ঢাকা বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪ , ৬ অগ্রাহায়ণ ১৪৩১ আর্কাইভস ই পেপার

bkash
bkash
udvash
udvash
uttoron
uttoron
Rocket
Rocket
bkash
bkash
udvash
udvash

রাষ্ট্র পরিবর্তনে জনতার দায়

মতামত

রাজু আহমেদ,আমাদের বার্তা ডেস্ক

প্রকাশিত: ০০:০০, ১৬ নভেম্বর ২০২৪

আপডেট: ১৩:০৯, ১৬ নভেম্বর ২০২৪

সর্বশেষ

রাষ্ট্র পরিবর্তনে জনতার দায়

দোষের কথা উঠলেই আমলার দোষ, পুলিশের দোষ কিংবা অন্যান্য সেক্টরের সরকারি চাকরিজীবীদের দোষসমূহ আলোচিত হয়। জনতার দোষ নিয়ে তত আলোচনা-সমালোচনায় কেউ মুখর হয় না। নতুন এক বাস্তবতায় প্রবেশ করেছে বাংলাদেশ। ছাত্র-জনতার বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের পর অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে সবচেয়ে বেশি দাবি উঠেছে রাষ্ট্র কাঠামোর সংস্কারের।

বিদ্যমান পরিস্থিতিতে শাসককে স্বৈরাচারে পরিণত করার, ফ্যাসিবাদ জন্ম হওয়ার যে ক্ষেত্রগুলো আছে সেখানে পরিবর্তনের দাবি জোড়ালোভাবেই উঠেছে। পুলিশের দানবীয় কার্যকলাপ বন্ধে এবং আমলাদের জনগণের মালিক হয়ে ওঠার দৌরাত্ম্য থামানোর জন্যই এই আন্দোলন।

তাছাড়া সরকারি চাকরিজীবীরা যে রাষ্ট্রের জনগণের সেবক, জনগণের ট্যাক্সের টাকায় তাদের বেতন-ভাতা প্রদান করা হয়- সেসব কথা কর্মকর্তা-কর্মচারীদের স্মরণ করিয়ে দেয়ার জন্য এই আন্দোলনে অধিষ্ঠিত সরকার দায়িত্ব নিয়েছে। জনতার পক্ষ থেকে বিবেচনা করলে সব দোষ বিপক্ষের কিন্তু নিরপেক্ষভাবে দেখলে জনগণকে কি সাধু বলার সুযোগ আছে? 

শত কিলোমিটার দূরে বসে সার্জেন্টের হাতে মোটরসাইকেলসহ আটক হয়েছে বলে যে আত্মীয় পুলিশ কর্মকর্তা তাকে ফোন দিয়ে ফেভার চাওয়া হয়। কাছের কিংবা দূরের যে আত্মীয় সরকারি কর্মকর্তা তার পরিচয়ে পরিচিত হতে সুখানুভব করে। কারো সঙ্গে ক্ষমতাধর রাজনীতিবিদের সখ্যতা আছে শুনলে সুযোগসন্ধানীর চোখ চক চক করে ওঠে। সুপারিশ করার মত আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-পরিচিত যাদের যা আছে তাদের থেকে সহায়তা নেয়ার কৃপণতা কেউ করে না।

তখন কোনো প্রকার লজ্জাও ভর করে না। ডাক্তারের সিরিয়াল দেয়া থেকে শুরু করে রেলের টিকিট টাকা, চাকরির জন্য সুপারিশ করানো থেকে শুরু করে মামলার তদবির- মোটকথা, স্বজনদের ক্ষমতাকে অপব্যবহার করে যত ধরনের অবৈধ সুযোগ গ্রহণ করা যায়- তাতে কাছের ও দূরের পরিচিতজনরা ছাড়ে না। একজন মানুষের সুপারিশ করা অপছন্দের, কর্মক্ষেত্রে তিনি সৎ হিসেবে পরিচিত কিংবা এসব করার ক্ষমতা আদৌ তার নেই- সেসব সত্ত্বেও লোকজন তার পিছু ছাড়ে না। বরং জোঁকের মত লেগে থাকে।

