ঢাকা শুক্রবার, ১৮ অক্টোবর ২০২৪ , ২ কার্তিক ১৪৩১ আর্কাইভস ই পেপার

bkash
bkash
udvash
udvash
uttoron
uttoron
Rocket
Rocket
bkash
bkash
udvash
udvash

বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থা : তরুণ্যের দায় ও আমাদের করণীয়

মতামত

আবুল কালাম আজাদ

প্রকাশিত: ০০:০০, ১৮ অক্টোবর ২০২৪

সর্বশেষ

বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থা : তরুণ্যের দায় ও আমাদের করণীয়

শিক্ষার্থীরা বিদ্যালয়ের প্রাণ। তারা মাঠে হৈচৈ করবে, দৌড়াবে, খেলবে-তবেই না ভালো লাগে। শিক্ষার্থীর শোরগোলে মুখরিত থাকবে বিদ্যালয় প্রাঙ্গণ। শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের পড়াবেন, নতুন তত্ত্ব বুঝিয়ে দেবেন। তথ্য-উপস্থাপনা ও বাকমাধুর্যের দ্বারা শিক্ষার্থীদের বিশ্ব পরিভ্রমণ করাবেন। কোনো ভুল শুধরে দিতে প্রয়োজনে বকা দেবেন, শাসন করবেন। আবার প্রাণভরে আশির্বাদ করবেন- যেনো শিক্ষার্থীরা জীবনের প্রতিটি ধাপে উন্নতির চরম শিখরে উঠতে পারে। এমনই হওয়ার কথা ছিলো, এটাই আমাদের ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কের চিরায়াত রূপকথা। কিন্তু কোভিড-১৯ পরবর্তী প্রতিবাস্তবতা রূপকথার গল্পকে চুপকথায় পরিণত করে দিয়েছে। আমরা যেনো তখন ভিন গ্রহের কোনো বাসিন্দা। প্রতিটি দিন আমাদের খারাপ সময়ের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। বর্তমানে এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে রাজনৈতিক অস্থিরতা ও লাগামহীন দ্রব্যমূল্যের খড়গ। শুধু আমরা বললে ভুল বলা হবে, পৃথিবীর অধিকাংশ জনগোষ্ঠী আপদকালীন সময় অতিক্রম করে ঘুরে দাঁড়াতে চেষ্টা করছে। আমরাও সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছি অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে। তবে করোনা অতিমারি পরবর্তী গত চার বছরে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির স্বীকার হয়েছে আমাদের কোমলমতি শিক্ষার্থীরা। আমরা শিশুদের শিখন ঘাটতি পূরণের কার্যকর পদক্ষেপ না নিয়ে বরং অটোপাসে প্রমোশন দিয়ে ওপরের শ্রেণিতে উত্তীর্ণ করেছি। দায়মুক্তির নতুন শিক্ষা কারিকুলাম চাপিয়ে দিয়ে শিক্ষার্থীদের পড়ার টেবিল ছাড়া করেছি। দক্ষতাভিত্তিক মূল্যায়নের নামে পরীক্ষা তুলে নিয়ে আমরা তাদের প্রতিযোগিতার ক্ষেত্র থেকে বিচ্ছিন্ন করেছি। ২০১৯ খ্রিষ্টাব্দে বিশ্বব্যাংকের একটি জরিপে দেখা যায়, দেশের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে ৬৫ শতাংশ শিক্ষার্থী ঠিক মতো বাংলা পড়তে পারে না। 

সম্প্রতি একটি গবেষণামূলক প্রতিষ্ঠানের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয় যে, তৃতীয় শ্রেণির ৭৬ শতাংশ এবং চতুর্থ শ্রেণির ৭০ শতাংশ শিক্ষার্থী ঠিকমতো বাংলা পড়তে পারে না। তার ওপর অনলাইন ক্লাসের নামে অপ্রাপ্ত বয়স্ক, কৌতুহলী শিশুদের হাতে ইলেক্ট্রোনিক ডিভাইস তুলে দিয়ে যে ক্ষতি করা হয়েছে তার পরিমাপ নির্ণয় অসম্ভব। দীর্ঘক্ষণ ইলেক্ট্রোনিক ডিভাইস ব্যবহার করার ফলে শিশুদের নানা স্বাস্থ্য ঝুঁকি দেখা দিতে শুরু করেছে। ইলেক্ট্রোনিক ডিভাইসের আরো ভয়াবহ ক্ষতিকর প্রভাব রয়েছে। যেমন : স্মৃতি ও দৃষ্টিশক্তি লোপ পায়। শরীরে টিউমার হতে পারে। রেডিশনের প্রভাবে মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়। মেজাজ খিটখিটে হয়ে যায়। কানে হেডফোন ব্যবহার করলে শ্রবণশক্তি হ্রাস পায়। তাছাড়া ডিভাইস ব্যবহার এক ধরনের নেশায় পরিণত হয়। বিজ্ঞানী এপিজে আবুল কালামের একটা উক্তি আছে, ‘প্রযুক্তি হলো দুই দিকে ধারালো অস্ত্র। বামে গেলেও কাটবে , ডানে গেলেও কাটবে।’ 

