ক্ষিতি, অপ তেজ, মরুৎ ও ব্যোম। এই পঞ্চ মহাভূতের সংমিশ্রণে মানুষ গঠিত। আবার পঞ্চ মহাভূতের মাধ্যমে ধ্বংস ও হবে এই মানুষ। মানুষ সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ। এটা তার সৃজনশীলতা, চিন্তা, আবিষ্কার এবং কর্ম দক্ষতা দ্বারা প্রমাণিত সত্য। স্রষ্ট্রা মানুষকে তার প্রতিনিধি হিসেবে প্রেরণ করেছেন। যার মাধ্যমে তার মর্যাদা দেবতাদেরও ওপরে বলে গেছে। কিন্তু মানুষ ষড়রিপু দ্বারা গঠিত।
সে রিপুর তাড়নায় যেমন অন্যায় করে বসে তদ্রূপ রিপুর তাড়নায় মানবতার কল্যাণে থেকে সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ হিসেবে পরিচয় দিয়ে বসে। সৃষ্টি জগৎ সব জায়গায় সমান নয়। কোথাও উঁচু কোথাও নিচু, কোথাও পাহাড় ও সাগর, কোথাও উর্বর কোথাও মরুভূমি, কোথাও ক্যাকটাস কোথাও সুজলা সুফলা বৃক্ষরাজি প্রভৃতি। এ এক অনুপম সৃষ্টি। মানুষের ভেতর ধনী-গরিব ব্যবধান লক্ষ্য করা যায়। আজ চরম মানবতা লঙ্ঘনকারীদের মুখে মানবতার সুর শোনা যায়।
তারা বলেন, আমরাই দুনিয়ায় শান্তি স্থাপনকারী অথচ বিশৃঙ্খলতা সৃষ্টিকারীদের পক্ষে তারা। জগতে সীমাহীন অপতৎপরতা মানুষকে ঘোরের ভেতর ফেলে দিয়েছে। মানুষের কাছে জগৎ আজকে ফ্যাশনময় হয়ে উঠেছে যা তার প্রকৃত সত্য ও জীবনবোধ বুঝতে কষ্টসাধ্য করে তুলেছে। যার মাধ্যমে মানুষ আকাশ, বাতাস, মাটি, পানি খেয়েও ক্ষুধা মিটছে না। বরং তারা ধ্বংসের খেলায় মেতে উঠেছে।
একটা সুন্দর ফুল একটা সুন্দর পাখি মানুষ কাছে পেয়ে ছিন্ন ভিন্ন করতে চায়। পাখিটাকে খাবার দিয়ে মুক্ত আকাশে উড়তে দেয়া ভালো। এই শিক্ষটা নিজ তাগিদ থেকে অনুভব করতে হবে। একটি পশু ফাঁদে পড়ে গেলে একজন মানুষ যদি দেখে চলে যায় তাহলে ওই জীবটা তো সুস্থ থাকবে না। ওই মানুষও সুস্থ থাকতে পারে না। কারণ, ফাঁদ থেকে পশুটাকে বাঁচানো মহৎ আত্মার লক্ষণ।
আত্মাটাই ভালো থাকবে যে, পশু টিকে ফাঁদ থেকে মুক্তি দিয়ে খাবার দিয়েছে। মানুষের ভেতর
কিছু অসৎ চরিত্রের প্রেতাত্মা আছে যাদের দ্বারা সুন্দর জগৎ ধ্বংস এবং অশান্তির দিকে ধাবিত হয়। মানুষের ভেতর বিভিন্ন অপরোধ আছে যা সমাজের শান্তিকে বিদায় জানিয়েছে। মানব সত্তার আছে দুটি দিক একটি দৈহিক এবং অন্যটি মানবিক। দেহগত বিষটির পরিপুষ্টির জন্য আহার, পানাহার দরকার হয় তেমনি মানবিক দিক দিয়ে মানুষ উন্নত চিন্তার ও কল্যাণ কামনার নৈতিক শিক্ষার দরকার। এই দুইটার সংমিশ্রণে মানুষ গঠিত। মানুষ যদি মানবিক বিষয়গুলোর উন্নয়ন না ঘটায় তাহলে তার যাত্রা হবে অন্ধকার পথে, যা থেকে নিষ্কৃতির উপায় আবিষ্কার করতে হবে। মানুষের বিপথগামিতা নিয়ে সমাজ চিন্তাবিদদের ভাবনার শেষ নেই। তার বিপথগামীর মধ্যে আছে চুরি, ডাকাতি, হত্যা, ধর্ষণ, কলোবাজারি, লুটপাট, সুদ, ঘুষ, পতিতাবৃত্তি, মদ, জুয়া ওয়াদা খেলাপ, চোগলখুরি, মিথ্যা, অসম্মান করা প্রভৃতি।
মানুষের এই নৈতিক কাজ থেকে দূরে সরানোর জন্য নীতি এবং শাস্তির ব্যবস্থা করা হয়েছে। নীতিশিক্ষায় একজন মানুষ তার চরিত্র পরিবর্তন করতে পারে। আবার শাস্তির ভয়েও একজন নাগরিক অন্যায় কাজ থেকে নিজকে দূরে রাখে। মানুষকে নীতিবিদ্যার শিক্ষা দিতে হবে। আর এটা ব্যবহারিক নীতিবিদ্যার সঙ্গে জড়িত। সমতার নীতি, জাতিগত বৈষম্য, প্রাণী হত্যা, গর্ভপাত, ভ্রুণহত্যা, কৃপা হত্যা, ধনী-দরিদ্রের সমস্যা, পরিবেশ ও বাস্তুসংস্থান, গণতন্ত্র, সহিংসতা বিপর্যয় এবং বৈশ্বিক উষ্ণতার কারণে স্থলভাগ সমুদ্রের গর্ভে বিলীন হতে পারে বলে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করা হচ্ছে। ওজন স্তর ছিদ্র হচ্ছে।
