‘ও মা অঘ্রাণে তোর ভরা ক্ষেতে কী আমি দেখেছি মধুর হাসি---।’ কবিগুরুর কী অমর সৃষ্টি! অগ্রহায়ণ মাসকে বর্ণনা করার জন্য এই একটি লাইনই যথেষ্ট। ছোটবেলায় স্কুল জীবনে এই লাইনটি যে কতবার পড়েছি তার কোনো শেষ নেই। কিন্তু এই লাইনটি পড়তে পড়তে মুখস্থ হলেও এর অর্থ বুঝেছি অগ্রহায়ণের প্রকৃতি ও উৎসব আয়োজন থেকে।
হাজার-হাজার বছর আগে কৃষি প্রথা চালু হবার পর থেকেই নবান্ন উৎসব পালিত হয়ে আসছে। পহেলা অগ্রহায়ণে নতুন ধানের উৎসবে মেতে উঠে গ্রামীণ জনপদ। নারী-পুরুষ, কিষান-কিষানি, শিশু, বৃদ্ধ সবাই মেতে ওঠে এই নবান্ন উৎসবে। নতুন ধানের তৈরি হরেক রকম খাবারের আয়োজনে মাতে গ্রামবাসী। পোশাকে ফুটে ওঠে গ্রামীণ সাজ। এ যেনো প্রাণের উৎসব। কবি-সাহিত্যিকরা হেমন্তকে তুলে ধরেছেন আপন মহিমায়। বর্ষার শেষদিকে বোনা আউশ-আমন শরতের মাঠে দোলা দিতে থাকে। হেমন্তে তা পরিপক্ক হয় এবং অগ্রহায়ণে ঘরে তোলার ধুম পড়ে। হেমন্তের ফসলকে কেন্দ্র করেই নবান্ন উৎসবের সূচনা। নবান্ন মানে নতুন অন্ন। এটি এককথায় ‘শস্যোৎসব’।
হেমন্ত মানে রূপের মাঝে অপরূপ। বৃষ্টিহীন আকাশে সোনালি সূর্যের রূপ লাবণ্য মোহনীয় করে তোলে অগ্রহায়ণের সোনালি ধান। শীতের হাওয়ায় বন-বনানীতে হালকা কাঁপন নিয়ে আসে হেমন্ত। এ সময় থাকে না উষ্ণতার আকুতি, থাকে না গরমের হাঁসফাঁস করা বিরক্তি। হেমন্তের শিশিরস্নাত ভোরে ধান গাছের ডগায়, ঘাসের ডগায় মুক্তো বিন্দুর মতো জমে থাকে শিশিরবিন্দু। প্রভাতে আর সন্ধ্যায় কুয়াশার চাদর বিছিয়ে রাখা প্রকৃতি যেনো ধূসর আবহের বাতাবরণ তৈরি করে। দিনের মধ্যভাগ ছাড়া অন্যসময় হিম হিম ভাব থাকে। হেমন্ত শীতের আগমনী গান গেয়ে যায়। এ যেন প্রকৃতির অন্য রকম ছোঁয়া। হেমন্তের প্রাণ নবান্ন। ম ম গন্ধে হেমন্তের বার্তা ছড়িয়ে পড়ে বাংলার ঘরে ঘরে।
কবি-সাহিত্যিকরাও হেমন্ত বন্দনায় মেতে উঠেছেন। প্রেমে পড়েছেন হেমন্তের। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায়- ‘হায় হেমন্তলক্ষ্মী, তোমার নয়ন কেনো ঢাকা-/হিমের ঘন ঘোমটাখানি ধূমল রঙে আঁকা. . .’। কবি জীবনানন্দ দাশ তার ‘পিপাসার গান’ কবিতায় লিখেছেন, ‘হেমন্ত বৈকালে/উড়ো পাখপাখালির পালে/ উঠানে পেতে থাকে কান,/ শোনে ঝরা শিশিরের ঘ্রাণ।’
বাংলার প্রাচীন জনপদে কৃষিকাজে নারীর অংশগ্রহণ ছিলো বহু আগে থেকেই। বর্তমানে নারীর অংশগ্রহণ আগের থেকে বেড়েছে। পুরুষের সঙ্গে সমানতালে কৃষিকাজে নারীর অংশগ্রহণ ভিন্নমাত্রা যোগ করেছে। শুধু হেমন্ত নয় বাংলার ষড়ঋতুর রূপ-রস-গন্ধ সবাইকে মুগ্ধ করে। হেমন্তকে কেন্দ্র করে গ্রামে গ্রামে গ্রামীণমেলার আয়োজন করা হয়। গান, নৃত্য, আবৃত্তি আর প্রকৃতির কথামালায় চিরচেনা হেমন্তকে তুলে ধরা হয়। গ্রামের গণ্ডি পেরিয়ে শহরেও ছড়িয়ে পড়ে এ উৎসব। অগ্রহায়ণের কুয়াশামাখা সকাল আর মিষ্টি ছড়ানো রোদের মধ্যে নানা বয়সের মানুষের অংশগ্রহণে রাজধানীসহ দেশের প্রায় সকল শহরে পালিত হয় নবান্ন উৎসব।