সোশ্যাল মিডিয়াকে আসলে বিভিন্নভাবে সংজ্ঞায়িত করা যায়। বাংলায় একে বলা হয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম। যে ওয়েবসাইটের মাধ্যমে ব্যবহারকারী তাৎক্ষণিক বিভিন্ন কনটেন্ট শেয়ার করে অন্যদের সঙ্গে যোগাযোগ বা অনুভূতি ভাগাভাগি করতে পারে তাকেই সোশ্যাল মিডিয়া বলে। সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার যে একেবারেই মন্দ এমনটি বলা যাবে না। এর পরিমিত ব্যবহার সমাজে যোগাযোগের সেতুবন্ধন তৈরি করলেও আমরা এর মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকতে পারি না। ভার্চুয়াল জগতে ফেসবুক, টুইটার, ইনস্টাগ্রাম, টিকটক, বিভিন্ন গেমস, আমাদের তরুণ সমাজকে রীতিমতো গ্রাস করে নিয়েছে। সোশ্যাল এক্টিভিস্ট রিকি শ্লট বলেন, ‘আমাদের শৈশব চুরি করা হয়েছে।’ সোশ্যাল মিডিয়া যেনো এখন সোশ্যাল ডিজিজে পরিণত হয়েছে। এ অবস্থা থেকে আমাদের বের হয়ে আসতে হবে।  

আমি আশাবাদী মানুষ। স্বপ্ন দেখতে ভালোবাসি। নতুন স্বপ্নই আমাদের বাঁচিয়ে রাখে। জীবন অনেক সুন্দর, আকর্ষণীয় এবং উপভোগ্যময়। আমাদের ধৈর্য ধারণ করতে হবে। অযথা সময় নষ্ট করা যাবে না। যে সময়গুলো আমরা অবহেলায় কাটিয়ে দিচ্ছি- এই সময় আর কোনদিনও ফিরে পাবো না। প্রতিটি মুহূর্ত মানুষের জীবনের জন্য খুবই মূল্যবান। শিক্ষার্থীরা শুয়ে-বসে, গল্পগুজব করে অবহেলায় সময় নষ্ট না করে পাঠ্য বইয়ের পাশাপাশি যেকোনো আউট বই পড়তে পারে। বাড়ির কাজে বড়দের সাহায্য করতে পারে। সেখান থেকে জীবনমুখী বিভিন্ন কাজ হাতে কলমে শিখতে পারবে।

তোমাদের বয়স কম। সময়ের গুরুত্ব বোঝার মত সুবুদ্ধি, অভিজ্ঞতা তোমাদের এখনো হয়নি। কিন্তু যখন হবে তখন আফসোসের সীমা থাকবে না।  দীর্ঘদিন ধরে ইলেক্ট্রোনিক ডিভাইস ব্যবহার ও সোশ্যাল মিডিয়াতে সময় ব্যয়ের ফলে যে ক্ষতি তোমাদের হয়ে গেলো তা হয়তো তোমরা এখন উপলব্ধি করতে পারছো না। কিন্তু যখন পারবে,  তখন আর কিছুই করার থাকবে না। শুধু ব্যর্থতার বোঝায় ভারী হবে।  এখনো সময় আছে,  নিজেকে মেলে ধরার প্রচেষ্টায় অগ্রসর হও। শুধু যে পাঠ্যবই পড়তে হবে তা কিন্তু নয়।  নিজেকে জানার, নিজেকে চেনার জন্য পাঠ্যবইয়ের বাইরে তোমার ভালো লাগার যেকোনো বই-যেমন: বিজ্ঞান, দর্শন, ইতিহাস, ভূগোল, সাহিত্য, ধর্মশাস্ত্র, অর্থশাস্ত্র, রাজনীতি, পৌরনীতি যেকোনো বিষয় তুমি আয়ত্ব করতে পারো।  তোমার প্রতিভাকে মেলে ধরার জন্য যেকোনো অনলাইন টেকনিক্যাল প্রশিক্ষণে অংশ নিয়ে তুমি নিজেকে এগিয়ে নিতে পারো। সিলেবাস ভিত্তিক পড়া সার্টিফিকেট ছাড়া আর কিছুই দিতে পারে না। আর সার্টিফিকেট সর্বস্ব পড়াশোনা জীবনে তেমন কাজে আসে না। নিজেকে সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তুলে জীবনকে সার্থক ও আনন্দময় করতে হলে বইপড়া এবং অভিজ্ঞতা অর্জনের কোনো বিকল্প নেই।  জানি, আমাদের নানাবিধ সীমাবদ্ধতা রয়েছে। উন্নত দেশের মতো আমাদের  তেমন সুযোগ-সুবিধা নেই। এসব মেনে নিয়েই এগিয়ে যেতে হবে। 