দেখবোনে বলে যদি না দেখে কিংবা সরাসরি না বলে ফিরিয়ে দেয় তবে তার দোষের আর অন্ত থাকে না। মানুষের নিন্দায় মানুষ এমন সব কথা ও অভিযোগ হাজির করতে পারে যা শুনে শয়তানও রীতিমতো লজ্জা পায়।

আমি অমুকের তমুক কিংবা তমুকের অমুক বলে কর্মক্ষেত্রে কিংবা সমাজ-রাষ্ট্রে বাড়তি সুযোগ নেয়া ও পাওয়া সহকর্মীরা কিংবা মানুষগুলো যখন নীতিকথা বলে তখন যেভাবে হাসি পায় তা চাপিয়ে রাখা মুশকিল। আত্মীয় স্বজনের মধ্যের কেউ না বরং বন্ধুর পরিচিতের একজন নিকটাত্মীয় ক্ষমতাধর- মানুষ তার দোহাই দিয়েও চলে। একজনের অধিকার আটকে আছে কিংবা মিথ্যা কোনো অভিযোগে হয়রানি করা হচ্ছে- সেখানে সুপারিশ করার প্রেক্ষাপট ভিন্ন। কিন্তু অন্যায় করবে, অবৈধ কাজে সম্মতি আদায় করবে কিংবা সততার শৃঙ্খল ভাঙবে- আর সেই কাজেও আত্মীয়-স্বজনকে ফোন দিয়ে সাহায্য চায়।

প্রচণ্ড সৎ না হলে একজন মানুষ সরাসরি না বলতে পারে না। এই না বলতে না পারার মৌনতাকে পুঁজি করেও সুযোগবাদী লোকে ভাবে তার পক্ষে সম্মতি দিয়েছে। কেউ একজন উচ্চপদে গেলে, ক্ষমতা পেলে কিংবা কিছু করে দেয়ার ক্ষমতা থাকলে মানুষ এমনভাবে ঘিরে ধরে যা সেবার ক্ষেত্রে সবার জন্যই ক্ষতিকর। স্বজনপ্রীতির উদ্ভব এভাবেই চক্ষু লজ্জায় শুরু হয় এবং দুর্নীতির বড় অংশে পরিণত হয়। 

দেশে থানা-আদালতে যত সংখ্যক মামলা হয় সেসবের অধিকাংশ ভুয়া। শুধু প্রতিপক্ষকে ফাঁসাতে নিজের সন্তানকে হত্যা করে, গুম করে কিংবা আহত করে মামলা হয়েছে বলে বহুবার পত্রিকায় এসেছে। অন্যের জমিজমা দখল করতে মারামারি হয় এবং মামলাবাজি চলে। নিশ্চয়ই এসব মামলা রুজুতে থানা-পুলিশ প্ররোচিত করে না। তাছাড়া দ্রুত সেবা পাওয়ার মানসিকতা, যেকোনো পথে স্বার্থ আদায়ের লক্ষ্যে নামা, রাজনৈতিক প্রতিহিংসায় খুন-জখম এসবে আমলারাও উৎসাহিত করে না। ব্যবসায় সিন্ডিকেট, অবৈধ মজুত, বাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরি করা কিংবা গুজব ছড়ানোয় জনগণ ওস্তাদ। কাজেই একপাক্ষিক দোষ বর্ণনা করে শুধু চাকরিজীবী এবং রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গকে দোষারোপ করলে সেটা ন্যায় সঙ্গত হবে না।

