ঢাকা বৃহস্পতিবার, ১৪ নভেম্বর ২০২৪ , ২৯ কার্তিক ১৪৩১ আর্কাইভস ই পেপার

bkash
bkash
udvash
udvash
uttoron
uttoron
Rocket
Rocket
bkash
bkash
udvash
udvash

সংখ্যানুপাতিক নির্বাচনী ব্যবস্থা: স্বৈরাচারী হবে দল

মতামত

কামরান রেজা চৌধুরী, আমাদের বার্তা

প্রকাশিত: ০০:১০, ১২ নভেম্বর ২০২৪

আপডেট: ১০:৫৩, ১২ নভেম্বর ২০২৪

সর্বশেষ

সংখ্যানুপাতিক নির্বাচনী ব্যবস্থা: স্বৈরাচারী হবে দল

গণ-অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার কর্তৃত্ববাদী সরকারের পতনের পর যে দাবি উঠেছে সেটি হলো, দেশের মানুষ আর কোনো স্বৈরতন্ত্র দেখতে চায় না। একটি টেকসই সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক ব্যবস্থা দেখতে চায়, যা কোনো দল অথবা দলীয় প্রধানকে এককভাবে স্বৈরাচারী করে তুলবে না। জনগণের দেয়া রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ভাগাভাগি করা থাকবে। ফলে রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ভারসাম্য বজায় থাকবে এবং কেউ বাড়াবাড়ি করলে অন্য প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে তা নিয়ন্ত্রিত হবে।

যেমন-আইনসভা কোনো অসাংবিধানিক সিদ্ধান্ত নিলে সেটি বিচার বিভাগের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত হবে। সাম্প্রতিক সময়ে সংসদে পাস হওয়া সংবিধানের ১৬তম সংশোধনী বাতিলের মাধ্যমে ভারসাম্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং আইনসভার স্বৈরতন্ত্র বন্ধ করা গেছে। আবার বিচার বিভাগ যদি তার গণ্ডির বাইরে গিয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নেয় সেক্ষেত্রে আইনসভা এ ব্যাপারে আলোচনা করে জনমত সৃষ্টি ও সমালোচনার মাধ্যমে বিচার বিভাগের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে পারে। সেই ব্যবস্থা সংবিধানে রয়েছে। 


সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সরকারের সবার কাজের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে সংসদে। সংসদই হবে সকল রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড ও বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দু, রাজপথ নয়। সমাধান সংসদীয় ফোরামে হলে সেটি রাজপথে আসে না। মনে রাখতে হবে, রাজপথ যদি রাজনৈতিক সমস্যা সমাধানের প্ল্যাটফরম হয় তাহলে রাষ্ট্রের কর্তৃত্বের ওপর জনগণের আস্থা থাকে না। সেটি বাংলাদেশ থেকে শুরু করে সকল রাষ্ট্রের ক্ষেত্রেই প্রায় সমভাবে প্রযোজ্য।

কিন্তু দুঃখের বিষয়, বাংলাদেশের রাজনৈতিক সমস্যা সমাধানের পথ রাজনৈতিক ফোরামের পরিবর্তে রাজপথ এবং সহিংসভাবেই করা চেষ্টা হয়েছে এবং কিছু ক্ষেত্রে সফলও হয়েছে। 

বাংলাদেশের রাজনৈতিক সমস্যার স্বরূপ বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপট থেকে শুরু করে বাংলাদেশের রাজনৈতিক সমস্যা মূলত দুইটি ‘শন (tion)’ এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। একটি হলো কনস্টিটিউশন, বাংলায় যাকে আমরা শাসনতন্ত্র বলি এবং আরেকটি হলো ইলেকশন অর্থাৎ নির্বাচন। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর গঠিত বঙ্গবন্ধু সরকার থেকে শুরু করে অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার সকলেই এই দুই ‘শন’ এর মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে। এই সরকার ইতোমধ্যে এই দুটি বিষয়ে দুটি সংস্কার কমিশন গঠন করেছে, যা এ বছর ডিসেম্বর মাসে তাদের প্রতিবেদন জমা দেবেন বলে বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা গেছে।

