ঢাকা সোমবার, ২৫ নভেম্বর ২০২৪ , ১০ অগ্রাহায়ণ ১৪৩১ আর্কাইভস ই পেপার

bkash
bkash
udvash
udvash
uttoron
uttoron
Rocket
Rocket
bkash
bkash
udvash
udvash

রাজনীতি বনাম বিরাজনীতিকরণ

মতামত

মোস্তফা আবু রায়হান, আমাদের বার্তা ডেস্ক

প্রকাশিত: ০০:২০, ২২ নভেম্বর ২০২৪

আপডেট: ১৫:৩১, ২২ নভেম্বর ২০২৪

সর্বশেষ

রাজনীতি বনাম বিরাজনীতিকরণ

‘রাজনীতি’ শব্দটি শুনতে শুনতে যাদের কান ঝালাপালা হয়ে গেছে তাদের ক্ষেত্রে ‘বিরাজনীতিকরণ’ প্রত্যয়টি খানিকটা হলেও কান জোড়ানোর আবহ তৈরি করেছে বলতে হবে। ছোট্ট এই ভূখণ্ডে এতো বেশি রাজনীতি চর্চা হয় যে বাদবাকি বিশ্বে ততো রাজনীতি উৎপাদন হয় কি না সন্দেহ। এবং সে কারণেই বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোতে কোনো কর্মী নেই নেতা আর নেতা। ‘ঠগ বাছতে গাঁ উজাড়’ এর মতো রাজনৈতিক পদাধিকারী বাদ দিলে এ দেশে আর মানুষ পাওয়া যায় না।

তাই সঙ্গত কারণেই দেশের সবচেয়ে বড় দুই দলের প্রোগ্রামে নেতার চাপে মঞ্চ বিধ্বস্ত হয়ে পড়ার মহিমান্বিত দৃশ্য উপভোগ করার সুযোগ পেয়েছে সবাই। কিন্তু আমরা আশঙ্কা করছি, নেতার ভারে মঞ্চ ভেঙে পড়ার মতো গোটা দেশটা-ই একদিন ধসে পড়ে কি না!

এ দেশে ৫০ জন মন্ত্রী হন তাদের নিজেদের ফ্যামিলির এবং আরো চৌদ্দ দিকের ‘চৌদ্দগোষ্ঠী’র অন্তত (৫০ X ৩০০ = ১৫,০০০) পনের হাজার জন মন্ত্রীর চেয়ে অধিকতর উচ্চপদ মর্যাদায় অধিষ্ঠিত থাকে। ৩০০ জন এমপি হন তাদের ফ্যামিলির অন্তত পনের হাজার জন এমপির চেয়ে ‘পাওয়ারফুল’ অবস্থায় বিরাজ করে। তাদের মর্যাদা ও পাওয়ারের ঠেলায় মানুষ-গরু-প্রকৃতি সব অস্থির হয়ে যায়, সকলের ওপর নেমে আসে এক সর্বগ্রাসী আধিপত্যের বিভীষিকা। 

মন্ত্রী-এমপির ওপরের স্কেলে চড়ে থাকা এই ‘তাদের লোকেরা’ কার বুকে, কার ঘাড়ে, কার মাথায় পা দিয়ে চলে তার কোনো হিসাব থাকে না। তারা এলাকাময় (ইজারাঅঞ্চল) চাঁদাবাজি, দখলবাজি ও খবরদারির সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা ও নিয়ন্ত্রণ করে ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইল হয়ে ওঠে লুটপাট-চাঁদাবাজি-দখলবাজির এক অভয়ারণ্য। দুর্নীতি, লুটপাট, চাঁদাবাজি, দখলবাজি, খবরদারি, সিন্ডিকেট কারসাজি, ব্যাংক লুট, টাকা পাচার এগুলো আজ নির্বাচিত রাজনৈতিক শক্তির রাজকীয় অধিকার বলে এ দেশে পাকাপোক্তভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে। গোটা ভূখণ্ডটাই তাদের পরিবারের সঙ্গে জড়িত লোকজন, প্রশাসনে-আমলাতন্ত্রে ‘তাদের লোক’ এবং তাদের সমর্থনকারী চামচা-গ্রুপগুলো ভাগভাগ করে যেন ইজারা নেয়। এটা অনেকটা নব্য জমিদারির এক পাঁচশালা বন্দোবস্ত; কেউ কেউ এই জমিদারি: পাঁচেক্কে পাঁচ, পাঁচ দুগুণে দশ, তিনে পাঁচা পনের...এভাবে বাড়াতে চেষ্টা করে, সফলও হয়।

