বলা হয়ে থাকে শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড। আর সেটা অবশ্যই সুশিক্ষা। শিক্ষার প্রথম ধাপ বা স্তর হচ্ছে প্রাথমিক শিক্ষা। এই প্রাথমিক শিক্ষা হচ্ছে প্রাক-প্রাথমিক শ্রেণি থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত। যদি প্রাথমিকের ভিত দুর্বল হয় তবে ওপরের দিকে ধারাবাহিকতা রক্ষা করা বেশ কঠিন হয়ে যায়। তাই প্রাথমিক শিক্ষার ওপর বেশ গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। সরকারও এই স্তরে সব শিক্ষার্থীদের বিনামূল্যে পড়ার সুযোগ দিয়েছে।
দেশে বর্তমানে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা ৬৫ হাজার ৯৯টি। যাতে শিক্ষক রয়েছেন ৩ লাখ ৪৮ হাজার ৫৮৪ জন। এসব শিক্ষকদের শিক্ষাগত যোগ্যতা বর্তমানে ন্যূনতম স্নাতক ডিগ্রি। যদিও অতীতে মেট্রিকুলেশন বা এসএসসি থাকলেও এখন অধিকাংশ ক্ষেত্রেই স্নাতক, স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী। এর পাশাপাশি অনেকের রয়েছে পেশাগত বিভিন্ন কোর্স। যেমন- বিএড, এমএড। আর ডিপ্লোমা ইন এডুকেশন প্রশিক্ষণ। সি-ইন-এড প্রশিক্ষণ তো রয়েছেই। তাহলে এখন কী বলার সুযোগ আছে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের যোগ্যতা অন্য পেশাজীবীদের তুলনায় নেহায়েত কম, বরং ক্ষেত্র বিশেষে বেশি রয়েছে।
দেশে বর্তমানে প্রাক-প্রাথমিক ও প্রাথমিক মিলিয়ে শিক্ষক রয়েছেন ৩ লাখ ৪৮ হাজার ৫৮৪ জন। আর শিক্ষার্থী সংখ্যা ২ কোটি ৯ লাখ ১৯ হাজার ২০১ জন। তাহলে এই সংখ্যাধিক্য জনগণের শিক্ষার ভার প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের হাতে ন্যস্ত। এ সংখ্যা প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ২০১৮ খ্রিষ্টাব্দের হিসাব অনুযায়ী। বর্তমানে কমবেশি হতে পারে।
দেশের প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী একজন চাকরি প্রার্থী স্নাতক ডিগ্রি নিয়ে কোথায় আবেদন করতে পারেন। কোনো হিসেব ছাড়াই বলে দেয়া যায় সর্বোচ্চ বিসিএস ক্যাডারের মতো মর্যাদাবান পেশায় খুব সহজেই আবেদনের যোগ্যতা নিয়ে যদি সর্বনিম্ন তহশিলদার (ইউনিয়ন ভূমি সহকারী কর্মকর্তা) পদে এবং ইউনিয়ন পরিষদের সচিব পদে কিংবা একটা কৃষি ডিপ্লোমা সার্টিফিকেট নিয়ে যদি ইউনিয়ন পর্যায়ে ব্লক সুপারভাইজারদের আপগ্রেডেশন করে উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা অর্থাৎ ২য় শ্রেণিতে উন্নীত করা হয়। তাহলে স্নাতক ডিগ্রি চাহিদা নিয়ে বিজ্ঞপ্তিতে আবেদন করে ৩য় শ্রেণির পদ ও পদমর্যাদা শুধুই অবহেলা বা বেখেয়ালি সিদ্ধান্তই নয়, চরম বৈষম্যেরও।
এই শিক্ষকেরাই যেমন শিক্ষা কার্যক্রমের অংশ হিসেবে শ্রেণি পাঠদান করে থাকেন। তেমনি শিক্ষকদের পাঠের বাইরে যেসমস্ত কাজগুলো করতে হয়, তা নিম্নে তুলে ধরা হলো-শিক্ষার্থী ভর্তি রেজিস্টার, বই বিতরণ রেজিস্টার, প্রাক প্রাথমিক স্টক রেজিস্টার, প্রাক-প্রাথমিক রেজুলেশন রেজিস্টার, ঝরে পড়া শিক্ষার্থী রেজিস্টার, অভর্তিকৃত শিশুর তথ্য রেজিস্টার, এসএমসি রেজুলেশান রেজিস্টার, শিক্ষক অভিভাবক সমিতি রেজিস্টার, মা সমাবেশ রেজিস্টার, অভিভাবক সমাবেশ রেজিস্টার, উঠান বৈঠক রেজিস্টার, পাক্ষিক সভা রেজুলেশন রেজিস্টার, পুনরাবৃত্তি