সংস্কার কমিশন গঠিত হওয়ার আগ থেকেই দেশের বর্তমান নির্বাচনী ব্যবস্থা অর্থাৎ দেশের ৩০০ আসনে সরাসরি নির্বাচনের মাধ্যমে ৩০০ সংসদ-সদস্য নির্বাচন করার পরিবর্তে সংখ্যানুপাতিক নির্বাচনী ব্যবস্থা প্রবর্তনের কথা বলছেন অনেকেই। বলা হচ্ছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এই ব্যবস্থা খুব ভালোভাবে কাজ করছে।

এই নিবন্ধের মূল উদ্দেশ্য হলো, সংখ্যানুপাতিক নির্বাচনী ব্যবস্থা চালু হলে রাজনৈতিক ব্যবস্থায় কী সমস্যা হতে পারে সেবিষয়ে কিছুটা আলোকপাত করা।

প্রথমেই বলে রাখা ভালো, আমি সংখ্যানুপাতিক নির্বাচনী ব্যবস্থার বিরোধী নই। আবার বর্তমান ব্যবস্থারও কট্টর সমর্থকও নই। তবে স্বল্প পরিসরে হলেও বাংলাদেশের সংবিধানে সংসদ গঠনে সংখ্যানুপাতিক ব্যবস্থা চালু রয়েছে। সেই ব্যবস্থার আলোকেই আমার এই মতামত পেশ।

তবে একটি কথা, কোন দেশে কোন ব্যবস্থা কাজ করবে সেটি মূলত নির্ভর করে সেই ব্যবস্থার সঠিক প্রয়োগ এবং সংশ্লিষ্ট দেশের আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও মনোজাগতিক কাঠামো কেমন তার ওপর। বৃটেনে কোনো লিখিত সংবিধান ছাড়াও তারা বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী সংসদীয় গণতন্ত্র বলা যায়। আবার বাংলাদেশ, পাকিস্তানসহ বিভিন্ন ভঙ্গুর গণতান্ত্রিক দেশগুলোতে মোটা শাসনতন্ত্র দিয়েও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা রক্ষা করা যায় না। মানুষ সেনাবাহিনীর সরকার চেয়ে বিক্ষোভ করে। নির্দলীয় সরকারের জন্য জীবন দেয়।


ফিরে আসা যাক সংখ্যানুপাতিক নির্বাচনী ব্যবস্থার প্রসঙ্গে। সংখ্যানুপাতিক ব্যবস্থা চালু করা হলে নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত দলগুলো নিজেদের মধ্যে প্রতিযোগিতা করবে। এর মোদ্দা কথা হলো, জনগণ কোনো নির্দিষ্ট প্রার্থীর পরিবর্তে দলীয় প্রতীকে ভোট দেবেন। একটি দল শতকরা যতো শতাংশ ভোট পাবে সেই অনুসারে সংসদে আসন পাবে। অর্থাৎ ৩০০ আসেনর মধ্যে এককভাবে সরকার গঠন করতে একটি দলকে ৫০ শতাংশের বেশি ভোট পেতে হবে। যা হবে অত্যন্ত কঠিন, যদিও অসম্ভব নয়। জনগণ চাইলে হতেই পারে। কিন্তু অতীত নির্বাচন দেখলে সেটি সুন্দরভাবে ফুটে ওঠে। যেমন সর্বশেষ সকল দলের কাছে মোটামুটি গ্রহনযোগ্য নির্বাচন ছিলো ২০০৮ খ্রিষ্টাব্দের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচন। নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টিসহ বিভিন্ন দল নিয়ে যৌথভাবে নির্বাচন করে ৩০০ আসনের মধ্যে ২৩০টি আসন জিতলেও ভোটের হিসাবে পেয়েছে ৪৮ শতাংশ ভোট। 

