ্রিষ্টাব্দের ২৬ আগস্ট তাদের প্রতিবেদন পেশ করে যার মূল বিষয় তৎকালীন সচেতন ছাত্রসমাজের কাছে ‘শিক্ষা সংকোচন’ নীতি বলে প্রতীয়মান হয়। ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায় যেকোনো কর্তৃত্ববাদী সরকারই প্রথমেই শিক্ষায় হাত দেন। তারা সকলেই শিক্ষাকে কেনো জানি খুব ভয় পান। তাই শিক্ষার গলা টিপে ধরার চেষ্টা করেন। আমাদের দেশে দেখলাম পতিত সরকার এসেই একটি কারিকুলাম বানালো, সেই ২০০৯ থেকে শুরু করে ২০১২ খ্রিষ্টাব্দে চালু করলো। সেই কারিকুলাম পুরোটা পরিবর্তন করে ২০১৭ খ্রিষ্টাব্দ থেকে আবার শুরু করলো

অভিজ্ঞতাভিত্তিক কারিকুলাম’ যা ২০২২এ চালু হওয়ার কথা ছিলো কিন্তু কোভিডের কারণে সেটি চালু করা হলো ২০২৩ খ্রিষ্টাব্দে। সেই কারিকুলামের বাহ্যিক উদ্দেশে, বুলি এবং ভাবসাব এমনভাবে দেখানো শুরু হলো, এটি পৃথিবীর সেরা কারিকুলাম। আসলে সেটি ছিলো পুরো জাতি ধ্বংসের কারিকুলাম। কোনো শিক্ষার্থী কোনো বিষয়ই শিখবে না। শুধুমাত্র বিদ্যালয়ে আসা যাওয়া করবে কিংবা আসবেই না। আর কিছু স্কিল কেউ কেউ হয়তো অর্জন  করবে যা মানুষ সামাজিকভাবে এমনিতেই শিখে যায়। বিশ্লেষণ করে দেখা যায় যে, শিক্ষিত হলে মানুষকে বশ করা মুশকিল। তাই অধীন করে রাখার একটি প্রচেষ্টা যা আইয়ুব সরকারও বাদ দেয়নি। ২৭ অধ্যায়ে বিভক্ত শরীফ কমিশনের ওই প্রতিবেদন প্রাথমিক স্তর থেকে উচ্চতর স্তর পর্যন্ত সাধারণ পেশামূলক শিক্ষা, শিক্ষক প্রসঙ্গ, শিক্ষার মাধ্যম, পাঠ্যপুস্তক, হরফ সমস্যা, প্রশাসন, অর্থবরাদ্দ, শিক্ষার লক্ষ্য ও উদ্দেশে বিষয়ে বিস্তারিত সুপারিশ উপস্থাপন করে। আইয়ুব সরকার এই রিপোর্টের সুপারিশ গ্রহণ এবং তা ১৯৬২ খ্রিষ্টাব্দ থেকে বাস্তবায়ন করতে শুরু কর। আর তাতেই বাধে বিপত্তি। 