রেজিস্টার ছবিসহ উপবৃত্তি রেজিস্টার, উপবৃত্তি চাহিদা রেজিস্টার, মিটিং রেজিস্টার, ক্ষুদে ডাক্তার তালিকা রেজিস্টার, কাব রেজুলেশন রেজিস্টার, কাব আয়-ব্যয় রেজিস্টার, কাব দল গঠন রেজিস্টার, কাব চাঁদা আদায় রেজিস্টার, কাব স্টক রেজিস্টার, কাব দল নোটিশ বহি, কাব পরিদর্শন রেজিস্টার, কাব শিক্ষার্থী হাজিরা রেজিস্টার, স্টুডেন্ট কাউন্সিল নির্বাচন, স্টুডেন্ট কাউন্সিল সভা রেজিস্টার, সমাপনী পরিক্ষা সংক্রান্ত রেজিস্টার, বিদ্যালয় পরিদর্শন রেজিস্টার, সাংস্কৃতিক ও ক্রীড়া রেজিস্টার, অন্য বিদ্যালয়ে গমন রেজিস্টার, বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিক্ষার্থীর তালিকা রেজিস্টার, নৈমিত্তিক ছুটি রেজিস্টার, শিক্ষার্থীদের পোষাক ও টিফিনবক্স বিতরণ রেজিস্টার, সাব ক্লাস্টার প্রশিক্ষণ রেজিস্টার, বৃক্ষ রোপণ সংক্রান্ত রেজিস্টার, কম্পিউটার ও মাল্টিমিডিয়া সংরক্ষণ রেজিস্টার, পাঠাগার বই আদান-প্রদান রেজিস্টার, শ্রেষ্ঠ অভিভাবক নির্বাচন রেজিস্টার, বিদ্যালয়ের ব্যাংক হিসাব ও ক্যাশ রেজিস্টার, স্লিপ রেজুলেশন রেজিস্টার, স্লিপ সরকারি ক্যাশ রেজিস্টার, স্লিপ বেসরকারি ক্যাশ রেজিস্টার, স্লিপ স্টক রেজিস্টার, সহায়ক পঠন সামগ্রী রেজিস্টার, মুভমেন্ট রেজিস্টার, ক্ষুদ্র মেরামত ক্যাশ রেজিস্টার, সরকারি ক্যাশ রেজিস্টার, সরকারি স্টক রেজিস্টার, জমি সংক্রান্ত রেজিস্টার, বিদ্যুৎ বিল রেজিস্টার, ওয়ান ডে ওয়ান ওয়ার্ড (১ম-৫ম শ্রেণি) বাংলা ও ইংরেজি রেজিস্টার, সততা স্টোর চালু, খাতা-কলম-চক ও আনুষঙ্গিক জিনিস ক্রয়, প্রশ্ন প্রণয়ন ও ছাপানো, পরীক্ষার কাগজ ক্রয়, পরীক্ষার আয়োজন করা, পরীক্ষার খাতা দেখা, ফলাফল ঘোষণা, খেলাধুলার আয়োজন করা, শিক্ষক বদলি/অবসর/মাতৃত্বকালীন/শিক্ষা ছুটি/দীর্ঘ মেয়াদি অসুস্থতাজনিত বছরে ২/৩ বার ক্লাস রুটিন তৈরি, বার্ষিক কর্ম পরিকল্পনা তৈরি, ক্যাচমেন্ট এরিয়া চার্ট তৈরি, শিক্ষার্থীদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে হোম ভিজিট করা, শিক্ষার্থীদের নিয়ে বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ (ইউনিয়ন/উপজেলা/জেলা পর্যায়ে), কমিটির মিটিং আয়োজন করা, সভা-সমাবেশ আয়োজন করা, বিদ্যালয়ের মেরামত কাজ করানো, শিক্ষা অফিস থেকে বই সংগ্রহ, মাসকাবারি তৈরি করা, পাঠ পরিকল্পনা করা, বিভিন্ন দিবস উপলক্ষে ব্যানার তৈরি ও শিক্ষার্থীদের গানের অনুশীলন করানো। এ ছাড়া স্কুলের বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজগুলো করানো ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।
এইসব কার্যক্রম কাজের ধারাবাহিকতার আলোকে প্রতিবছরই করতে হয় একজন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষককে। এজন্য প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষককে একাডেমিক পাঠদানের বাইরে কী রকম কাজের চাপে থাকতে হয় তা বলার অপেক্ষা রাখে না। আবার শিক্ষক স্বল্পতার কারণে চলমান দাপ্তরিক কাজগুলোর পাশাপাশি অনেক সময় কোনো রকম বিরতি ছাড়াই সকাল থেকে ছুটি পর্যন্ত প্রায় ৭-৮টা বিষয়ের পাঠদান চালিয়ে যেতে হয়।