তাত্ত্বিকভাবে এবং খোলা চোখে সংখ্যানুপাতিক ব্যবস্থা চালু হলে দলগুলোর স্বৈরাচারী ব্যবস্থা কমে আসবে। কিন্তু প্রায়োগিক দিক থেকে সমস্যা সমাধানের পরিবর্তে আরো জটিল করে তুলতে পারে। প্রশ্ন হলো কীভাবে? উত্তর খুব সহজ। তখন সংসদ-সদস্য হতে আর জনগণের কাছে যাবেন না সম্ভাব্য প্রার্থীরা। যাবেন দলের নেতার কাছে। আগে থেকেই টাকা নিয়ে হাজির হবেন। দলের প্রধানরা মোটামুটি নিলামে তুলে প্রতিটি আসনের বিপরীতে টাকা নিয়ে নেবেন। তারপর হবেন সংসদ-সদস্য। যেমনটি দেখা গেছে বাংলাদেশে বিদ্যমান সংরক্ষিত নারী আসনের ক্ষেত্রে। 

বিএনপির নেতৃত্বাধীন অষ্টম জাতীয় সংসদে সংরক্ষিত নারী আসনের ব্যবস্থা সংসদে প্রতিনিধিত্বকারী দলের আসনের বিপরীতে প্রদানের ব্যবস্থা করা হয়। সেই ব্যবস্থা এখনো চলছে। ব্যবস্থাটি নিয়ে কোনো রাজনৈতিক দলের অভিযোগ নেই। কিন্তু এই ব্যবস্থার অন্ধকার দিক দেখার সুযোগ হয়েছে আমার। কেবল একটি ঘটনা উল্লেখ করতে চাই। 

ঘটনাটি ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দের বিতর্কিত নির্বাচন হয়ে যাওয়ার পর। বাংলাদেশ জাতীয় সংসদে একটানা ২৩ বছর রিপোর্ট করার সুবাদে স্পিকার, ডেপুটি স্পিকারসহ সংসদের সকল বড় কর্মকর্তাদের সঙ্গে আমার যোগাযোগ ছিলো খুবই নিবিড় এবং ঘনিষ্ঠ। সে কারণেই উনারা আমার মতো সাংবাদিকদের সামনেই অনেক অপ্রিয় সত্য বলে ফেলতেন যা লেখা যেতো না। রিপোর্টার হিসেবে ডায়েরিতে লিখে রাখতাম অথবা নোট নিয়ে রাখতাম।

এ বছর জানুয়ারি মাসের কথা। সংসদের অধিবেশন তখনো বসেনি। আমি, বাংলাদেশ পার্লামেন্ট জার্নালিস্টস’ অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি হারুন আল রশিদ, সমকালের মশিউর রহমান খানসহ আমরা কয়েকজন স্পিকার শিরিন শারমিন চৌধুরীর কার্যালয়ে বসে পেশাগত বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলাপ-আলোচনা করছিলাম। এর মধ্যেই স্পিকারের চেম্বারে এলেন জাতীয় পার্টির সাবেক একজন সংসদ-সদস্য যিনি সংরক্ষিত আসন থেকে নির্বাচিত হয়ে ২০১৮ থেকে ২০২৩ পর্যন্ত সংসদে দায়িত্ব পালন করেছেন। এর আগেও তিনি সংরক্ষিত আসন থেকে সংসদ-সদস্য ছিলেন। ওই সংসদ-সদস্য একটি স্থায়ী কমিটির সভাপতিও ছিলেন। বাড়ি কুমিল্লায়।