এ দেশে রাজনৈতিক সরকার মানেই চামচার চাঁদাবাজি, দালালের দখলবাজি আর ‘আদর্শের সৈনিকদের লুটপাট। এখানে রাজনীতি দখলবাজিকে চালায়, নাকি দখলবাজি রাজনীতিকে চালায় এ এক দুর্জ্ঞেয় ধাঁধা। এই ধাঁধার ধোঁয়াশায় সহজসরল মূর্খ জনগোষ্ঠী চোখে ধান্ধা লেগে আন্ধা হয়ে পড়ে আছে শুভঙ্করের ভয়ঙ্কর এক ফাঁকিতে। হ্যাঁ, এ দেশে এই ফাঁকির নামই ‘গণতন্ত্র’, এরই নাম ‘রাজনীতি’। এখানে গণতন্ত্র মানে নির্বাচন নির্বাচন খেলা, এ দেশে রাজনীতি মানে ভোট ভোট জুয়া এই জুয়ায় দান মারতে পারলে ননস্টপ চুরি-ডাকাতি আর লুটপাটের মচ্ছব চলে। ঘর্মাক্ত জনতা নিজের শরীরের ঘাম ঝরানোর সমানুপাতিক অধিকারের জন্য, নিজের ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য ভোট দিয়ে তাদের প্রতিনিধি নির্বাচন করে। নির্বাচিত হয়ে প্রতিনিধিরা নিজেদের ভাগ্যকে টেনে নিয়ে যান মালেশিয়া, সিঙ্গাপুর, লন্ডন, কানাডা, আমেরিকায়। ফতুর হয়ে পিছে পড়ে থাকে জনতা ও জনতার দেশ। ভোটের পরে জনগণের প্রতিনিধিরা হয়ে পড়েন গণপ্রজাতন্ত্রের ‘প্রজা’র প্রজাপীড়ক ‘রাজা’।

এই লুটপাট-দুর্নীতির সহায়ক শক্তি হিসেবে অত্যাবশ্যক হয়ে পড়ে দলীয় (রাজনৈতিক) প্রশাসন, দলীয় (রাজনৈতিক) পুলিশ, দলীয় (রাজনৈতিক) আমলাতন্ত্র, দলীয় (রাজনৈতিক) বিচারব্যবস্থা। অর্থাৎ প্রশাসন, পুলিশ, আমলাতন্ত্র, বিচারব্যবস্থা ইত্যাদি তাদের নিরপেক্ষ অবস্থান হারিয়ে ফেলে; তাদের নিরপেক্ষ ও জনমুখী চরিত্র লুট হয়ে যায়। এবং যথারীতি রাষ্ট্রের এইসব মহান পীঠস্থানেও দুর্নীতি ও লুটপাট চলতে থাকে সমানুপাতিক হারে। ন্যায়-শাসন লুট হয়, ন্যায়-শৃঙ্খলা লুট হয়, ন্যায়-নীতিনির্ধারণী লুট হয় এবং ন্যায়-বিচার লুট হয়। সর্বোপরি রাষ্ট্রের স্তরে স্তরে রন্ধ্রে রন্ধ্রে জনমুখী, ন্যায়ানুগ ও আইনসম্মত ব্যবস্থাপনা পুরোপুরি লুট হয়ে যায়। দেশে আজ এমন একটি প্রতিষ্ঠান নেই যা ‘রাজনীতিকরণে’ অকার্যকর করে ফেলা হয়নি। সোনার বাংলায় এই সামগ্রিক লুটপাটের সুবর্ণ সুযোগের প্রচলিত নাম-ই তো ‘রাজনীতি’ বা ‘দলীয় রাজনীতি’।