শিক্ষার্থীদের মনো-দৈহিক অবস্থা বিবেচনায় নিয়ে একেকজনকে একেক রকমভাবে পাঠদান করতে হয়, যা অন্য পেশাজীবীদের থেকে অনেক অনেক বেশি। উপরন্তু এই সামাজিক মর্যাদাবান চাকরিটাই যেনো এখন সবার কাছে অসম্মানজনক। আগে দেশের আর্থিক অনেক অসমর্থতা ছিলো বর্তমানে সেই অবস্থা নেই। তা ছাড়া আমার বা আপনার সন্তানকে ভালো শিক্ষা দিতে গেলে শিক্ষকের পরিবার নিয়ে বর্তমান দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির যুগে কোনোভাবেই পেরে উঠছেন না শিক্ষক সমাজ। এই মর্যাদাবান পেশার লোকের বেতনটা ১৩ম গ্রেড এ ৩য় শ্রেণির পদমর্যাদায় ফেলে রাখা নিছকই হঠকারীই শুধু নয় চরম বৈষম্যেরও বটে।
কারণ, সমাজে মাথা তুলে দাঁড়াতে গেলে একজন শিক্ষকের শুধু নিজেকে নিয়ে ভাবলে হয় না। রয়েছে একটা পরিবার। এই পরিবারেও থাকেন বয়োবৃদ্ধ মা-বাবা। যাদের নিত্যই ওষুধ-পথ্যের যোগান দেয়া। ভরণপোষণ তো দেয়া লাগবেই। এর পর আছে স্ত্রী এবং একাধিক সন্তান। তাদের ভরণপোষণ, শিক্ষার ব্যয়, চিকিৎসা, বিভিন্ন আচার-অনুষ্ঠান তো রয়েছেই। কারণ, একজন শিক্ষককে সমাজের আর দশজনের সঙ্গে সম্পর্ক রেখে চলতে হয়। যদি সন্তানদের উচ্চশিক্ষার বিষয় আসে তবে তো কথাই নেই। নিজে না খেয়ে সন্তানদের খরচ দেয়ার বিষয় তো আছে। তারপর সন্তানদের প্রতিষ্ঠিত করানোর পালা। বিয়ের অনুষ্ঠান কিংবা সামাজিকতা সে দুরাশা। আর এইসব বিষয়ে এখন জাতির গর্ব শিক্ষকদের সঙ্গেই ঘটছে প্রতিনিয়ত।
প্রাথমিক বিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক যে টাকা বেতন ভাতা পেয়ে থাকেন এর চেয়ে বেশি আয় রোজগার করে থাকেন আমার দেশের মুটেমজুর। তাই বলে তাদের ছোট করে দেখছি না। একজন ফেরিওয়ালার সামাজিক মর্যাদা না থাকলেও একজন শিক্ষক থেকে বেশি আয় করে থাকেন।
তা ছাড়া একই শিক্ষকের একজন ছাত্র কোনোরকম পড়াশোনা করে যদি হাইস্কুলে শিক্ষকতা পেশা বেছে নেন সেক্ষেত্রে সেই ছাত্র হয়ে যান প্রাইমারি স্কুলেরই শিক্ষকের ঊর্ধ্বতন স্কেলধারী। প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো এক সময় বেসরকারি পর্যায়ে গড়ে উঠলেও পর্যায়ক্রমে জাতীয়করণ করা হয়। বর্তমানে শিক্ষকদের এই ন্যায্য দাবি যৌক্তিকতার নিরিখেই মেনে নেয়া উচিত বলে মনে করি। সারাদেশে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা রাস্তায় নেমে মানববন্ধন, স্মারকলিপিসহ শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিতে সোচ্চার রয়েছেন। যেটা ইতিবাচক বলেই মনে করি।
পরিশেষে বলতে হয়, একজন শিক্ষিত লোক বেকার না থেকে সম্মানজনক পেশায় নিয়োজিত থেকে মানব সন্তানদের সুশিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলছেন। এতে করে পিতা-মাতার পর একজন যদি অভিভাবক দাবি করে থাকেন তিনি হতে পারেন শিক্ষক। শিক্ষকদের দ্বিতীয় শ্রেণির পদমর্যাদা কিংবা দাবিকৃত ১০ম গ্রেড অতিরঞ্জিত কিংবা কল্পনাবিলাসী নয়। বরং সমাজবাস্তবতার নিরিখে শতভাগ যৌক্তিকতা থাকায় আমারও মত থাকবে দাবি মেনে নিন। সরকার কতো শত দাবি মেনে নিয়েছে। শুধু শিক্ষকদের এই মামুলি দাবিকে তুচ্ছজ্ঞান না করে একটু গুরুত্ব দিয়ে তাদের মুখে হাসি ফুটিয়ে তুলতে সহায়তা করলে রাষ্ট্রের খুব যে ক্ষতি হয়ে যাবে তা নয়। মেধার মূল্যায়নের কারণে দেশ আরো এগিয়ে যাবে।
লেখক: অ্যাডভোকেট