ঢাকা বৃহস্পতিবার, ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪ , ৩ আশ্বিন ১৪৩১ আর্কাইভস ই পেপার

nogod
nogod
bkash
bkash
uttoron
uttoron
Rocket
Rocket
nogod
nogod
bkash
bkash

প্রাথমিকের বৈষম্য দূর না হওয়ার বেদনা

মতামত

মো. সিদ্দিকুর রহমান, দৈনিক আমাদের বার্তা

প্রকাশিত: ০০:০০, ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪

সর্বশেষ

প্রাথমিকের বৈষম্য দূর না হওয়ার বেদনা

দীর্ঘ যুগের পর যুগ এক নিঃসন্তান দম্পতি সন্তানের আশায় নিদারুণ মনোকষ্ট ও বেদনার মাঝে দিন অতিবাহিত করে আসছেন। দুঃখ বেদনা প্রশমিত করার প্রয়াসে সন্তানের আশায় আরেকটা বিয়ে করে নিয়ে এলো এক নববধূকে। পরিবারে স্বামী, শাশুড়ি, দাদি শাশুড়ি, ননদ সবাই দীর্ঘ সময় পরিবারের উত্তরাধিকারী না পাওয়ার গ্লানি কারো যেনো ধৈর্য, সহ্য হচ্ছে না। সবাই যেনো তাৎক্ষণিক সন্তান পেতে চায়। যে পাওনটা তারা যুগের পর যুগ পায়নি, সে পাওনা সদ্য বিবাহিত দম্পতির কাছে তাৎক্ষণিক আশা করা যথাযথ নয়। পরিবারকে দেখভাল করার জন্য নিত্যদিনের সমস্যা যখন তখন করা যায়, সেগুলো অতি দ্রুত সমাধানের ওপর নববিবাহিত দম্পতিকে চাপ দেয়া যায়?

সদ্য দায়িত্বপ্রাপ্ত অন্তবর্তিকালীন সরকারকে প্রাথমিকের বৈষম্য তাৎক্ষণিক দূর করার প্রত্যাশা অনেকটা নবদম্পতির কাছে যথাযথ সময় অপেক্ষা করে সন্তান চাওয়ার মতো। তবে প্রাথমিকের বিশাল বৈষম্য দ্রুত দূর না হলে সরকারের বর্তমান বৈষম্যহীন নতুন বাংলাদেশের স্বপ্ন বাস্তবায়নে চ্যালেঞ্জ হবে।

কিছু কিছু সমস্যা রয়েছে যার সঙ্গে কোনো অর্থিক সংশ্লেষ নেই। অথচ সমস্যাগুলো দ্রুত সমাধানের মাধ্যমে প্রাথমিক শিক্ষার বিশাল মানউন্নয়ন তথা শিশুশিক্ষাবান্ধব প্রাথমিক শিক্ষা গড়ে উঠবে। প্রাথমিক শিক্ষার প্রধান বৈষম্য সব মন্ত্রণালয়ের মতো প্রাথমিক শিক্ষার নিজস্ব ক্যাডার সার্ভিস নেই, পদ মর্যাদা ও বেতন বৈষম্যে কলঙ্কিত প্রাথমিক শিক্ষক সমাজ, পদোন্নতির দরজা বন্ধ। বহিরাগত থেকে প্রধান শিক্ষক, কর্মকর্তা পদায়ন করে শিশুশিক্ষায় অনভিজ্ঞ, ট্রেনিং ও মেধাবী ব্যতিরেকে প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থাকে ঠেলে দেয়া হচ্ছে ধ্বংসের দিকে। এ প্রেক্ষিতে প্রাথমিকের কতিপয় বৈষম্য আলোকপাত করছি-এ বৈষম্যগুলো দূর করে অন্তবর্তিকালীন সরকার প্রাথমিক শিক্ষার উন্নয়নের রুদ্ধ গতি সঞ্চালনা করবেন বলে আশাবাদী।

স্বাধীনতার দীর্ঘ ৫২ বছর পরেও সকল মন্ত্রণালয়ে স্বতন্ত্র ক্যাডার সার্ভিস থাকলেও প্রাথমিকের মতো সবচেয়ে বড় ও গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের ক্যাডার সার্ভিস নেই। এ বৈষম্য স্বাধীন দেশের ও জাতির জন্য প্রত্যাশিত নয়। এ অভিশপ্ত কলঙ্ক মোচনে তৃণমূলের অভিজ্ঞতালব্দ, প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত, মেধাবী জনবলকে শতভাগ পদোন্নতি দিয়ে নিয়ে যেতে হবে, নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে। যাতে সচিব, ডিজিসহ নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের কর্মকর্তারা প্রাথামিক শিক্ষার জ্ঞানে ভরপুর থাকে। এ প্রেক্ষিতে সহকারী শিক্ষক পদকে এন্ট্রি হিসেবে গণ্য করতে হবে। এতে অভিজ্ঞতাসম্পন্ন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ও মেধাবী জনবলে সমৃদ্ধ হবে দেশের শিশুশিক্ষা। এ প্রেক্ষিতে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর নিয়োগবিধি-২০২৩ সংশোধন করে শিশু, শিক্ষক, কর্মচারীবান্ধব করা প্রয়োজন।