আর এর ভিত্তি হিসেবে কাজ করে ব্যক্তি-পূজা-তন্ত্র বা পরিবার-পূজা-তন্ত্র। এই ‘তন্ত্র’ই মেয়াদান্তরে সবখানেই ‘আমাদের লোক’ বনাম ‘তাদের লোক’ এর পালাবদলের খেল দেখাচ্ছে। তবে একটা সরকার যা লুটপাট-দুর্নীতি করে যাচ্ছে, মানুষের ঘাড়ে যা ঋণ চাপিয়ে যাচ্ছে তা সেই সরকারের আমলে জানা সম্ভব হচ্ছে না। থলের বেড়াল বের হচ্ছে তারা ক্ষমতা হারানোর পর, ততদিনে থলে ফাঁকা।

বাংলাদেশে ‘দখলবাজি’ এবং ‘রাজনীতি’ আজ সমার্থক, আপনি যে-ই হন সত্যের খাতিরে এটা আপনাকে স্বীকার করতেই হবে। তাই তো মুক্তিযুদ্ধের চেতনার নামে এখানে সীমাহীন লুটপাট-দুর্নীতি সম্ভব হয়, গণতন্ত্রের নামে পাকাপোক্ত হয় ব্যক্তিকেন্দ্রিক স্বৈরতন্ত্র। সংখ্যাগরিষ্ঠতার খবরদারিতে যে যেভাবে খুশি সংবিধান কাঁটা-ছেঁড়া করে আর মলম লাগায়।

আমাদের আন্দোলন-সংগ্রামের ইতিহাস, আমাদের জাতিগত গর্ব-অহংকার, আমাদের যা-কিছু অর্জন সবকিছুই রাজনীতির নামে কোনো কোনো রাজনৈতিক শক্তি জিম্মি করে রেখেছে। আমাদেরকে বিভক্ত করে রেখেছে মোটা দাগে। আর বিভক্ত জাতি কিছুকাল পরপর কেবল নিজেদের মধ্যে শক্তিক্ষয় করে, রক্তপাত ঘটায় সামনে এগোতে পারে না। মুক্তিযুদ্ধ আমাদের জাতিগত গর্ব, তা কেনো কোনো পরিবারের সম্পত্তি হয়ে থাকবে! তা কেনো কোনো বিশেষ দলের রাজনীতি-ব্যবসার পূজি বা রাজনীতি-কারখানার কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহৃত হবে! বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ এই অবস্থার অবসান চায়।

আমাদের প্রধান রাজনৈতিক শক্তিগুলোর গতি পরস্পরের বিপরীতমুখী। তাদের প্রচেষ্টা জাতিকে বিভক্ত করে রেখে শোষণ করে যাওয়ার, যা ইংরেজদের সেই ‘Divide and Rule’কে মনে করিয়ে দেয়। এর জন্য তাদের আছে ভিন্ন ভিন্ন ‘চেতনার কারবার’। কেউ মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ব্যবসায়ী, কেউ নব্য জাতীয়তাবাদের চেতনা ব্যবসায়ী, কেউ ইসলামের চেতনা ব্যবসায়ী, কেউ সাম্যবাদের চেতনা ব্যবসায়ী আর মাঝখানে ‘ফুটবল’ জনগণ ধরাশায়ী। কেউ বিএনপির চশমায় দেশ দেখে, কেউ জামায়াতের চশমায় দেশ দেখে, কেউ আওয়ামী লীগের চশমায় দেশ দেখে, কেউ ডানের চশমায় দেশ দেখে, কেউ বামের চশমায় দেশ দেখে। কিন্তু আমাদের প্রয়োজন নিজের চোখে দেশ দেখার ক্ষমতাসম্পন্ন মানুষ।