বিচিছন্নভাবে বিভিন্ন কলেজে এর বিরুদ্ধে আন্দোলন চলতে থাকে। প্রথমদিকে স্নাতক শ্রেণির শিক্ষার্থীদের লাগাতার ধর্মঘট এবং উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণির শিক্ষার্থীদের ইংরেজি ক্লাস বর্জনের মধ্যে এ আন্দোলন সীমাবদ্ধ ছিলো। জুলাইজুড়ে এভাবেই আন্দোলন চলে। ‘ডিগ্রি স্টুডেন্টস ফোরাম’ নামে সংগঠন পরে ‘ইস্ট পাকিস্তান স্টুডেন্টস ফোরাম’ নামে সংগঠিত হয়ে আন্দোলন চালাতে থাকে। তবে আন্দোলনে গুণগত পরিবর্তন আসে ১৯৬২ খ্রিষ্টাব্দের ১০ আগস্ট। এদিন বিকেলে ঢাকা কলেজ ক্যানটিনে স্নাতক ও উচ্চ মাধ্যমিক উভয় শ্রেণির শিক্ষর্থীরা এক সমাবেশে মিলিত হন। এ সভার আগ পর্যন্ত ছাত্র সংগঠনগুলোর কেন্দ্রীয় নেতাদের সঙ্গে কমিশনবিরোধী আন্দোলনের কোনো যোগসূত্র ছিলো না। কেন্দ্রীয় নেতারা মনে করতেন, শুধু শিক্ষার দাবি নিয়ে ব্যাপক আন্দোলন গড়ে তোলা অসম্ভব। তাই ১০ আগস্টের এই সভায় ১৫ আগস্ট সারা দেশে শিক্ষার্থীদের সাধারণ ধর্মঘট পালনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়, যা দেশব্যাপী ছাত্রসমাজের কাছে ব্যাপক সাড়া জাগায়। এরপর আন্দোলনের পরবর্তী কর্মসূচি হিসেবে ১০ সেপ্টেম্বর সচিবালয়ের সামনে শিক্ষার্থীদের অবস্থান ধর্মঘটের সিদ্ধান্ত হয়। পূর্ব পাকিস্তান সরকার ১৪৪ ধারা জারি করে এক প্রেসনোটে শিক্ষার্থীদের অবস্থান ধর্মঘট থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানায় এবং পরিস্থিতি মারাত্মক হবার হুমিক প্রদান করে। এ মতাবস্থায় ১০ সেপ্টেম্বর কর্মসূচি প্রত্যাহার করা হলেও শিক্ষার্থীরা ১৭ সেপ্টেম্বর হরতালের ডাক দেন। ব্যাপক প্রচারের সঙ্গে চলতে থাকে পথসভা, খন্ডমিছিল। ধীরে ধীরে অন্যান্য পেশাজীবীরাও যোগ দেন আন্দোলনে। হাজার হাজার মানুষ অংশ নেয়, সভা-সমাবেশ ও মিছিল বের করা হয়, পুলিশের লাঠিচার্জ, কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ আর গুলি বর্ষণ শুরু হয় যা যেকোনো স্বৈরাচারী সরকারের পূরানা খেলা। নিহত হন মোস্তফা, বাবুল, ওয়াজিউল্লাহ, আহত হন ৭৩ জন আহত ও ৫৯ জনকে গ্রেফতার করা হয়। সেই থেকে বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক ও ছাত্র সংগঠন প্রতি বছর এ দিনটিকে ‘মহান শিক্ষা দিবস’ হিসেবে পালন করে আসছে।

শরীফ কমিশনে পাঁচ বছরের প্রাথমিক শিক্ষা চালুর প্রস্তাব করা হয় যা এখনো বিদ্যমান। দুই বছরের ডিগ্রি কোর্সকে তিন বছর করার প্রস্তাব করা হয় আর স্নাতকোত্তর দুই বছরের। আমাদের স্নাতক কোর্স কিন্তু এখন তিন ও চার বছরের এবং বিশেষায়িতগুলো পাঁচ বছরের। পাবলিক পরীক্ষায় পাস নম্বর ধরা হয়েছিলো শতকরা ৫০, দ্বিতীয় বিভাগ শতকরা ৬০ এবং প্রথম বিভাগ শতকরা ৭০ নম্বর। প্রকৃত বিচারে এগুলো কোনোটিই কিন্তু সমালোচনার বিষয় না। কারণ, শিক্ষার মান ধরে রাখার জন্য এবং বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে শিক্ষাকে গ্রহণযোগ্য করার কথা চিন্তা করলে কিন্তু এগুলো সমালোচনার বিষয় হিসেবে আসে না। কিন্তু বিষয়টি হলো কোনো সরকারই যাদের জন্য শিক্ষানীতি, কারিকুলাম বা শিক্ষাব্যবস্থা তাদের কারোর সঙ্গেই কোনো ধরনের আলোচনা ছাড়াই নিজেদের গায়ের জোরে এসব করতে চান। জনগণকে উপেক্ষা করে সবাই কি যেনো করতে চান, যা হয় হিতে বিপরীত। এই কমিশন বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বায়ত্তশাসনের পরিবর্তে পূর্ণ সরকারি নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা, বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে রাজনীতি নিষিদ্ধ করা, ছাত্র-শিক্ষকদের কার্যকলাপের ওপর তীক্ষ্ণ নজর রাখার প্রস্তাব করা হয়। শিক্ষকদের কঠোর পরিশ্রম করাতে ১৫ ঘণ্টা কাজের বিধান রাখা হয়েছিলো। রিপোর্টের শেষ পর্যায়ে বর্ণমালা সংস্কারেরও প্রস্তাব ছিলো। মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা ক্ষেত্রে ছাত্র বেতন বর্ধিত করা এবং ইংরেজি শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করার প্রস্তাব ছিলো। ইংরেজি আমরা এখনো বাধ্যতামূলক বিষয় হিসেবে পড়ছি। অতএব শরীফ কমিশনের সবকিছুই যে প্রকৃত শিক্ষা সংকোচনমূলক ছিলো সেটি বলাও কঠিন। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসনের ওপর হাত দেয়া যেকোনো মুক্তমনের শিক্ষিত ব্যক্তি মেনে নেবেন না। এগুলোর সঙ্গে প্রশ্ন এসে যায়  আমাদের স্বাধীন দেশে বিশ্ববিদ্যালয় স্বায়ত্তশাসনের কী।

