ঢাকা বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪ , ৬ অগ্রাহায়ণ ১৪৩১ আর্কাইভস ই পেপার

bkash
bkash
udvash
udvash
uttoron
uttoron
Rocket
Rocket
bkash
bkash
udvash
udvash

বিকল্প শিক্ষা পদ্ধতি: মন্টেসরি ও হোম স্কুলিং

মতামত

মাহবুবুর রহমান, আমাদের বার্তা ডেস্ক

প্রকাশিত: ০০:১০, ১৯ নভেম্বর ২০২৪

আপডেট: ১২:৫৭, ১৯ নভেম্বর ২০২৪

সর্বশেষ

বিকল্প শিক্ষা পদ্ধতি: মন্টেসরি ও হোম স্কুলিং

বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থার পাশাপাশি বিকল্প শিক্ষা পদ্ধতি নিয়ে আগ্রহ বাড়ছে, যাদের মধ্যে মন্টেসরি ও হোম স্কুলিং অন্যতম। এই পদ্ধতিগুলো প্রচলিত স্কুল শিক্ষার বাইরের ধ্যান-ধারণা ও কৌশল প্রয়োগ করে। শিশুদের ব্যক্তিগত মানসিক ও শারীরিক বিকাশের গুরুত্ব, সৃজনশীলতা ও স্বাধীনতার প্রতি মনোযোগ এদের মূল বৈশিষ্ট্য। নিচে এই দুটি পদ্ধতির বিস্তারিত আলোচনা দেয়া হলো। 

মন্টেসরি পদ্ধতি: ড. মারিয়া মন্টেসরি ১৯০৭ খ্রিষ্টাব্দে ইতালিতে শুরু করেন মন্টেসরি শিক্ষা পদ্ধতি। এটি একটি শিশুকেন্দ্রিক শিক্ষা পদ্ধতি, যেখানে শিক্ষার্থীকে স্বাধীনভাবে শেখার সুযোগ ও পরিবেশ প্রদান করা হয়। এই পদ্ধতির বৈশিষ্ট্যগুলো হলো-১. স্বতন্ত্র শিক্ষাগ্রহণ: মন্টেসরিতে প্রতিটি শিশু নিজের গতিতে শিখতে পারে। এখানে শ্রেণিকক্ষে শিক্ষকের ভূমিকা গাইড করা, সরাসরি শেখানোর নয়।

২. বাস্তব অভিজ্ঞতা ও হাতেকলমে শেখা: মন্টেসরি শিক্ষা পদ্ধতিতে বিভিন্ন বাস্তব অভিজ্ঞতা ও হাতে-কলমে কাজ শেখার ওপর গুরুত্ব দেয়া হয়। এটি শিশুদের চিন্তাশক্তি ও সৃজনশীলতাকে উন্নত করে।
৩. প্রাকৃতিক পরিবেশ: মন্টেসরি শ্রেণিকক্ষগুলোতে শিক্ষাসামগ্রী এমনভাবে সাজানো থাকে যা শিশুরা সহজেই ব্যবহার করতে পারে। এই শিক্ষা উপকরণ শিশুদের কৌতূহল ও সৃজনশীলতার বিকাশে সহায়ক ভূমিকা পালন করে।
৪. বয়সভিত্তিক শ্রেণিবিন্যাস নয়: মন্টেসরি শ্রেণিকক্ষে বয়সভিত্তিক বিভাজনের পরিবর্তে বিভিন্ন বয়সের শিশুরা একসঙ্গে শিক্ষাগ্রহণ করে, যা তাদের মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতা ও সম্পর্ক স্থাপনে সহায়তা করে।

৫. স্বাধীনতার ওপর জোর: মন্টেসরি শিক্ষা পদ্ধতি শিশুরা কীভাবে শেখে এবং কীভাবে স্বাধীন চিন্তা ও কৌতূহল বাড়ায়, তা নিয়ে কাজ করে। শিশুরা নিজের মতো করে যা পছন্দ করে তা করতে পারে, যা তাদের আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধি করতে সহায়ক।
৬. শৃঙ্খলা ও দায়িত্ববোধ শেখানো: এই পদ্ধতিতে, শিশুরা নিজের কাজে নিয়মানুবর্তিতা এবং দায়িত্বের গুরুত্ব শিখে। শ্রেণিকক্ষের পরিবেশই তাদের আত্মশৃঙ্খলিত হতে শেখায়। মন্টেসরি শিক্ষকগণ ছাত্রদের দায়িত্ব নিতে সহায়তা করেন, যা শিশুদের পরবর্তী জীবনে সাহায্য করে।