মানুষসহ পৃথিবীর অন্যান্য জীবের বেঁচে থাকা দুরূহ হয়ে পড়েছে। সংগত কারণে জনসচেনতা বৃদ্ধির জন্য ব্যবহারিক নীতিবিদ্যা পড়ানোর দরকার আছে। মানবতা প্রতিষ্ঠা এবং মানুষ যে মানুষের শত্রু নয় বরং বন্ধু, এই শিক্ষা দেয়ার জন্য সত্য জ্ঞানের দরকার আছে। কারণ, সত্য সুন্দর, মতই মুক্তি।
মানুষের মধ্যে যদি সত্যের জ্ঞান ঢোকে তাহলে সে অন্যায় করতে পারে না। বরং পতিত জনতার বন্ধুতে পরিণত হয়। শুধু এখানেই শেষ নয়, ট্রাফিক আইন, মেডিক্যাল এথিক্স, ব্যাংকিং এথিকস, ইয়োলো জার্নালিজম এগুলো পাঠ্যক্রমে অর্ন্তভুক্ত করতে হবে।
একজন মানুষ যদি প্রকৃত মানুষ হয় তাহলে তার দ্বারা আরো হাজারো অন্ধকার আত্মা আলোকিত হবে এতে সন্দেহ নেই। এই আলোকিত মানুষ কীভাবে তৈরি হবে এই শিক্ষাটা আজকের বিশ্ববাসীর জন্য সবচেয়ে বড় প্রয়োজন।
আলোকিত জাতি গঠিত হবে শিক্ষার মাধ্যমে। শিক্ষা ছাড়া কোনো জাতি উন্নতি করতে পারে না। আজ মানুষ মহাকাশে পৌঁছেছে, সমুদ্রের গভীরে প্রবেশ করেছে। এমনকি মহাকাশে স্টেশন তৈরি করছে কিন্তু আপন নিবাসে শান্তিতে বসবাস করতে শিখেনি।
বর্তমান সভ্যতা আসছে মানুষের কাছে গতি এবং সহিংসতা নিয়ে। বাটনে চাপ দেয়ার মাধ্যমে এক শহরের মানুষকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দুনিয়া থেকে বিদায় করা সম্ভব। এই গতি এবং সহিংসতার সঙ্গে মানুষের আগে পরিচয় ছিলো না। যুদ্ধ থেকে মানব জাতিকে কিভাবে মুক্ত করা যার এজন্য জ্ঞান দরকার। শিক্ষাব্যবস্থায় আমরা সত্য শিক্ষার দরজা যতো খোলা রাখবো ততো মানুষের মননশীল বিষয়গুলো উন্নত হবে। মানুষ পাবে শান্তির ঠিকানা। পাশ্চাত্যের বস্তুবাদী শিক্ষা এবং প্রাচ্যের আধ্যাত্মিক শিক্ষা থেকে আমাদের শিক্ষা নিতে হবে। অতি যান্ত্রিকতার ভেতর থেকে মানুষের মননশীল, সৌন্দর্যময়, মানবতা মূল্যবোধ পুষ্ট সমাজ না পাওয়া যাওয়াই স্বাভাবিক।
আবার প্রাচ্যের ভাববাদী শিক্ষা থেকেও যদি মানুষ শুধু নৈতিকতার চর্চা করতে থাকে তাহলে তার অবস্থা হবে বিচ্ছিন্ন উপজাতির মতো। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় পাশ্চাত্য ও প্রাচ্যের শিক্ষা থেকে শিক্ষা নিতে হবে। তবেই মানসিক, মানবিক ও নৈতিক শিক্ষার দ্বারা উন্মুক্ত হবে। একজন মানুষ নীতি জ্ঞানসম্পন্ন, কিন্তু তার বিমান চালনার জ্ঞান নেই। মানে তিনি বিমান চালাতে পারবেন না। আবার বিমান চালনা জ্ঞান আছে অথচ নীতিজ্ঞান সম্পন্ন না। তাহলে তার জীবন বিষিয়ে উঠতে পারে। মানুষ পেতে পারে না কোন শান্তির বার্তা।
মানুষকে জগৎ এবং জীবনকে বুঝতে হবে। হতে হবে সৎ, দেশপ্রেমিক, নীতিজ্ঞান সম্পন্ন। মানুষের মানবিক গুণাবলির যদি কোনো উন্নয়ন না হয় তাহলে সুন্দর সভ্যতা যা দীর্ঘদিনের পরিচালনার মাধ্যমে সাধনার মাধ্যমে লিখিত হয়েছে তা ধ্বংসস্তুপে পরিণত হবে। আমরা যদি দুনিয়ায় মানুষের বিচরণ দেখতে চাই এবং মানব জাতির ভবিষ্যৎ অন্ধকারময় অবস্থা থেকে আলো জ্বালাতে চাই তাহলে সত্য শিক্ষার দ্বার উন্মুক্ত রাখতে হবে। তবেই মানবতা মুক্তি পাবে। মানুষ পাবে শান্তির ঠিকানা।
লেখক: প্রভাষক, সরকারি ইস্পাহানী ডিগ্রি কলেজ