‘পরশ্রীকাতর’ বলে একটা শব্দ বাংলা ভাষাতেই একমাত্র পাওয়া যায়। ‘অপরের মঙ্গল দেখিয়া দু:খ হয়’- এমন মানব পৃথিবীর অন্য কোনো প্রান্তে নাই, ফলে এমন শব্দও তাদের ভান্ডারে নাই।
এই রোগের একটা ওষুধও বাঙালির শিশিতে আছে। তা হলো ‘পা টানিয়া নিচে নামানো’৷ প্রতিবেশী কেউ উর্দ্ধাকাশে ভ্রমণ বা খ্যাতির শিখরে যাচ্ছেন, তো বাঙালির কাজ হলো তাকে টেনে নামানো৷ দায়িত্ব হলো তাকে নিন্দে করে একেবারের ‘ছারখার’ করে দেওয়া।
এই যে ড. মুহাম্মদ ইউনুস সাহেব নোবেল পেলেন, এরপর কী হলো? সে তো সবাই জানেন৷ তাকে পানিতে চোবানোর কথা বলে নাজেহাল করে ছাড়া হলো।
এখন হচ্ছে সাকিব আল হাসানের বিরুদ্ধে৷ এই ছেলেটার ক্রিকেটে যা অর্জন তা পদ্মাপারের কোনো খেলোয়াড় এর আগে করতে পারেন নাই৷ তিনি অবসরও নিয়েছেন।
তবু আমাদের মহান দায়িত্ব তার নিন্দে করে শেষ করা৷ সম্প্রতি ফেসবুকে দেয়ালে দেখলাম একজন পোস্ট করেছেন, সাকিব যে একজন জুয়াড়ি তা কী কী উপায়ে তিনি প্রমাণ পেয়েছেন তা নিয়ে৷ [সাকিব আওয়ামী লীগের এমপি হওয়াই এই অসম্মানের কারণ নয়। এর আগেও এমন করা হয়েছে]
ভদ্রলোক লিখেই ক্ষান্ত হননি৷ ফেসবুককে ডলার দিয়ে নিজের খরচে এই ‘নিন্দে’ প্রচারও করছেন। ওয়াও!
গ্রামে দেখতাম রিকশা ভাড়া দিয়ে ‘ভাঙানি’ দেয়ার ঘটনা ঘটতো৷ ‘ভাঙানি’ জিনিসটা কী তা বলে নিই৷ গ্রামে সেটেলড ম্যারিজে পাত্র বা পাত্রী পক্ষ এসে গ্রামের লোকদের কাছে জানতে চান, পাত্রটা কেমন, স্বভাব কেমন, পরিবার কেমন ইত্যাদি৷ তখন কেউ মিথ্যা ‘ভাঙানি'ও দেন। বলেন, ছেলের বিছানায় হিস্যু করার রোগ আছে বা মেয়ের শ্বেতি রোগ আছে। ছেলের বাপ দুই বিয়ে করেছেন। ছেলের মা অন্য লোকের সাথে পালিয়ে গিয়েছিলেন। আকাশ কুসুম সব নিন্দে হয়! ব্যাস, বিয়ে গেলো ভেঙে৷ গ্রামে এর নাম হচ্ছে ‘ভাঙানি’।
কেউ আবার এমনিতেই বিয়ে ভেঙে দেয়ার কাজে মজা পান। দেখা গেলো, কোনো বিয়ে ভাঙতে পারলেন না, নিজের পকেটের টাকা খরচ করে রিকশা ভাড়া করে পাত্রের বাড়িতে গিয়েও অনেকে ভাঙানি দিয়ে আসেন।
বলেন, আহা আপনারা আমাদের আত্মীয়। না জেনে না বুঝে কি বিপদে পড়তে যাচ্ছেন তাই এলাম বলতে....
পাত্রের বাপ জিজ্ঞেস করেন, কী বিপদ?
- যেই মেয়েটাকে দেখতে গেছিলেন মাঘ মাসে মাথা পুরাই খারাপ থাকে? শিকল দিয়া বান্ধা থাকে? কি আর কমু ভাই৷ আল্লাহর দেয়ার রোগ?
- কি বলেন? মেয়েতো দেখলাম।
- এখন কি মাঘ মাস?
- না।
- এখন ভালোই দেখবেন। তয় আত্মীয়তা করতে পারেন। মেয়েটার মন ভালো। আমারে যতবার দেখে, চা খাওয়া ছাড়া আসতে দেয় না৷ সবই আল্লাহর ইচ্ছা ভাইজান৷ আত্মীয়তা করেন সওয়াব হবে!
পাত্রের বাপ অথৈ সাগরে পড়ে হাবুডুবু খান। হাত ধরে বলেন, বড় বাচানি বাছাইলেন ভাইসাব। বিয়ে ক্যান্সেল!
এভাবে গ্রামে বিয়ে ভাঙা একটা আনন্দদায়ক কাজ। এসব শুধু বাংলাতেই সম্ভব। বাংলাদেশেই সম্ভব।
পরশ্রীকাতরতার কারণ হতে পারে, আমরা সম্প্রদায়গতভাবে ভীষণ অসুখী, অসফল ও অসম্মানের জীবন বয়ে বেড়াই। কারো জীবনে সফলতা মানে ঐ একটা কেরানির চাকুরি পাওয়া, বা অমুক ভাই তমুক ভাইয়ের চামচামি করে গ্রামে একটি একতলা বাড়ির মালিক হওয়া৷ ব্যস এটুকুই।
আমরা মহৎ মানুষের দেখা পাই না। মহান হই না৷ আমাদের বাংলায় মহাপুরুষ আসেন নাই। আমরা নিজেরাই নিজেদের মনে মহাপুরুষ এর ইমেজ বানাই। নিজের মতো করে শ্রদ্ধা করি, মন চাইলে মহাপুরুষকে সকাল-সন্ধ্যা কাস্টমাইজ করে নিই।
আমাদের স্বগোত্রে সম্মানিত কেউ নাই৷ অন্তত আমরা মনে করি না, এমন আছেন কেউ৷ কেউ সম্মানিত হয়ে গেলেই আমরা ভয় পাই যে, তিনি আমাদের শ্রেণির দেয়াল ভেঙে দেবেন৷ কারণ আমরা জানি, আমরাই উলটো তার পা টেনে নিচে নামিয়ে আমাদের কাতারে বসিয়ে দেব। অপরকে অসম্মান করার তীব্র প্রতিভা আমাদের আছে৷
কৌতুক আছে, এই জন্য নরকে বাঙালিরা দেয়াল টপকে পালাচ্ছে কিনা তা দেখার কোনো গার্ড নেই। কেউ দেয়াল টপকাতে চাইলে অন্য বাঙালিরাই টেনে নামায়।