৭. অবজেক্টিভ মূল্যায়ন: এখানে পরীক্ষাভিত্তিক মূল্যায়নের পরিবর্তে শিক্ষার্থীদের কাজের ওপর ভিত্তি করে মূল্যায়ন করা হয়। এতে তারা শেখার জন্য পরীক্ষা ভীতির পরিবর্তে দক্ষতা অর্জনের প্রতি আগ্রহী হয়।

৮. শারীরিক ও মানসিক উন্নয়ন: মন্টেসরি পদ্ধতিতে শিক্ষার্থীদের গঠনমূলক শারীরিক ও মানসিক বিকাশের দিকে গুরুত্ব দেয়া হয়। এই পদ্ধতির ক্লাসরুমে হাতেকলমে কাজের সুযোগ থাকে যা তাদের মোটর দক্ষতার উন্নয়ন ঘটায়।
হোম স্কুলিং: হোম স্কুলিং শিক্ষার একটি পদ্ধতি যেখানে শিক্ষার্থীরা পরিবারের সদস্যদের তত্ত্বাবধানে নিজ গৃহে শিক্ষাগ্রহণ করে। এই পদ্ধতিতে শিশুদের স্কুলে যাওয়ার প্রয়োজন হয় না; বরং তারা তাদের নিজেদের ঘরেই শেখে। হোম স্কুলিংয়ের বৈশিষ্ট্যগুলো হলো: ১. শিক্ষার্থীর ওপর সম্পূর্ণ মনোযোগ: হোম স্কুলিংয়ে অভিভাবক শিশুর জন্য পুরো শিক্ষার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেন। এতে একজন অভিভাবক প্রতিটি সন্তানের প্রয়োজনীয়তা অনুযায়ী পাঠ পরিকল্পনা তৈরি করতে পারেন।

২. ফ্লেক্সিবল সময়সূচি: হোম স্কুলিংয়ে সময়সূচির কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। শিশুরা যখন প্রস্তুত থাকে, তখনই তারা শিখতে পারে। এটি শিশুর শেখার প্রতি ইতিবাচক মনোভাব তৈরি করে।
৩. বিশেষ শিক্ষার সুযোগ: শিশুদের ব্যক্তিগত দক্ষতার ভিত্তিতে বিশেষায়িত শিক্ষা পরিকল্পনা করা যায়। তাদের মেধা অনুযায়ী শেখার সুযোগ তৈরি করা যায়।


৪. নৈতিক ও সাংস্কৃতিক শিক্ষা: হোম স্কুলিংয়ে পরিবারগুলোর পক্ষে নিজস্ব মূল্যবোধ ও সংস্কৃতি অনুযায়ী শিক্ষার পরিকল্পনা সম্ভব হয়।
৫. পারিবারিক মূল্যবোধের ওপর ভিত্তি করে শিক্ষাদান: হোম স্কুলিংয়ের মাধ্যমে অভিভাবকরা তাদের নিজস্ব পারিবারিক ও নৈতিক মূল্যবোধ অনুযায়ী শিক্ষাদান করতে পারেন। এটি তাদেরকে শিশুদের জন্য নৈতিকতা, সংস্কৃতি ও জীবনের গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষার সুযোগ দেয়।