বৃহৎ রাজনৈতিক দলগুলো ব্যক্তি ও পরিবারকেন্দ্রিক জনগণকেন্দ্রিক নয়। তারা দলের মধ্যে গণতন্ত্র চর্চা না করে, দলের মধ্যে ‘রাজতন্ত্রীয় ব্যক্তিতন্ত্র’ বজায় রেখে দেশে গণতন্ত্র বিছিয়ে দিতে চায়। নেতার বড় বড় নাম ও ছবির সাইনবোর্ডে, ব্যানারে, ফেস্টুনে, বিলবোর্ডে, বিজ্ঞাপনে ও তোরণে দেশ ছেয়ে যায়, আর তার আড়ালে ঢাকা পড়ে যায় দেশের জনগণ। সব দল হয়ে পড়ে নেতার দল জনতার দল হতে পারে না। ব্যক্তিকেন্দ্রিকতা মানেই কর্তৃত্ববাদ অর্থাৎ স্বৈরাচার, আর প্রকাশ্য স্বৈরাচারের চেয়ে গণতন্ত্রের মুখোশধারী স্বৈরাচার বেশি ভয়ংকর।

এই চামচামি, দালালি, লেজুড়বৃত্তি, তোষামোদি ও দাসত্ব এখানে ‘রাজনীতি’। এই পূজাতন্ত্রের পালাবদলই দেখছে বাংলাদেশ তার জন্মলগ্ন থেকে। ক্ষমতার মেয়াদের পর মেয়াদ এখানে চলছে নেতা পূজা, নেতার পরিবার পূজা, নেতার দল পূজা, নেতার কবর পূজা, নেতার প্রতিমা-চিত্র পূজা। এই রাজনৈতিক পূজাচর্চায় লজ্জাজনকভাবে লেপ্টে যায় বাংলা মায়ের মুখ। এই যদি ‘রাজনীতি’ হয়, তবে মানুষ চিরতরে পরিত্রাণ চায় এই রাজনীতির কবল থেকে। তার নাম যদি হয় ‘বিরাজনীতিকরণ’, তবে তাই হোক এ দেশের মানুষের দাসত্ব মুক্তির নিয়ামক।

‘বিতর্কিত’ ফখরুদ্দীন আহমদ সরকারের সময় এমনই দেশ সংস্কারের জনআকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়েছিলো। সংস্কারের অনেক রকমের বৈপ্লবিক প্রস্তাবনায় আমরা উদ্বুদ্ধ হয়েছিলাম, আশান্বিত হয়েছিলাম। সাধারণ মানুষ আশায় বুক বেঁধেছিলো যে, দেশের মানুষের জন্য ভালো কিছু হবে। সে সময় আমি ঢাকায় তৃণমূল পর্যায়ে ঘুরেছি ফখরুদ্দীন সরকার সম্পর্কে জনঅনুভূতি জানার জন্য। বস্তিবাসী, রিকশাওয়ালা, ফেরিওয়ালা, শ্রমজীবী ধুলোর লেভেলের মানুষগুলোর সবার মুখে এক কথাই শুনেছি, তারা সরকারের প্রতি সন্তোষ প্রকাশ করেছে ‘এই সরকারই দেশ চালাক’, তারা কোনো ‘ভোট’ চায় না। প্রচলিত রাজনীতির প্রতি তাদের চাপা ক্ষোভ, ঘৃণা ও বিবমিষা শব্দে শব্দে প্রকাশ হয়ে পড়ছে। কিন্তু শেষপর্যন্ত হয়নি কিছুই, মানুষ যেই অন্ধকারে আবদ্ধ ছিলো সেই অন্ধকারই বজায় থেকেছে, বরং বলা ভালো আরো ঘনীভূত হয়েছে। তারা যেসব সংস্কার করেছিলো বা সংস্কারের ছক কষেছিলো তা ভোটে ‘নির্বাচিত’ আওয়ামী লীগ সরকার বাদ দেয়। রাজনীতির নামে জয় হয় দুর্বৃত্তায়নের।