রাজধানী ঢাকার ইট-পাথরের দেয়াল কত-শত ব্যস্ততার মধ্যেও নগরবাসী মেতে উঠে এই উৎসবে। নগরে নবান্নের আগমনে অনেকেই গ্রামীণ ঐতিহ্যের পোশাক পড়ে। ক্ষণিকের জন্য হলেও গ্রামের নারীদের ভাব-ভাষা, পুরুষের পাঞ্জাবি, মাথায় গামছা, কৃষকের টুপি, ছোট ছোট মেয়েদের মিষ্টিমুখ করানো দৃশ্য যেনো পল্লী ও নগরের মেলবন্ধন তৈরি করা হয় এ সময়ে। আদিগন্ত মাঠ জুড়ে সোনালি ধান, মিষ্টি রোদ আর আরামদায়ক আবহাওয়ার প্রকৃতি ঠিকই জানান দিয়ে বলে যাচ্ছে নবান্নের উৎসবগাথা ।
নবান্ন উৎসব একটি উদার, সর্বজনীন ও অসাম্প্রদায়িক উৎসব। তরুণদের শিকড়ে ফেরার উৎসব এটি। এককথায় বলা চলে, এটি গণমানুষের উৎসব। যদিও নগরায়ণের প্রভাবে এটি হারিয়ে যেতে বসেছে। অপরিমাণদর্শী উন্নয়নের থাবা পড়েছে প্রকৃতিতে। জলবায়ু পরিবর্তনের ভয়াবহ প্রভাব প্রকৃতিকে দৃশ্যমান। হেমন্তকে হেমন্তের মতো থাকতে দিচ্ছে না। কিন্তু প্রকৃতিকে রুখে এমন সাধ্য কার! ঋতুচক্রের পালাবদলে হেমন্ত তার মতো করে জানান দিয়ে যাবে প্রাণ-প্রকৃতিতে।
গ্রামীণ সংস্কৃতিকে টিকিয়ে রাখতে, প্রকৃতির ঋতুবৈচিত্র্যের সঙ্গে মানুষের সন্নিবেশ ঘটাতে এবং উদার, সর্বজনীন ও অসাম্প্রদায়িক শিক্ষা নিতে গ্রামীণ এই উৎসবকে শুধু শহরে নয়, বিশ্বের যেখানে বাঙালি আছে সেখানে এই উৎসব ছড়িয়ে দিতে হবে।
চারদিকে প্রযুক্তির জয়জয়কার চলছে। গ্রামীণ ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি এখন প্রযুক্তির ছোঁয়ায় এবং পরিবর্তনের আবহে হারিয়ে যেতে বসেছে! একসময় গ্রামবাংলার ঢেঁকি ধান ভানার কাজে ব্যবহার করা হতো কিন্তু এখন তা বিলীন হয়েছে বলা চলে। গ্রামীণ অনেক খেলাধুলা হারিয়ে যেতে বসেছে। একসময় কাবাডি খেলার ধুম পড়ত গ্রামে। দেশের জাতীয় খেলা হলেও এ খেলা এখন খুব কমই দেখা যায়। যাহোক, গ্রামীণ ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে টিকিয়ে রাখতে হবে। বিশ্বের প্রতিটি দেশের প্রবাসী বাঙালিদের মধ্যে পালিত হোক এই নবান্ন উৎসব। সৃষ্টি হোক সংস্কৃতির নবজাগরণ। বিশ্বব্যাপী এই উৎসবকে ছড়িয়ে দিতে সব প্রবাসী বাঙালিদেরও উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। বাঁশির সুর, লোকজ গান, নতুন ধানের পিঠা-পুলির স্বাদ ও গ্রামীণ সাজের আবেদন ছড়িয়ে পড়ুক বিশ্বময়।
লেখক: শিক্ষক