তাই শিক্ষাবিদদের মধ্যে কেউ কেউ বলছেন যে, শরীফ কমিশনের প্রতিবেদনে থাকা প্রস্তাব থেকে  আমাদের বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থার তেমন একটা তফাৎ নেই। ’৭৪ খ্রিষ্টাব্দের কুদরত-এ খুদা শিক্ষানীতির প্রায় ৬০-৭০ শতাংশ রেখেই একটি মোটামুটি প্রহণযোগ্য শিক্ষানীতি ২০১০ খ্রিষ্টাব্দে তৈরি করা হয়। কিন্তু সেটির মৌলিক দিক বাস্তবায়ন করা হয়নি। এ শিক্ষানীতিতে তিন স্তরের শিক্ষাব্যবস্থা প্রবর্তনের লক্ষ্যে ৮ বছরের প্রাথমিক শিক্ষা প্রস্তাব করা হয়। আর দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত ৪ বছরের মাধ্যমিক শিক্ষা। এরপর উচ্চশিক্ষা স্তর শুরু, বিদায় নেবে উচ্চ মাধ্যমিক। কিন্তু এতো বছরেও ওইসব প্রস্তাব পাশ হয়নি। এভাবে ২০১০ খ্রিষ্টাব্দের জাতীয় শিক্ষানীতিতে বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত আছে, কিন্তু বাস্তবায়ন হয়নি। শিক্ষানীতি উপেক্ষা করে ৫ম ও ৮ম শ্রেণি শেষে জাতীয়ভাবে পরীক্ষা নেয়া চলছিলো, যা বহু আলোচনা-সমালোচনার পর আপাতত বন্ধ আছে কিন্তু মানের দিক দিয়ে শ্রেণিগুলোর অবস্থা একেবারেই নাজুক। একজন শিক্ষার্থীর কাঙ্ক্ষিত দক্ষতা অর্জন থেকে প্রায় নব্বই শতাংশ শিক্ষার্থী অনেক দূরে অবস্থান করে যদিও তারা সবাই পাবলিক পরীক্ষায় পাস করে। জ্ঞাননির্ভর অগ্রসর চিন্তার সমাজ তৈরির লক্ষ্য ছিলো বাষট্টির শিক্ষা আন্দোলন। শরীফ কমিশনের শিক্ষানীতির লক্ষ্য ছিলো এলিট শ্রেণি তৈরি। আমরা দেখতে পাই, দেশে এখনো বিরাজ করছে বৈষম্যমূলক শিক্ষা এবং এই বৈষম্য কিছু কিছু ক্ষেত্রে তীব্র আকার ধারণ করেছে। বাষট্টির শিক্ষা আন্দোলন শিক্ষানীতি বিরোধী সংগ্রাম হলেও এর নেপথ্যে লুকিয়ে ছিলো ছাত্রসমাজের স্বাধিকার অর্জনের তীব্র বাসনা। এই আন্দোলনের পথ পরিক্রমায়ই এসেছে মহান একাত্তর তথা আমাদের বহুল প্রতীক্ষিত স্বাধীনতা। কিন্তু শিক্ষার কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে আমরা পৌঁছতে পেরেছি কি? সেই আলোচনাই হতে হবে। 
লেখক: ক্যাডেট কলেজের সাবেক শিক্ষক 

জনপ্রিয়