বরং ভোট না হওয়া, অবৈধভাবে কেউ দীর্ঘসময় ক্ষমতায় থাকা, সরকারি কাজে কন্ট্রাক্টটরদের ফাঁকি দেয়া- এসবের পিছনে জনগণের মৌনতাও কম দায়ী নয়।
যতক্ষণ নিজে আক্রান্ত না হবো ততক্ষণ অন্যায়ের বিপক্ষে না বলা আমাদের চরিত্রের চর্চায় পরিণত হয়েছে। সবার পাশে না থাকাতে, না দাঁড়ানোতে আমাদের ঐক্যে ফাটল ধরেছে এবং জুলুমবাজরা সুযোগ পাচ্ছে।শাসকের স্বৈরাচার হয়ে ওঠায়, পুলিশ চরম ক্ষমতা পাওয়ায়, রাজনৈতিক দলগুলোর যথেচ্ছাচার আচরণে জনগণের সয়ে যাওয়া মানসিকতাও সমানভাবে দায়ী। ভোট দেয়ার সময় প্রার্থীদের কাছে দু’চারশ টাকায় ভোট বিক্রি করা, সরকারি সাহায্য অন্যায়ভাবে কুক্ষিগত করার জন্য স্থানীয় সরকারের সদস্যদের কাছে কাকুতি মিনতি করা কিংবা ন্যায়-অন্যায় বিচার না করে হুজুগে কোনো পক্ষের অন্ধ সমর্থন করার কারণে দেশের রন্ধ্রে রন্ধ্রে সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে।

জাতির সামনে সংস্কারের যে সুযোগ এসেছে তা হাতছাড়া করলে সেটা আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত হবে। কোনো পরিবর্তন ছাড়া নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে পরবর্তী ক্ষমতাসীনরাও পূর্ববর্তীদের পদাঙ্ক অনুসরণ করবে। জাতির ভাগ্য আর বদলাবে না। যে সংবিধান দলীয় প্রধানের স্বৈরাচারী মনোভাবের পৃষ্ঠপোষকতা করে, যে পুলিশ রাষ্ট্রের জনগণকে দমনপীড়নের হাতিয়ার হয়ে ওঠে, যে আমলা দেশের অর্থ বিদেশে পাচার করার সুযোগ পায় কিংবা যে রাজনীতিবিদরা জনগণের সম্পদ লুণ্ঠন করে- সেই সনাতন সিস্টেম চালু রেখে নির্বাচন দিলে লাউয়ের কদুতে পরিবর্তনের বেশি কিছুই হবে না। ছাত্র-জনতার ত্যাগ-তিতিক্ষায়, তরুণদের অঙ্গহানি এবং হাজার প্রাণের বিনিময়ে পরিবর্তনের যে সুযোগ এসেছে তা যাতে হেলায় হারিয়ে না ফেলি। এদেশের জনগণের মধ্যে সচেতনতার খুব অভাব । একটা নির্দিষ্ট অংশ স্বার্থের জন্য সব বুঝেও রাষ্ট্রের ক্ষতির সঙ্গে সরাসরি ষড়যন্ত্রে জড়িত।

কাজেই আইনের শাসন তথা সুশাসন নিশ্চিত করা না গেলে, দেশপ্রেম জাগ্রত না হলে মানুষের ভাগ্য বদলাবে না। বরং বৈষম্যের বিরোধিতা করে যে আন্দোলন অনুষ্ঠিত হয়েছে তার পরিণতি হিসেবে বৈষম্য দূরীকরণ হবে না বরং বৈষম্য আরো বাড়বে। 

এদেশের মানুষকে বদলাতে বাধ্য করতে হবে। আইন প্রয়োগ করে ত্যাঁড়াকে সোজা করে দিতে হবে। তবেই শাসকের চরিত্র বদলাবে। জনগণের উদাসীনতায় যারাই ক্ষমতার মসনদে বসেছে তারা জনগণের ঘাড়ে চেপে শুষে খেয়েছে। কেউ স্বেচ্ছায় ক্ষমতার সান্নিধ্য পেয়েছে কিন্তু সৎ থেকেছে এমন রাজনীতিবিদের সংখ্যা এদেশে হাতেগোনা। রাজনীতিবিদদের সম্পদের পাহাড় অর্জনের সুযোগ দিয়ে জনগণও সে অন্যায়ে সমানভাবে অংশগ্রহণ করেছে। স্বাধীনতার ৫৪ বছর পরে বাংলাদেশের সামগ্রিক দৈন্য মোটেও কাম্য নয় অথচ বহুক্ষেত্রে হরিলুট হয়েছে।সরকারি চাকরিজীবী- শুনলেই একটি পক্ষ তেড়ে আসে।