তিনি স্পিকারের কাছে এসেছিলেন, নিজের জন্য তদবির করতে। সংরক্ষিত আসনের সংসদ-সদস্য হিসেবে পুনরায় নির্বাচিত হতে। উনি কক্ষে ঢুকেই স্পিকার শিরিন শারমিন চৌধুরীর হাতে বিদেশ থেকে আনা কোনো কিছুটা গিফট আইটেম দিতে গেলে তিনি বললেন, ‘দরকার নেই। বলুন।’

এরপর তিনি স্পিকারের সঙ্গে গোপনে কথা বলতে চাইলেন। স্পিকার ড. শিরিন শারমিন চৌধুরী বললেন, ‘আপনি এখানেই বলুন।’ আমাদের দেখিয়ে দিয়ে বললেন, ‘ওরা সাংবাদিক। বলুন, উনাদের সামনেই বলুন। কোনো সমস্যা নেই।’ 
ভদ্রমহিলা কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে এবার স্পিকার মহোদয়ের কানের কাছে গিয়ে ফিসফিস করে কথা বলতে লাগলেন। কিন্তু উনি যেভাবে ফিসফিস করে কথা বলছিলেন তাতে আমরা সবাই তার কথা শুনতে পাচ্ছিলাম। হয়তো বয়সের কারণে উনি আস্তে কথা বলতে গেলেও জোরে হয়ে যায়, বোঝেন না।

“আপা, আপনার কাছে এসেছি, আমার জন্য কিছু করা যায় কি না?’ স্পিকার মহোদয় বললেন, ‘কি করবো? আপনি তো জাতীয় পার্টির এমপি হতে চান। সেখানে যান।’ তিনি বললেন, ‘সব কেনা-বেচা শেষ।…একজন তো ২৫ কোটি টাকা দিয়ে একটি আসন কিনে নিয়েছে। আমার তো অতো টাকা নেই। আমি আট কোটি টাকা পর্যন্ত দিতে পারবো। আপনি একটু দেখেন না, প্রধানমন্ত্রী যদি আমার ব্যাপারে বলতেন তাহলে সুবিধা হতো।’

স্পিকার শিরিন শারমিন চৌধুরী আর্থিক দিক থেকে কোনো প্রকার অসততার আশ্রয় নিয়েছেন সেটি আমাদের সাংবাদিকদের চোখে আসেনি। তিনি কিছুটা বিরক্ত হয়ে বললেন, ‘দেখুন, এখানে আমারও কিছু করার নেই। সব কিছুই আপনার দলের ওপর নির্ভর করছে। আপনি কতো খরচ করতে পারবেন সেটি সেখানে বলুন।’


স্পিকার এমন উত্তরে হতাশ হয়ে ভদ্রমহিলা চলে গেলেন। কিন্তু বলে গেলেন একটি গোপন সত্য কথা। সত্যি সত্যিই ২৫ কোটি টাকা খরচ করা ওই নারী সংসদ-সদস্য হয়েছিলেন। যদিও ২৫ কোটি টাকাই উনি খরচ করেছেন সেটি যাচাই করা সম্ভব হয়নি। কারণ, যিনি দিয়েছেন এবং যিনি নিয়েছেন কেউ এ ব্যাপারে আমাদের কাছে মুখ খোলেননি।

যদি সাধারণ নির্বাচনও সংখ্যানুপাতিক ব্যবস্থায় করা হয় তাহলে এমন পরিণতি হতে পারে সে বিষয়ে আমাদের প্রস্তুত থাকতে হবে। বর্তমানে যেভাবে টাকা দিয়ে মনোনয়ন কেনা হয় তার চাইতে আরো বেশি দরে সংসদ-সদস্য বিক্রি হবে এবং কেনা এই সংসদ-সদস্যরা জনগণের স্বার্থে কোনো কাজ করবে না। যেমনটি আমরা দেখি যারা ঘুষ দিয়ে চাকরি নেয়ার ক্ষেত্রে। লাখ লাখ টাকা ঘুষ দিয়ে চাকরি নেয়া কর্মচারী যেমন ঘুষ ছাড়া কিছু বোঝে না তেমনি ওই সকল সংসদ-সদস্যরাও টাকা ছাড়া কিছু বুঝবেন না।