শিশুদের নিয়ে কর্মকাণ্ডে জড়িত শিক্ষক, অধিদপ্তর ও প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। অথচ শিশুবান্ধব সময়সূচি তথা শিশুর শারীরিক, মানসিক বিকাশ নিয়ে বেশির ভাগেরই চিন্তা দৃশ্যমান নয়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেখা যায়, দুপুরে বিদ্যালয় ছুটি শিক্ষকদের প্রত্যাশা। বাংলাদেশের বেশিরভাগ জনসাধারণ দুপুরে দুইটার মধ্যে মধ্যাহ্নভোজ করে থাকেন। শিশুর বিদ্যালয়ের দুপুর তিনটায় ছুটি হলে বাড়ি এসে খাবার খেতে সাড়ে তিনটা বেজে যাবে। খানিকটা বিশ্রাম নিয়ে ক্লান্ত শরীরে বিকালবেলা খেলাধুলা বা বিনোদন করার আগ্রহ হারিয়ে ফেলবে। অপরদিকে প্রাথমিকের মন্ত্রণালয়, মহাপরিচালকসহ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা প্রাথমিক বিদ্যালয় সরকারি প্রতিষ্ঠান বিধায় তাদের মতো কর্মঘণ্টা নির্ধারণ রাখতে চায়। শিশুদের পাঠদান কাঠিন্য ও একনাগাড়ে শিক্ষার্থী-শিক্ষকদের শ্রেণির কার্যক্রম ধারণ করার ক্ষমতা সম্পর্কে নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে উপলব্ধি নেই। শিশুদের দুপুর ২টার মধ্যে বিদ্যালয়ের কার্যক্রম শেষ করা উচিত। দুপুরে বাড়িতে এসে তারা গোসল সেরে গরম খাবার খাবে। তারপর খানিকটা বিশ্রাম বা ঘুমিয়ে বিকেল ৪টার পরে সুস্থ দেহ মন নিয়ে ফুরফুরে মেজাজে খেলাধুলা বা নানা ধরনের বিনোদনে অংশগ্রহণ করবে। বিদ্যালয়ের প্রতিটি পিরিয়ডের কার্যক্রম থাকা প্রয়োজন কমপক্ষে এক ঘণ্টা। দৈনিক চারটি পিরিয়ডের বেশি হওয়া কাম্য নয়। দৈনিক কমপক্ষে আধা ঘণ্টা বিনোদন সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড বা খেলাধুলার সুযোগ দেয়া প্রয়োজন। শিক্ষক কর্মকর্তাদের ভাবনায় থাকতে হবে শিশুদের সার্বিক সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করে বিদ্যালয়ের সময়সূচি শিশুবান্ধব করা।

সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কল্যাণ ট্রাস্ট বাংলাদেশ প্রাথমিক শিক্ষক সমিতি উদ্যোগে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি মরহুম হুসাইন মোহাম্মদ এরশাদের আমলে প্রতিষ্ঠিত। তখন শিক্ষক প্রতি এককালীন ২০ টাকা ও বাৎসরিক দুই টাকা চাঁদা ও সরকারি এককালীন অনুদানের নিয়ে চালু হয়। প্রাথমিক শিক্ষকদের পোষ্যদের লেখাপড়া চিকিৎসা ও বিশেষ দুর্যোগে সহযোগিতা ছিলো কল্যাণ ট্রাস্টের নিয়মিত কাজ। বর্তমানে প্রাথমিক বিদ্যালয় কল্যাণ ট্রাস্ট ২০২৩ খ্রিষ্টাব্দের ডিজি অফিসের কর্মকর্তাদের কল্যাণ ট্রাস্টে পরিণত হয়েছে। প্রাথমিক শিক্ষকদের বর্তমানে কল্যাণ ট্রাস্ট থেকে সব প্রকারের সহযোগিতা থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে। এ অবস্থায় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক কল্যাণ ট্রাস্ট এর আইনে ২০২৩ সংশোধন করে শিক্ষকবান্ধব করা জরুরি।