অথচ এই চাকরিজীবীদের বাপেরও ক্ষমতা ছিলো যে সে অন্যায় করবে, যদি জনগণের তাতে সায় না থাকতো। পরিবারের একটি সন্তান দুর্নীতিবাজ-ঘুষখোর। তাকে পারিবারিকভাবে বয়কট করা হয়নি বরং তার বিপুল বিত্তের সুযোগ সবাই নিয়েছে। সমাজের একজন রাজনীতিবিদ অন্যায় করে বেড়াচ্ছেনতখন সমাজের লোক তাকে প্রতিরোধ না করে তার সুপারিশে ছোট ছোট অন্যায় করেছে। এতে ভণ্ড রাজনীতিবিদের তাদের কাজের সামাজিক স্বীকৃতি পাওয়া সহজ হয়েছে। 

দেশের স্বার্থে জনগণকে অধিকার সচেতন হতে হবে। তারা যদি ক্ষুদ্র স্বার্থ ত্যাগ করতে না পারে, দেশ নিয়ে না ভাবে তবে এই সমাজ-রাষ্ট্রের চিত্র বদলাবে না। মজুর আজীবন মজুর থাকবে এবং বড়লোক আরো বেশি সম্পদের স্তুপ করবে। জনগণ যদি তাদের অধিকার আদায়ে ব্যর্থ হয় তবে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সংস্কারের ভাবনা যাত্রা পথের প্রারম্ভে মারা যাবে। পূর্বের গতানুগতিক ধারা চলতে থাকলে বৈষম্য কোনোদিন কমবে না এবং সাধারণ মানুষের ভাগ্যেরও কোনো পরিবর্তন হবে না।
সব দোষ বিপক্ষকে দিয়ে লাভ নাই। তাতে ভাগ্য বদলায় না। বরং সাধারণ মানুষ হিসেবে আমাদের যে ত্রুটিগুলো আছে সেগুলোকে শোধরাতে হবে। পাহারা দিয়ে জনগণকে সাধুত্বের পথে হাঁটানো সম্ভব হবে না। কোমলতার সঙ্গে কঠোরতাও লাগবে। নিজেদের অধিকারসমূহ সম্পর্কে যেমন সজাগ থাকতে হবে তেমনি কোনো অন্যায় সামনে পড়লে তা রুখে দিতে হবে। অন্যায় করা এবং অন্যায় সহ্য করা সমান অপরাধ। যে টাকা জনগণের পকেটে তা ঘুষ হয়ে কর্মকর্তার ড্রয়ারে এমনি এমনি চলে যায় না বরং আমরা সেধে দিয়ে আসি। বাধ্য হয়ে ঘুষ দেয়- সংখ্যাটি অনেক না। যদি ঘুষ দিতে থাকি, সেবা নিতে গিয়েই তাড়াহুড়ো করি তবে এই জাতির ভাগ্য বিপর্যয় ছাড়া কোনভাবেই বদলাবে না। সব সরকারের আমলে তো একই জনগণ। মানুষকে দেশের স্বার্থে শোধরাতে হবে । নয়তো রক্তমাখা এই বিপ্লব অর্থহীন যাবে এবং যারা বিপ্লবের অংশ-সমর্থক তাদেরকে কালে কালে ভয়ঙ্কর খেসারত দিতে হবে। 
লেখক: প্রাবন্ধিক

জনপ্রিয়