সংখ্যানুপাতিক নির্বাচনী ব্যবস্থা চালু হলে রাজনৈতিক দলগুলো আরো স্বৈরাচারী হয়ে পড়বে এবং রাষ্ট্রের জনগণ সকল ক্ষমতার উৎস থাকবে না। প্রজাতন্ত্রের মালিক জনগণের ওপরে বসে যাবে রাজনৈতিক দলগুলো। জনগণের সার্বভৌমত্ব ধুলিস্যাৎ হয়ে যাবে। 


এই ব্যবস্থা চালু হলে টাকা এবং নেতার পছন্দের ব্যক্তিরা সংসদ-সদস্য হবেন। দেখা যাবে কোনো জেলা থেকে একাধিক সংসদ-সদস্য রয়েছে। অন্যদিকে কোনো কোনো জেলার কোনো প্রতিনিধি নেই।

প্রশ্ন আসতে পারে সকল জেলার প্রতিনিধিত্ব কেনো দরকার। অবশ্যই দরকার আছে। একেক জেলার, একেক অঞ্চলের সমস্যা প্রেক্ষাপট একেক রকম যা স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা দিয়ে সমাধান করা যাবে না। যেগুলো সমাধানে জাতীয়ভাবে নীতির হস্তক্ষেপ দরকার। সেজন্য সংসদীয় ফোরামে আলোচনা অত্যাবশ্যক। জাতীয়ভাবে আলোচনা দরকার।


উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে, দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে লবনাক্ততা, বিশুদ্ধ পানির সংকট, সমুদ্রপৃষ্টের উচ্চতা বৃদ্ধি এবং জলবায়ু পরিবর্তনজনিত অভিবাসন বিষয়ে সংসদে আলোচনার জন্য সেখানকার স্থানীয় মানুষদের দৈনন্দিন সমস্যা সম্পর্কে অবহিত এমন একজন সংসদ-সদস্য প্রয়োজন। রাজধানী ঢাকা অথবা বন্দরনগরী চট্টগ্রামের কোনো বাসিন্দার পক্ষে সেগুলো সংসদে সঠিকভাবে তুলে ধরা সম্ভব নয়। একই দেশ এমনকি একই জেলার বিভিন্ন উপজেলায় একেক ধরনের সমস্যা থাকে যেগুলো জাতীয়ভাবে তুলে ধরার জন্যই আসন-ভিত্তিক নির্বাচনী ব্যবস্থা রাখা হয়েছে সংবিধানে।

একটি আইনসভায় দেশের প্রতিটি অঞ্চলের প্রতিটি নির্বাচনী এলাকার প্রতিনিধিত্ব থাকতে হবে। এটিই সংসদীয় ব্যবস্থার সৌন্দর্য্য। সেটি আমরা রক্ষা করতে পারছি কি না সেটি ভিন্ন প্রশ্ন। যদি না হয়, সেটি আমাদের ব্যর্থতা। কোনো ব্যবস্থার ব্যর্থতা নয়।


বর্তমানে জনগণের সরাসরি ভোটের মাধ্যমে ৩০০ সংসদ-সদস্য নির্বাচনের যে বিধান রয়েছে সেটির মাধ্যমে প্রতিটি আসনে মনোনয়নের জন্য স্থানীয় পর্যায়ে প্রতিযোগিতা হয় এবং এর মাধ্যমে স্থানীয় নেতৃত্ব তৈরি হয়। কিছু নেতা তৈরি হয়। জনগণের ভোট পেতে হলে, তাদের স্থানীয় জনগণের সঙ্গে মিশতে হয়। কথা বলতে হয়।

সংখ্যানুপাতিক নির্বাচনী ব্যবস্থা চালু হলে, জনগণের কোনো সংসদ-সদস্য থাকবে না। থাকবে দলীয় প্রধানের অনুগত, পোষা সংসদ-সদস্য যাদের আনুগত্য থাকবে কেবলমাত্র দলীয় প্রধানের কাছে। সংসদ হবে দলীয় ক্লাব।