স্বাধীনতার দীর্ঘ ৫২ বছর পরেও মর্যাদা ও বেতন বৈষম্য বেড়াজালে অসহায়ত্বের মাঝে দিন কাটাচ্ছে প্রাথমিক শিক্ষক সমাজ। শিক্ষকেরা দেশের শিক্ষিত জনগোষ্ঠী তৈরির কারিগর। তারা সমাজকে আলোকিত করে জাতি তথা দেশকে সমৃদ্ধ করে থাকেন। অথচ তাদের মর্যাদা ও বেতন স্কেলে তৃতীয় শ্রেণির। শিক্ষকতা সর্বকালের সম্মানিত পেশা। তাদের মর্যাদা থাকার কথা প্রথম শ্রেণির। তারা রাষ্ট্রপতি, স্পিকার, প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী, আমলা এক কথায় শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর জন্মদাতা।

এতো আলোকিত মানুষ সৃষ্টির পরে তাদের কলঙ্কিত অবস্থান। দীর্ঘ সময় ধরে সমাজ ও দেশ বিদেশে প্রতিষ্ঠিত শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর নজর কাড়তে তারা ব্যর্থ হয়েছে। শিক্ষকদের সামান্য চাওয়া পাওয়া সংশ্লিষ্টদের যেনো গা জ্বালা দেখা যায়। এ নিয়ে নানা হুমকি, এমনকি শাস্তি ভোগ করতে দেখা গেছে। ২০০৫ খ্রিষ্টাব্দের বেতন বৈষম্য আন্দোলনে আমাকে হাজতে যেতে হয়েছিলো। অথচ ২০ বছর পরে আজও বেতন বৈষম্য দূর হয়নি। প্রাথমিক শিক্ষকদের বর্তমান প্রেক্ষাপটে যৌক্তিক চাওয়া অন্যান্য সরকারি কর্মচারীর মতে সমযোগ্যতা সম্পন্ন বেতন স্কেল। পিটিআই পরীক্ষণ বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মতো সমযোগ্যতা, একই পাঠক্রম অনুযায়ী পাঠদানে করা স্বত্বেও তাদের বেতন স্কেল বৈষম্য। বরং পরীক্ষণ বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের তুলনায় প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের কাজের ব্যাপকতা অনেক বেশি। তাদের চাওয়া পরীক্ষণ বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মতো সহকারী শিক্ষকদের দশম গ্রেড। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের বৈষম্য নিরসণে এ গড়িমসি এই দুঃখজনক।

১. প্রাথমিকের সহকারী শিক্ষক পদকে এন্ট্রি ধরে সর্বোচ্চ পর্যায়ে পর্যন্ত শতভাগ পদোন্নতি দেয়া। এর ফলে প্রাথমিক শিক্ষা প্রশাসন হয়ে উঠবে, অভিজ্ঞতা সম্পন্ন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত, মেধাবী জনগোষ্ঠীতে সমৃদ্ধ, এজন্য প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি ২০২৩ আমূল পরিবর্তন করা প্রয়োজন।

২. প্রাথমিক শিক্ষা স্বতন্ত্র ক্যাডার সার্ভিস সৃষ্টি করা হলে, মেধাবী জনগোষ্ঠীর অধিকতর প্রাথমিক শিক্ষায় আসবে। একদিকে সকল মন্ত্রণালয়ের মতো প্রাথমিক শিক্ষার ক্যাডার হলে বৈষম্য দূর হবে। অপরদিকে প্রাথমিক শিক্ষায় অনভিজ্ঞ নীতিনির্ধারণী ও কর্মকর্তা থেকে মুক্ত হবে।

৩. শিশুবান্ধব সময়সূচি দুপুর ২ টার মধ্যে বিদ্যালয়ের সকল কার্যক্রম সমাপ্ত করতে হবে।

৪. সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কল্যাণ ট্রাস্ট আইন ২০২৩ বাতিল পূর্বক শিক্ষকবান্ধব সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় আইন প্রণয়ন করতে হবে (১ থেকে ৪ নং সুপারিশ বাস্তবায়নে কোনো আর্থিক সংশ্লিষ্টতা নেই)।

৫. অন্যান্য সমযোগ্যতাসম্পন্ন সরকারি কর্মচারী ও পিটিআই পরীক্ষণ বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের ন্যায় সরকারি প্রাথমিক শিক্ষকদের দশম গ্রেডে প্রদান করা হোক।

বৈষম্য দূরীকরণে প্রত্যয় নিয়ে কাজ করছেন, বর্তমান অন্তবর্তিকালীন সরকার। শিক্ষকদের চাওয়া যৌক্তিক। তাদের যৌক্তিক প্রত্যাশা পূরণসহ প্রাথমিক শিক্ষার দীর্ঘ সময়ের বিরাজমান বৈষম্য দূর করার প্রত্যাশা রইলো।

লেখক: শিক্ষাবিদ

জনপ্রিয়