৬. শিক্ষাগত স্বাধীনতা: হোম স্কুলিংয়ে পরিবারগুলো শিক্ষার পদ্ধতি ও উপকরণ নিজের মতো বেছে নিতে পারে। শিশুরা নির্দিষ্ট পাঠ্যক্রম বা শ্রেণির বাধ্যবাধকতা ছাড়াই নিজেদের গতি ও শিক্ষার স্টাইল অনুযায়ী শিখতে পারে।
৭. বিভিন্ন বিষয়ে দক্ষতা অর্জনের সুযোগ: হোম স্কুলিংয়ে শিশুদের প্রচলিত শিক্ষা ছাড়াও সংগীত, চিত্রাঙ্কন, প্রযুক্তি, বিজ্ঞান, এবং অন্যান্য ক্ষেত্রে উন্নত করতে পারেন। এর ফলে তারা বহুমুখী জ্ঞান অর্জন করতে পারে।
৮. নির্দিষ্ট সময়সূচি অনুসরণের প্রয়োজন নেই: হোম স্কুলিংয়ে নির্দিষ্ট সময়সূচি অনুসরণের প্রয়োজন নেই। শিশুরা যখন পড়তে প্রস্তুত, তখনই পড়াশোনা করতে পারে। এতে সময়ের নমনীয়তা থাকে এবং শিক্ষার্থীদের ওপর চাপ কম পড়ে।
মন্টেসরি ও হোম স্কুলিং পদ্ধতির তুলনামূলক আলোচনা
১. শিক্ষাদানের ধরন 
মন্টেসরি: মন্টেসরি পদ্ধতিতে শিশুরা একটি নির্দিষ্ট, বিশেষভাবে গঠিত শ্রেণিকক্ষে, স্বয়ংক্রিয় ও হাতে-কলমে কাজের মাধ্যমে শিখে। এখানে শিক্ষার্থীরা নিজের গতিতে শেখে এবং শিক্ষকের ভূমিকা পথপ্রদর্শকের মতো, যিনি শিক্ষার্থীদের স্বাধীনতা বজায় রেখে শিক্ষার পরিবেশ তৈরি করেন।
হোম স্কুলিং: হোম স্কুলিংয়ে শিক্ষাদানের ধরন অভিভাবকের ওপর নির্ভরশীল। এখানে শিশুর শেখার পদ্ধতি ও গতির পুরো নিয়ন্ত্রণ পরিবারের হাতে থাকে। অভিভাবকেরা শিক্ষার বিষয় ও কৌশল নিজেদের মতো করে তৈরি করতে পারেন, যা প্রতিটি শিশুর জন্য আলাদা হতে পারে।
২. শিক্ষার পরিবেশ
মন্টেসরি: মন্টেসরি পদ্ধতিতে একটি নির্দিষ্ট পরিবেশ থাকে যেখানে বিভিন্ন শিক্ষাসামগ্রী সহজেই শিশুদের হাতে থাকে। শিশুরা দলগতভাবে কাজ করে এবং বিভিন্ন বয়সের শিক্ষার্থীদের একত্রে শেখানো হয়।
হোম স্কুলিং: হোম স্কুলিংয়ে শিক্ষার পরিবেশ বাড়ির অভ্যন্তরে। শিশুদের জন্য ক্লাসরুম বা নির্দিষ্ট পরিবেশ তৈরি না করেও তারা পরিবারের নিয়ন্ত্রণে নিজের ঘরে পড়াশোনা করে।
৩. সামাজিক বিকাশ
মন্টেসরি: মন্টেসরি শ্রেণিকক্ষে বিভিন্ন বয়সের শিক্ষার্থীরা একত্রে শেখে, যা তাদের মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতা ও সামাজিক যোগাযোগের দক্ষতা বাড়াতে সহায়ক। দলগত কাজের মাধ্যমে শিশুদের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে ওঠে।
হোম স্কুলিং: হোম স্কুলিংয়ে সামাজিক মেলামেশার সুযোগ তুলনামূলকভাবে কম। শিশুরা একা পড়াশোনা করায় সামাজিক দক্ষতা অর্জনের সুযোগ সীমিত থাকে। তবে অনেক অভিভাবক শিশুকে সামাজিক গোষ্ঠীতে যুক্ত করার চেষ্টা করেন।
৪. শিক্ষার নিয়ন্ত্রণ ও নমনীয়তা
মন্টেসরি: মন্টেসরি পদ্ধতিতে শিক্ষার নিয়ন্ত্রণ শিশুদের স্বাধীনতাকে সম্মান জানিয়ে করা হয়, কিন্তু এটি একটি নির্দিষ্ট কাঠামোর মধ্যে পরিচালিত হয়। শিক্ষার সময়সূচি এবং কার্যক্রমগুলো শিক্ষক ও স্কুল কর্তৃক নির্ধারিত হয়।
হোম স্কুলিং: হোম স্কুলিংয়ে শিক্ষার সময়সূচি ও বিষয় সম্পূর্ণরূপে অভিভাবকের ওপর নির্ভর করে। এতে শিশুদের শেখার গতি ও প্রয়োজন অনুযায়ী শিক্ষাদানের সময় ও পদ্ধতি নির্ধারণের পূর্ণ স্বাধীনতা থাকে।