সরকার পরিচালনার ক্ষেত্রে দেখা দেবে আরেক সমস্যা। যদি কোনো সরকারের শতকরা ৫০ ভাগের বেশি আসন না থাকে তাহলে দেখা যাবে, সরকার বাজেটসহ বিভিন্ন আইন পাস করতে পারছে না। আইন পাসের জন্য অন্য দলের শরণাপন্ন হতে হবে। এবং যেসব দলের ওপর নির্ভর করতে হবে তারা এই সুযোগ নিয়ে আর্থিকসহ বিভিন্ন সুবিধা আদায় করে নেবে। ফলে এক্ষেত্রে নতুন দুর্নীতির ক্ষেত্র উন্মোচিত হবে। যা দেশের জন্য কোনভাবেই মঙ্গলজনক হবে না। এ ছাড়া, ছোট ছোট দলগুলো কারণে-অকারণে সরকারকে ফেলে দিতে চাইবে এবং কোনো সরকারই সঠিকভাবে কাজ করতে পারবে না। সরকার কাজ করতে না পারলে দেশে অরাজকতা সৃষ্টি হবে, যা কারও কাম্য নয়। সরকারকে যেমন স্বচ্ছ ও জবাবদিহি করতে হবে। তেমনি তাকে কাজ করার প্রয়োজনীয় সুযোগ দিতে হবে। অন্যথায় রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা আসবে না। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা না আসলে দেশ এগিয়ে যেতে পারবে না।

যেকোনো ব্যবস্থার সফলতা ও ব্যর্থতা নির্ভর করে যারা এটি প্রয়োগ করছেন তাদের ওপর। বর্তমান নির্বাচনী আসন ব্যবস্থার সঙ্গে দেশের মানুষ ব্যাপকভাবে পরিচিত। রাতারাতি সংখ্যানুপাতিক নির্বাচনী ব্যবস্থা প্রবর্তন করলে তা দেশের মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না। 

বাংলাদেশের ভোটারদের ভোটাধিকার প্রয়োগের একটি উদাহরণ উল্লেখ করে শেষ করতে চাই। ঘটনাটি সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, মাগুরার প্রয়াত সংসদ-সদস্য ডা. সিরাজুল আকবর। ঘটনাটি তার জেলার। 

মাগুরা জেলার এক আওয়ামী লীগ নেতা জাতীয় পার্টিতে যোগদান করে ১৯৮৮ খ্রিষ্টাব্দে লাঙ্গল প্রতীকে নির্বাচন করছিলেন। আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জামায়াতসহ কোনো মূল রাজনৈতিক দলই সেই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেনি। জাতীয় পার্টির ওই প্রার্থী তার মাকে জানান, নির্বাচনে নৌকা মার্কা নেই এবার। ভোট দিতে হবে লাঙ্গলে। ছেলের কথা মতো মা ভোট দিয়ে ছেলেকে বললেন, ‘কি রে তুই যে বললি নৌকা নেই। কিন্তু আমি তো ব্যালটে নৌকা পেলাম। নৌকায় ভোট দিয়ে এলাম।’
মায়ের কথা শুনে ছেলে হতবাক। পরক্ষণেই বুঝতে পারলেন তার মা জাহাজ প্রতীককে নৌকা ভেবে ভোট দিয়েছেন। সংখ্যানুপাতিক ব্যবস্থা প্রচলনের আগে এর ভালোমন্দ, দেশের প্রেক্ষাপট সবকিছু বিচার বিশ্লেষণ করেই করা দরকার। অন্যথায় সব ভালো উদ্যোগই বিফলে যাবে। রয়ে যাবে, ‘যেই লাউ, সেই কদু’।
লেখক: সাংবাদিক

জনপ্রিয়