ফখরুদ্দীন সরকারকে উল্লেখ করে ‘এক এগারো’, ‘মাইনাস-টু ফরমুলা’, ‘বিরাজনীতিকরণ’ ইত্যাদি থিওরির কথা এর আগে প্রায়ই শোনা যেতো, আজকাল আবার জোরেসোরে এর গুঞ্জন উঠেছে। এখানে দেখার বিষয়, এই গুঞ্জন যারা তুলছেন তারা কারা? ‘বিরাজনীতিকরণ’ ধোঁয়া তুলে কেনো তারা আশঙ্কা প্রকাশ করছেন? ‘বিরাজনীতিকরণ’ বলতে তারা আসলে কী বোঝাতে চান? পাশাপাশি আরো দেখতে হবে, ‘রাজনীতিকরণ’ এ পর্যন্ত দেশের মানুষকে কতোটা লাভবান করেছে! কথিত ‘বিরাজনীতিকরণ’ কায়েম হলে সাধারণ জনগণ কতোটা ক্ষতির সম্মুখীন হতে পারে!

রাজনীতির মহাজনেরাই ‘বিরাজনীতিকরণ’ অর্থাৎ রাজনীতির বাণিজ্য বন্ধ হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনায় শঙ্কিত হচ্ছেন এবং বিরাজনীতিকরণের নামে শঙ্কা ছড়ানোর চেষ্টা করছেন। কে না জানে যে এ দেশে রাজনীতি হচ্ছে সবচেয়ে লাভজনক ব্যবসায়। রাজনীতি করে ইনকামের তথা লুটপাটের জুতসই সুযোগ চিরতরে বন্ধ হলে অনেকেই ছেড়ে দেবেন এই ব্যবসায়। জনগণের ভোটাধিকার, গণতন্ত্র ও সুশাসনের নামে এরা কেউ প্রাণপণ করেন লুটপাট-দুর্নীতির সাম্রাজ্য টিকিয়ে রাখতে, কেউ প্রাণপণ করেন লুটপাট-দুর্নীতির সাম্রাজ্যে আসীন হতে। বাইরে বাইরে বিরাজানীতিকরণের আশঙ্কার নামে ভেতরে ভেতরে এরা আসলে এই সাম্রাজ্য হাতছাড়া হওয়ার ভয় পান।

তারা কথায় কথায় বলছেন, বিরাজনীতিকরণের দিকে যাওয়া যাবে না’, ‘দেশে সফলভাবে বিরাজনীতিকরণ চলছে’, ‘বিরাজনীতিকরণের বিরুদ্ধে আমাদের যুদ্ধ’ ইত্যাদি ইত্যাদি। রাজনৈতিক দলগুলো কি ভেবে নিয়েছে যে এ দেশের একমাত্র মালিক তারাই। তারা পালাক্রমে রাজনৈতিক ক্ষমতার জাল-জালিয়াতিতে দেশ ও জনগণকে জিম্মি করে রাখবে। তাদের ভাবভঙ্গিতে মনে হয়, রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় নেই মানেই দেশে রাজনীতি নেই, দেশ রসাতলে গেলো। সবাইকে মনে রাখতে হবে, রাজনৈতিক দলবাজি ও রাজনৈতিক সচেতনতা এক জিনিস নয়। নাগরিকেরা যদি রাজনীতি-সচেতন না হয় সে ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় থেকেও লাভ নেই। আবার রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় আছে কি না সে প্রশ্ন গুরুত্বপূর্ণ নয়, যদি দেশবাসী রাজনীতি-সচেতন হয়।