আমরা বিশ্বাস করি, আমাদের প্রতিটি শিক্ষার্থী অসম্ভব মেধাবী। তারা চাইলে পৃথিবীকে হাতের মুঠোয় রেখে যেকোনো অসাধ্য সাধন করতে পারে। মেধা ও বুদ্ধিকে কাজে লাগিয়ে এই শিক্ষার্থীরাই পারে আগামী দিনে সোনার বাংলাদেশ বিনির্মাণের যোগ্য সারথি হতে। এজন্য চাই পরিকল্পিত পাঠ এবং সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য। উদ্দেশ্য ছাড়া জীবন সঠিক পথে চলতে পারে না। তোমরা নিশ্চয়ই মাঝিবিহীন নৌকা দেখেছো । মাঝি ছাড়া যেমন নৌকা কখনো গন্তব্যে পৌঁছায় না তেমনি সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য ছাড়া জীবনে সফলতা অর্জন করা যায় না। তাই তোমাদের প্রথমেই জীবনের লক্ষ্য স্থির করতে হবে। বড় স্বপ্ন দেখতে হবে।  মনের মধ্যে সুদৃঢ় সংকল্প থাকতে হবে।  সেই সঙ্গে কাজের স্পৃহা এবং মনোবল অটুট রাখতে হবে। দেখবে সাফল্য তোমার হাতের মুঠোয় ধরা দিয়েছে। সবচেয়ে বড় কথা সময়ের মূল্য দিতে শিখতে হবে। যেকোনো লক্ষে কাজ শুরু করলে তা কখনও একেবারে ব্যর্থ হয় না। সম্পূর্ণ সফলতা না আসলেও দেখবে এই কাজ থেকে তুমি অনেক শিখেছো। নতুন অভিজ্ঞতা অর্জন করেছো। যা তোমার জীবনের প্রতি পদক্ষেপে কাজে লাগবে। 

আমরা সবাই ক্লাসে প্রথম হতে চাই। কিন্তু কেউ প্রতিযোগী হতে চাই না। মনে রাখবে, ক্লাসে প্রথম হয় একজন কিন্তু ফার্স্ট ক্লাস পায় অনেকেই। যারা ফার্স্ট ক্লাস পায়; তারা প্রত্যেকেই প্রথম হওয়ার যোগ্যতা রাখে। তাই কেবল প্রথম হওয়ার জন্য নয়, প্রতিযোগিতার দৌড়ে এগিয়ে থাকাই হবে তোমাদের লক্ষ্য। এই জেদ মনের মধ্যে ধারণ করাকে বলে সংকল্প। যারা প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে তারা এক একজন প্রতিযোগী। তোমরা প্রত্যেকে যে কোনো কাজে প্রতিযোগিতা করার মনোভাব নিয়ে বেড়ে ওঠো । তাহলে দেখবে, ভয় তোমাকে দেখে পালাবে। 

শিক্ষার্থী বন্ধুরা, তোমরা কেবল শুধু পড়াশোনা করো-এমনটি আমি বলতে চাই না। কারণ পড়াশোনার বাইরেও তোমাদের অনেক দায়িত্ব রয়েছে। দেশ ও জাতির প্রতি তোমাদের রয়েছে দায়। দেশ তোমাদের কেবল দিয়েই যাচ্ছে। কিন্তু একটা সময় আসবে যখন দেশ তোমাদের কাছে কিছু চাইবে। আমি দেশ বলতে দেশের মানুষকে বোঝাতে চাচ্ছি। দেশের মানুষের জন্য কিছু করতে পারার যোগ্যতা তোমাদের অর্জন করতে হবে। আমাদের দেশের মানুষের নানা সমস্যা রয়েছে; যা বলে শেষ করা যাবে না। কত মানুষের চাকরি নাই। ব্যবসা-বাণিজ্যে সমস্যা হচ্ছে। তবে জীবন কিন্তু থেমে নেই। জীবন জীবনের নিয়মে চলছে। তোমরা সেবার মানসিকতা অর্জন করবে। সেবা পরম ধর্ম।  সেবার মাধ্যমে যেকোনো মানুষকে আপন করে নেয়া যায়। 

প্রযুক্তি মানুষের জীবন-জীবিকা বদলে দিয়েছে। গ্রামের দিকে একবার তাকাও। সেখানে স্কুল-কলেজ বন্ধ হওয়ায় শিক্ষার্থীরা জীবনের প্রয়োজনে কাজে নেমে পড়েছে। কেউ রিক্সা চালাচ্ছে। কেউ ইটভাটায় কাজ করছে। কেউ বা আবার দিনমজুরির কাজে ব্যস্ত। অল্প বয়সে অনেক মেয়েকে বিয়ে দিয়ে পরিবার হাল্কা করা হচ্ছে। আমার খুব ভয় হয়, ওরা কি আর স্কুলে ফিরতে পারবে? জীবন ওদেরকে এমন ভাবে বেঁধে ফেলবে যে ওরা শত চেষ্টা করলেও সে বাঁধন ছিন্ন করতে পারবে না। ক্লাসরুমে প্রবেশ তো অনেক দূরের কথা। কিন্তু আমরা চাই, কঠিন বাস্তবকে পরাজিত করে আমাদের শিক্ষার্থীরা আবার সবাই ক্লাস রুমে ফিরে আসুক। আবার ওদের কলরবে মুখরিত হোক আমাদের প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। 

লেখক: গবেষক, বাংলা বিভাগ, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়

জনপ্রিয়