৫. ব্যয় ও সুবিধা
মন্টেসরি: মন্টেসরি স্কুলগুলোর ফি অনেক ক্ষেত্রে বেশি হয়, যা অনেক পরিবারের জন্য চ্যালেঞ্জ হতে পারে। বিশেষত, উন্নত মন্টেসরি স্কুলগুলোতে ভর্তি করাতে অনেক ব্যয় হয়।
হোম স্কুলিং: হোম স্কুলিং তুলনামূলকভাবে ব্যয়সাশ্রয়ী হতে পারে। কারণ, স্কুলের ফি বা অতিরিক্ত বইপত্রের প্রয়োজন হয় না। তবে এটি নির্ভর করে পরিবারের ব্যবস্থাপনার ওপর, এবং অনেক সময় পরিবারের পূর্ণ মনোযোগ প্রয়োজন হয়।
৬. শিক্ষা পরিকল্পনা ও মূল্যায়ন
মন্টেসরি: মন্টেসরিতে মূল্যায়ন প্রথাগত পরীক্ষার মাধ্যমে না হয়ে শিক্ষার্থীর প্রতিদিনের কাজের মাধ্যমে করা হয়। এটি পরীক্ষাভীতি দূর করে এবং শিশুদের দক্ষতার মূল্যায়নে সহায়ক হয়।
হোম স্কুলিং: হোম স্কুলিংয়ে অভিভাবকেরাই মূল্যায়নের কাজ করেন। অনেক সময় আনুষ্ঠানিক পরীক্ষা না নেয়া হলেও শিশুর প্রতিদিনের কাজ ও দক্ষতা দেখেই অভিভাবকরা তাদের অগ্রগতির মূল্যায়ন করতে পারেন।
৭. শিক্ষকের ভূমিকা
মন্টেসরি: মন্টেসরি শিক্ষকগণ গাইড বা পরামর্শদাতা হিসেবে কাজ করেন, যারা শিশুদের স্বাধীনতা বজায় রাখার জন্য সহযোগিতা করেন এবং নিজেদের গতি অনুযায়ী শিখতে সাহায্য করেন।
হোম স্কুলিং: হোম স্কুলিংয়ে অভিভাবকেরাই শিক্ষক হিসেবে কাজ করেন এবং শিক্ষাদানের সমস্ত দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এটি অভিভাবকের ওপর অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করতে পারে, তবে এতে শিশুর ব্যক্তিগত প্রয়োজন অনুযায়ী শিক্ষা প্রদান সম্ভব হয়।
এই পদ্ধতিগুলোর চ্যালেঞ্জ ও ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা
১. শিক্ষামূল্যের ভারসাম্য: মন্টেসরি স্কুলগুলোর খরচ অনেক সময় বেশি, তাই সবাই এটি গ্রহণ করতে পারেন না। হোম স্কুলিংয়ের ক্ষেত্রে অভিভাবকেরা সময় ও মনোযোগ দিতে পারেন না।
২. শিক্ষকের প্রশিক্ষণ: মন্টেসরি পদ্ধতিতে শিক্ষককে বিশেষ প্রশিক্ষণ নিতে হয়। হোম স্কুলিংয়ে অভিভাবকের শিক্ষাদানের দক্ষতার প্রয়োজন হয়।
৩. সমাজে স্বীকৃতি: অনেক দেশে হোম স্কুলিং এখনও সমাজে পূর্ণ স্বীকৃতি পায়নি। তবে, বর্তমান সময়ে বিভিন্ন দেশে এটি জনপ্রিয়তা পাচ্ছে এবং শিক্ষাক্ষেত্রে বিকল্প পদ্ধতি হিসেবে গুরুত্ব পাচ্ছে।
মন্টেসরি ও হোম স্কুলিং শিক্ষার ক্ষেত্রে বিকল্প দুটি পদ্ধতি, যা শিশুর উন্নয়নে ভিন্নভাবে সহায়ক। এই পদ্ধতিগুলো শিশুকে নিজের গতি ও শৈল্পিক দক্ষতার বিকাশে সহায়তা করে। তবে, যে কোনো শিক্ষাপদ্ধতির সফলতা নির্ভর করে শিশু ও অভিভাবকের চাহিদা, সক্ষমতা ও আগ্রহের ওপর। শিশুরা যেন সুস্থ, সৃজনশীল ও স্বাধীন চিন্তা-ভাবনাসম্পন্ন ব্যক্তি হয়ে উঠতে পারে, সে জন্য বিকল্প এই শিক্ষাপদ্ধতিগুলো কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে।

লেখক: পিএইচডি গবেষক, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় 

জনপ্রিয়