রাজনৈতিক দলগুলোর হাবভাবে মনে হচ্ছে, দেশের জনগণ নির্বাচনের জন্য উন্মাদ হয়ে গেছে, ভোট দেয়ার জন্য মাথা কুটে মরছে। আমাদের দেশ প্রজাতন্ত্র, প্রজারাই দেশের মালিক। সেই প্রজারা ‘রাজনীতি’র জন্য, রাজনৈতিক সরকারের জন্য পাগল হয়ে উঠেছে বলে মনে হচ্ছে না। কারণ, এ দেশের বেশিরভাগ জনগণ সহজসরল হলেও তারা আজ এটা বোঝে যে, এ দেশে রাজনীতি হচ্ছে নির্বাচনের নামে তামাশা, ‘তোমার নেতা আমার নেতা’র ভেলকিবাজি। এখানে হাতে গোনা কয়েকটি পরিবার এই তামাশার খেলাটা খেলে থাকে। বৃহত্তর মূর্খ আবেগকে ব্ল্যাকমেইল করে এ দেশে ধর্মীয় রাজনীতি টিকে আছে, আর দলীয় রাজনীতি টিকে আছে লুটপাট-চাঁদাবাজি-দখলবাজির ওপর নির্ভর করে। এই অশুভ রাজনীতি, দুর্নীতি ও দুঃশাসন থেকে নাগরিক-সাধারণ মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। তারা বিকল্প চায়, মুক্তি চায়। কিন্তু দুর্বৃত্তায়ন যেভাবে অক্টোপাসের মতো রাজনীতিকে আঁকড়ে ধরে আছে, তাতে এ দেশের মানুষের মুক্তি সুদূরপরাহত বলেই মনে হচ্ছে।

একটি দল ‘যতো দ্রুত সম্ভব’ নির্বাচন চান, নির্বাচিত সরকার চান। কেনো বলুন তো! কারণ, তারা দ্রুত গদিতে বসতে চান। দেড় যুগ মানুষের সেবা করা থেকে বঞ্চিত থেকে লাগাতার পাপ স্তূপীকৃত করেছেন, আর কতো! ‘দেশকে উন্নত ও সমৃদ্ধিশালী করতে নির্বাচিত সরকারের কোনো বিকল্প নেই। জনগণের উন্নয়ন জনগণের নির্বাচিত সরকার দ্বারাই সম্ভব। জনগণের সরকার হলে জনগণের প্রতি দায়বদ্ধ থাকে’। 

একদম সোজা বাংলায় বললে চুরি, ডাকাতি, লুটপাট, চাঁদাবাজি, দখলবাজি, খবরদারির ‘লাইসেন্সকেই এখানে রাজনীতি বলা হচ্ছে। ‘আপনার দল’ ক্ষমতায় মানে, আপনি যা ইচ্ছা তাই করতে পারেন। দিবালোকে লাশ ফেলে দিয়েও দিব্যি ঘুরে বেড়াতে পারেন। কেউ কিচ্ছুটি বলতে পারবে না। সাধারণ নাগরিকেরাও না, প্রশাসন-আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও না। অতীত ইতিহাস অন্তত তাই বলে। তো এই অবস্থার অবসান যদি হয় ‘বিরাজনীতিকরণ’ তবে সেই কল্পিত ‘বিরাজনীতিকরণ’ই মানুষ চায়। যে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় চোর-ডাকাতের সংখ্যা কম থাকে সেটাই মঙ্গল। কেনোনা অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে, পুরোপুরি চোর-ডাকাতমুক্ত ব্যবস্থা আমরা আর কল্পনা করার সাহস পাচ্ছি না। তবে এই ‘মাফিয়া চক্রের রাজনীতি’ কোনো যুক্তিতেই চলতে দেয়া যায় না। রাজনীতির নামে গোষ্ঠীকেন্দ্রিক দাসপ্রথা, চৌর্যবৃত্তি, নৈরাজ্য ও দুর্বৃত্তায়ন এখনই বন্ধ করতে হবে।
লেখক: কবি ও সংস্কৃতিকর্মী

 

জনপ্রিয়